সহকারী জজ ছগির আহমেদ

চেক ডিজঅনার ও তার আইনগত প্রতিকার

ছগির আহমেদ : 

এই প্রবন্ধটিতে হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন, ১৮৮১ (Negotiable Instrument Act, 1881) এর আলোকে চেক ডিসঅনার ও তার আইনগত প্রতিকার সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব। এ সম্পর্কিত জটিল বিষয়গুলো ছোট-ছোট আলোচনার মাধ্যমে সহজবোধ্য করে উপস্থাপনের চেষ্টা করব। বর্তমান সময়ে আদালতে চেক ডিসঅনারের মামলা সবচেয়ে বেশি পরিমাণে হয়ে থাকে। তাই উক্ত বিষয়ে আইন শিক্ষার্থী, বিজ্ঞ আইনজীবী, আইনাঙ্গন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এমনকি জনসাধারনেরও সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। মূল আলোচনা শুরু করার পূর্বে চেক ও চেক ডিজঅনার বলতে কি বোঝায় সংক্ষেপে তা জেনে নেয়া যাক।

চেক হলো কোন নির্দিষ্ট ব্যাংক এর গ্রাহক কর্তৃক স্বাক্ষরিত এমন দলিল বা নির্দেশনামা যার দ্বারা কোন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান কে তথা উক্ত দলিলের বাহককে উক্ত দলিলে বা নির্দেশনামায় উল্লেখিত পরিমাণ অর্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক প্রদানে বাধ্য থাকে।

অপর্যাপ্ত তহবিল, ত্রুটিপূর্ণ স্বাক্ষর ও অন্য যে কোন যথাযথ কারনে বাহক কতৃক সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে জমা দেয়া চেক যদি প্রত্যাখ্যাত হয় বা চেকে উল্লেখিত টাকা বাহককে প্রদান করা সম্ভব না হয় সেটিকেই বলা হয় চেক ডিজঅনার। কোন কারনে চেক ডিজঅনার হলে চেক প্রদানকারীর বিরুদ্ধে হস্তারযোগ্য দলিল আইন, ১৮৮১ (Negotiable Instrument Act, 1881) অনুযায়ী আইনগত ব্যাবস্থা গ্রহনের সুযোগ রয়েছে।

হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনে সাধারণত চেকডিসঅনারের অভিযোগ ১৩৮ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়। এই ধরনের মামলা নালিশী মামলা হিসেবে গণ্য হয়। তার মানে চেকডিসঅনারের মামলা কখনো থানায় করা যায় না। এই ধরণের মামলা নালিশের মাধ্যমে সবসময় আদালতে দায়ের করতে হয়।

নালিশী মামলা বলতে বোঝায়, যে সকল মামলা থানায় এফ.আই.আর এর মাধ্যমে ফাইল না করে সরাসরি অভিযোগ দায়েরের মাধ্যমে আদালতে দাখিল করা হয় তাকে নালিশী মামলা বলে। নালিশী মামলায় ফরিয়াদীকে মামলার খরচ বহন করতে হবে। ফরিয়াদী মানে হল মামলার অভিযোগকারী ব্যক্তি।

যেসব কারণে চেক ডিসঅনারের (cheque dishonour) মামলা করা যায়:

  • ব্যাংকের হিসাবে অপর্যাপ্ত তহবিল বা অর্থ থাকলে। তার মানে চেকে যে পরিমান অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে তা অপেক্ষা কম অর্থ হিসাবে থাকা।
  • যে ব্যক্তি চেক প্রদান করেছে যদি তার স্বাক্ষর না মেলে।
  • যদি চেকে উল্লেখিত অর্থের অংক ও কথার গরমিল পাওয়া যায়।
  • চেক মেয়াদ উর্ত্তীণ হলে।
  • যথাযথভাবে চেক পূরণ করা না হলে।
  • চেকে ঘষামাজা করলে।
  • চেকে কাটাকাটি থাকলে পূর্ণ স্বাক্ষর দিয়ে তা সত্যকরণ করা না হলে।

চেকডিসঅনার হলে শাস্তি বা জরিমানা:
আইনানুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তি এক বছর পর্যন্ত কারাদন্ড, অথবা জরিমানা যা চেকে উল্লেখিত টাকার ৩ গুণ, অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

