দেশের বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা এখন ৩৫ লাখ ৭ হাজার ৮৯৮টি, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৩৪ লাখ ৫৩ হাজার ৩৫৩টি। এরপর গত ছয় মাসে এ সংখ্যা বেড়েছে ৫৪ হাজার ৫৪৫টি।
মামলার ভারে জর্জরিত আদালতে প্রতিদিনই জমা হচ্ছে নতুন নতুন মামলা। কিন্তু বিচারক সংখ্যা বাড়েনি সে হারে। দেশের অধস্তন আদালতে এখন বিচারক সংখ্যা মাত্র এক হাজার ৭০০ জন।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। আইনি পদ্ধতিতে মামলা নিষ্পত্তিতে বছরের পর বছর লেগে যায়। রায় যখন পাওয়া যায়, তখন আর প্রাসঙ্গিকতা থাকে না। ফলে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়টি জোরদার করা দরকার। সর্বোচ্চ এক বা দু’দিন মুলতবি করে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে।
২০১৮ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৩ লাখ ৯৬ হাজার উল্লেখ করে গত বছর সংসদে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মামলাজট কমাতে নানা উদ্যোগের কথা বলেছিলেন। তিনি বলেন, বিচার ব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে আনতে বিচারক সংখ্যা বাড়ানো ও এজলাস সংকট নিরসনে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সরকারের বিশেষ উদ্যোগে বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে।
মামলার সংখ্যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ বলেছেন, বিচারাধীন ৩৪ লাখ মামলার বিপরীতে আমাদের বিচারক মাত্র এক হাজার ৬৪৭ জন। ভারতে বিচারাধীন তিন কোটি মামলার বিপরীতে বিচারক ২৩ হাজার জন।
বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখ লোকের বিপরীতে যেখানে বিচারক ১০ জন, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রে ১০৭ জন, কানাডায় ৭৫ জন, ইংল্যান্ডে ৫১ জন, অস্ট্রেলিয়ায় ৪১ জন এবং ভারতে ১৮ জন। তিনি বলেন, ভারতে একজন বিচারকের বিপরীতে এক হাজার ৩৫০টি মামলা বিচারাধীন এবং একজন বিচারক বছরে ৫১৬টি মামলা নিষ্পত্তি করছেন।
বাংলাদেশে একজন বিচারকের বিপরীতে দুই হাজার ১২৫টি মামলা রয়েছে। গত বছরের হিসাবে আমাদের একজন বিচারক বছরে নিষ্পত্তি করছেন ৭০০ মামলা। বিচারক স্বল্পতার কারণে গত এক যুগে শুধু ঢাকার ৪০টি আদালতে মামলা বেড়েছে চারগুণেরও বেশি। সেখানে এখন মোট মামলার সংখ্যা ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪৭১টি।
শুধু ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলার সংখ্যা ৭৩ হাজার ৮৯৯টি। কিন্তু মামলা বাড়লেও সেভাবে বিচারক বাড়েনি। সুপ্রিম কোর্টের অবস্থাও একই। বর্তমানে আপিল বিভাগে ৭ জন এবং হাইকোর্ট বিভাগে ৯২ জন বিচারপতি রয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে ৫ লাখ ২৭ হাজার মামলা বিচারাধীন।
সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, সুপ্রিম কোর্টসহ দেশের সব আদালতে বর্তমানে বিচারাধীন মামলা ৩৫ লাখ ৭ হাজার ৮৯৮টি। যার মধ্যে দেওয়ানি ১৩ লাখ ৯৯ হাজার ৬২৫টি, ফৌজদারি ২০ লাখ ১৭ হাজার ৯১৪টি এবং অন্যান্য ৯০ হাজার ৩৫৯টি। এর মধ্যে জেলা ও দায়রা জজ আদালতসহ অন্যান্য আদালতে ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৫৮৪টি, হাইকোর্ট বিভাগে ৫ লাখ ৭ হাজার ৬৯৫টি এবং আপিল বিভাগে ১৯ হাজার ৬১৯টি।
মামলার জট প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, আদালতের বাইরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে মামলাজট কমিয়ে আনা সম্ভব। এ লক্ষ্যে আইনও সংশোধন করা হয়েছে। তবে কাঙ্ক্ষিত সুফল এখনও মেলেনি। আনুষ্ঠানিকভাবে মামলা নিষ্পত্তিতে বছরের পর বছর লাগছে। রায় যখন মেলে, তখন প্রাসঙ্গিকতাই থাকে না।
তিনি বলেন, মামলাজট কমাতে হলে সর্বোচ্চ এক বা দু’দিন মুলতবি করে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে।
পর্যাপ্ত বিচারক ও প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগের তাগিদ দিয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, মামলাজটের অন্যতম কারণ বিচার ব্যবস্থায় অপ্রতুল অর্থ বরাদ্দ।
তিনি বলেন, ১৬ কোটি মানুষের দেশে ১৬শ’ বিচারক দিয়ে ভালো বিচার ব্যবস্থা সম্ভব নয়।
এদিকে মামলাজট কমানোয় জোর দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। এ প্রসঙ্গে সুপ্রিমকোর্টের স্পেশাল অফিসার ব্যারিস্টার সাইফুর রহমান বলেন, নতুন বছরের শুরুতেই প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টের ১৪টি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন একেবারে পুরনো ফৌজদারি (বিবিধ) মামলার শুনানির জন্য। তার সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রতি বৃহস্পতিবার পুরনো মামলাগুলো হাইকোর্টের ১৪টি বেঞ্চের কার্যতালিকায় শুনানির জন্য রাখা হয়।
ওই ১৪টি বেঞ্চকে প্রাথমিকভাবে ৫ হাজার ১২২টি মামলা নিষ্পত্তি করতে দেয়া হয়। এর মধ্যে গত ২ থেকে ১১ জানুয়ারি হাইকোর্ট ২ হাজার ৬৮টি পুরনো মামলা নিষ্পত্তি করেছে বলে জানান তিনি।
এ ছাড়া নিম্ন আদালতের মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে বিচারকদের কর্মঘণ্টা পুরোপুরি ব্যবহারের বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রেখেছে বলেও জানান তিনি। সূত্র: যুগান্তর