ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের চিকিৎসক বিপ্লব কান্তি বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ইয়াবা বিক্রেতা এক আসামিকে অনৈতিক সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। চিকিৎসক বিপ্লবের সুপারিশ নিয়ে ওই ইয়াবা বিক্রেতা রোগী সেজে কারাগার থেকে হাসপাতালে গিয়েছেন। সেখানে বসেই ইয়াবা বেচাকেনা করেছেন। আবার হাসপাতালে বসেই জামিনের কাগজ জোগাড় করে সেই কাগজ দেখিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে গেছেন।
স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এর আগে কারাগারে থাকা কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে হাসাপাতালে পাঠানোর ক্ষেত্রে এই চিকিৎসক সুপারিশ করেছিলেন।
আন্তমন্ত্রণালয় তদন্তে কারাবন্দীকে সহযোগিতা করার অভিযোগে বিপ্লব কান্তি বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটির সুপারিশ মেনে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি এই চিকিৎসককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
এদিকে গতকাল মঙ্গলবার এক আদেশে চিকিৎসক বিপ্লবকে কারাগার থেকে সরিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। আজ বুধবার (৩ এপ্রিল) এ–সংক্রান্ত আদেশ জারি হওয়ার কথা রয়েছে।
কারা সূত্রে জানা গেছে, ইয়াবা বিক্রেতা ওই আসামির নাম মো. সাগর। ২০১৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ইয়াবাসহ তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি মিরপুর, বাড্ডাসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ইয়াবা বিক্রি করেন। কদমতলী থানার পুলিশ আদালতে হাজির করার পর আদালত তাঁকে কেরানীগঞ্জে অবস্থিত কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। কারাগারে যাওয়ার পর তিনি বুকে ব্যথার কথা বলে ২০১৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কারা চিকিৎসকের সুপারিশে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। ওই দিনই তাঁকে আবার কারাগারে আনা হয়। চিকিৎসা নিতে পুনরায় ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। চিকিৎসকের সুপারিশ নিয়ে সাগর ওই বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি চলে যান স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে তিনি মুঠোফোন ব্যবহার করে মাদক বেচাকেনা করেন। তার কয়েক দিন পর ৪ মার্চ তিনি নিজের জামিনের কাগজ কারা কর্তৃপক্ষকে দেখিয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে যান।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিষয়টি ভয়াবহ। আমরা ওই চিকিৎসকের দায়িত্বকালীন পুরো ইতিহাস খতিয়ে দেখব। এই চিকিৎসককে আমরা অসদাচরণের দায়ে অভিযুক্ত করেছি এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে তাঁর শাস্তির দাবি জানিয়ে চিঠি দিয়েছি।’
আন্তমন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, আসামি মো. সাগরের চিকিৎসাসংক্রান্ত কাগজপত্র পরীক্ষা করে, চিকিৎসকদের বক্তব্য নিয়ে এবং সাগরকে দেওয়া ওষুধের নাম দেখে তাঁর কোনো ধরনের অসুস্থতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাঁকে এ দুটি হাসপাতালে পাঠানোর দায় বিপ্লব কান্তি বিশ্বাসের। এ ঘটনায় বিপ্লবের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে জানায় তদন্ত কমিটি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি ইয়াবা বিক্রেতা সাগরকে হাসপাতালে পাঠানোর জন্য কোনো সুপারিশ করিনি। যেদিন সাগরকে হাসপাতালে পাঠানো হয়, সেদিন ছুটির দিন ছিল। তাই কে সুপারিশ করেছে, তার কোনো নথিপত্র কারাগারে পাওয়া যাচ্ছে না, যা খুবই অবাক হওয়ার বিষয়। এ ছাড়া সাগরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়েছেন সেখানকার চিকিৎসকেরা। এরপর নজিরবিহীনভাবে সাগর জামিনের কাগজ নিয়ে কারাগারে গিয়ে আবার সেই দিনই বেরিয়ে এসেছেন। তাই শুধু আমাকে দায়ী না করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত।’
বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস আরও বলেন, একজন আসামিকে হাসপাতালে পাঠানোর সব দায়িত্ব কারাগারের কারাধ্যক্ষ বা উপকারাধ্যক্ষের ওপর বর্তায়। তাঁদের কাছে এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া উচিত। এক প্রশ্নের জবাবে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাওয়ার কথা স্বীকার করে বিপ্লব বলেন, ‘জবাব দিয়েছি, দেখি কী হয়।’
কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কারাধ্যক্ষ মাহবুবুল ইসলাম বলেন, ‘এটা অনেক আগের ঘটনা। আমি বোধ হয় তখন ছিলাম না। তাই ঘটনাটি মনে নেই।’
কারাগারের নথি ঘেঁটে দেখা যায়, সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে অন্য হাসপাতালে নেওয়ার সুপারিশ করে থাকেন মূলত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের চিকিৎসক বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস। এর আগে বিভিন্ন সময়ে ইয়াবা ব্যবসায়ী আমিন হুদা, সাবেক সাংসদ আমানুর রহমান খান, শীর্ষ সন্ত্রাসী তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ ও ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীনসহ অনেককেই কারাগার থেকে হাসপাতালে পাঠানোর সুপারিশ করেছেন চিকিৎসক বিপ্লব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সব সময় এই কারা চিকিৎসক জানিয়েছেন, ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশেই তিনি এই কারাবন্দীদের হাসপাতালে পাঠানোর সুপারিশ করেছেন।