জেনে রাখা ভাল
হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ১৩৮(১) ধারায় চেক প্রত্যাখ্যাত হবার শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এখানে বলা আছে চেক ডিসঅনারের শাস্তি হল ১ বছরের কারাদন্ড অথবা চেকে উল্লেখিত টাকার ৩ গুন জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড। এখন কথা হল চেক ডিসঅনারের শাস্তি যদি চেকে উল্লেখিত টাকার ৩ গুন জরিমানা হয়, তাহলে টাকাটা কে পাবে? এক্ষেত্রে চেকগ্রহীতাকে তার দাবীকৃত টাকাটা পরিশোধ করে বাকী টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে চলে যাবে।

যে সময়কালের মধ্যে চেক নগদায়নের জন্য ব্যাংকে জমা দিতে হবে:

  • চেক ইস্যু করার তারিখ হতে ৬ মাসের মধ্যে অথবা
  • এর বৈধতা বিদ্যমান থাকাকালীন সময়ের মাঝে যেটা আগে ঘটে।

চেকডিসঅনার মামলা দায়েরের পূর্ব শর্ত:

  • সঠিক সময়ের মাঝে নগদায়নের জন্য চেক দাখিল।
  • চেক দাতাকে নোটিশ প্রদান। চেকটি অপরিশোধিত হয়ে ব্যাংক থেকে ফেরত আসার ৩০ দিনের মাঝে চেক দাতাকে নোটিশ দিতে হবে। নোটিশ প্রাপ্তির ৩০ দিনের মাঝে চেক দাতা চেকে উল্লখিত টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে তখন চেক গ্রহীতা মামলা করতে পারবে।

চেক ডিসঅনারের মামলায় বিচারযোগ্য আদালত:

দায়রা আদালতে চেকডিসঅনারের মামলার বিচার হয়ে থাকে। দায়রা আদালত নিম্নলিখিত জজদের অন্তর্ভূক্ত করবে। যথা:

  • দায়রা জজ।
  • অতিরিক্ত দায়রা জজ।
  • যুগ্ম দায়রা জজ।

চেক ডিসঅনারের মামলা করার কারন উদ্ভব:

(১) চেক দাতার নোটিশ প্রাপ্তির ৩০ দিন অতিবাহিত হলে।

(২) চেকে উল্লেখিত অর্থ পরিশোধ না করলে। পরবর্তী ৩০ দিনের মাঝে চেক ডিস অনারের মামলা করার কারন উদ্ভব হয়।

যে সময়কালের মধ্যে চেক ডিস অনারের মামলা করতে হবে:

চেক ডিসঅনারের অভিযোগ ১৩৮ সি অনুচ্ছেদের অধীন মামলা দায়ের করার কারন উদ্ভব হওয়ার তারিখ হতে এক মাসের মধ্যে দায়ের করতে হবে।

চেক ডিসঅনারের মামলা করার সময়সীমা:
চেকগ্রহীতা ব্যাংক থেকে চেকটি অপরিশোধিত হয়ে ফেরত এসেছে, তা জানার ৩০ দিনের মধ্যে চেক দাতাকে নোটিশ দিতে হবে। নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে চেকদাতা চেকগ্রহীতাকে টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে। পরবর্তী ১ মাসের মধ্যে চেকগ্রহীতা চেকদাতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারবে। তার মানে এখানে চেক ডিসঅনারের মামলা করার মোট সময় (৩০+৩০+৩০) = ৯০ দিন।

আপীল:

  • ১৩৮ ধারায় চেক ডিস অনার মামলায় প্রদও দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপীল করা যাবে।
  • ১৩৮ ধারায় প্রদও দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে কোথায় আপীল করা যাবে সে সম্পর্কে ১৩৮ থেকে ১৪১ ধারায় কিছু বলা হয়নি।
  • এক্ষেত্রে ফৌজদারী কার্যবিধির আপীলের বিধান প্রযোজ্য হবে।
  • ১৩৮ ধারায় প্রদও দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপীল করা যাবে দায়রা জজ অথবা হাইকোর্ট বিভাগে।

নোট: আপীল সম্পর্কে কিছু কথা বলে রাখা প্রয়োজন। হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনে আপীল সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। এক্ষেত্রে CrPC এর আপীলের বিধান কার্যকর হবে। চেক ডিসঅনারের মামলাটি যদি যুগ্ম দায়রা জজ কর্তৃক বিচার হয় তাহলে দায়রা জজের নিকট ৩০ দিনের মধ্যে আপীল করতে হবে। এক্ষেত্রে CrPC এর ৪০৮ ধারার আপীলের বিধানটি প্রযোজ্য হবে। এখানে বলা হয়েছে, যুগ্ম দায়রা জজের দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে দায়রা জজের নিকট আপীল করা যাবে।

অন্যদিকে চেক ডিসঅনারের মামলাটি যদি দায়রা জজ অথবা অতিরিক্ত দায়রা জজ কর্তৃক বিচার করা হয়, তাহলে ৬০ দিনের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে আপীল দায়ের করা যাবে। এক্ষেত্রে CrPC এর ৪১০ ধারার আপীলের বিধানটি প্রযোজ্য হবে। এখানে বলা হয়েছে, দায়রা জজ অথবা অতিরিক্ত দায়রা জজের দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে আপীল দায়ের করা যাবে।

পরিস্থিতি -১
যদি ১৩৮ ধারায় চেক ডিসঅনারের মামলাটি যুগ্ম দায়রা জজ কর্তৃক বিচার করা হয়। তাহলে ৩০ দিনের মাঝে দায়রা জজের নিকট আপীল দায়ের করতে হবে।

পরিস্থিতি -২
চেক ডিসঅনারের মামলাটি যদি দায়রা জজ কিংবা অতিরিক্ত দায়রা জজ কর্তৃক বিচার করা হয়। তাহলে ৬০ দিনের মাঝে হাইকোর্ট বিভাগে আপীল দায়ের করতে হবে।

আপীল দায়েরের পূর্বশর্ত:
চেক ডিসঅনারের মামলায় চেকে উল্লেখিত অর্থের সর্বনিম্ন ৫০% জমা দিয়ে আপীল দায়ের করতে হবে।চেক ডিসঅনারকৃত চেকের টাকার ৫০% টাকা যে আদালত শাস্তি সে আদালতে জমা দিয়ে আপীল দায়ের করতে হবে। তার মানে ৫০% টাকাটা বিচারিক আদালতে জমা দিতে হবে, আপীল আদালতে নয়।

রিভিশন দায়ের:
চেক ডিসঅনারের মামলায় রিভিশন দায়ের করা যায়। শুধুমাত্র আইনগত প্রশ্নে রিভিশন দায়ের করা যায়। এখানেও ফৌজদারী কার্যবিধির রিভিশনের বিধান প্রযোজ্য হবে। এখানে বলা হয়েছে, আইনগত প্রশ্নে রিভিশন দায়ের করা যায়। এখন কথা হলো আইনগত প্রশ্ন বলতে আমরা কি বুঝি? যেমন-ব্যাংক থেকে চেকটি অপরিশোধিত হয়ে আসার পর ৩০ দিনের মধ্যে চেকদাতাকে নোটিশ না দেয়া। এটাও একটা আইনগত প্রশ্ন। আবার মামলা করার কারণ আছে কিনা এটাও একটা আইনগত প্রশ্ন। মামলাটি তামাদিতে বারিত কিনা, এটাও একটা আইনগত প্রশ্ন।

(১) দায়রা আদালত(ধারা৪৩৯ক)

(২) হাইকোর্ট বিভাগ(ধারা ৪৩৯)

চেক গ্রহীতা কর্তৃক চেক দাতাকে নোটিশ দেওয়ার পদ্ধতি:

(১) ব্যক্তিগতভাবে।

(২) নিবন্ধিত পোস্টযোগে।

(৩) বাংলা জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ করে।

উপরোক্ত প্রবন্ধে চেক ডিসঅনার মামলা করার কারণ, আইনগত ভিত্তি এবং প্রতিকারের উপর একটা সাজানো আলোচনা করার চেষ্টা করা হয়েছে। তা থেকে পাঠক কিছুটা উপকৃত হলেও পরিশ্রম সার্থক হবে। ধন্যবাদ সবাইকে।

লেখক : সহকারী জজ, শরীয়তপুর জজ কোর্ট