মাহামুদ ওয়াজেদ:
খবরের কাগজ খুললেই দেশের কোথাও না কোথাও একাধিক নারী বা শিশু ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া নারী বা শিশুদের খবর আমাদের চোখে পড়ে। অফিস-আদালত,স্কুল-মাদ্রাসা, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, বাসা-বাড়ি এমনকি চলন্ত গাড়িতেও নারীরা আজ নিরাপদ নন। একজন নারী নির্যাতনের শিকার হবার পরে তার প্রথম চাওয়া থাকে সে যেন, তার সাথে ঘটে যাওয়া অপরাধের বিচার পান। সে জন্য ভিকটিম আইনের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ আইন প্রণয়নের পর থেকে সহজে ভিকটিম এই আইনে মামলা করতে পারেন। কিন্তু কখনো কখনো এই আইনের আশ্রয় নিতে গিয়ে তাকে আরো বেশি মানসিক যন্ত্রণার শিকার হতে হয়। যেমন মামলা দায়ের হবার পর উক্ত আইনের ২২ ধারা অনুসারে সাধারণত ভিকটিমের জবানবন্দি নেওয়ার বিধান আছে। উক্ত বিধান অনুসারে একজন পুরুষ ম্যাজিস্ট্রেট নারী ভিকটিমের জবানবন্দি গ্রহণ করতে পারেন। যা একজন নারী ভিকটিমের জন্য সম্পূর্ণ ঘটনার সঠিক বর্ণনা দেওয়া সত্যিই বিব্রতকর।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ২২ (১) ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের অধীন সংঘটিত কোন অপরাধের তদন্তকারী কোন পুলিশ কর্মকর্তা বা তদন্তকারী অন্যকোন ব্যক্তি কিংবা অকুস্থলে কোন আসামীকে ধৃত করার সময় কোন পুলিশ কর্মকর্তা যদি মনে করেন যে, ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বা ঘটনাটি নিজ চক্ষে দেখেছেন এমন কোন ব্যক্তির জবানবন্দি অপরাধের দ্রুত বিচারের স্বার্থে কোন ম্যাজিষ্ট্রেট কর্তৃক অবিলম্বে লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন, তাহলে তিনি কোন প্রথম শ্রেণির জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে উক্ত ব্যক্তির জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার জন্য লিখিতভাবে বা অন্য কোনভাবে অনুরোধ করতে পারবেন।
মুশকিল হচ্ছে এখানে শুধু প্রথম শ্রেনীর ম্যাজিস্ট্রেট শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে। তাই নারী ভিকটিমের জবানবন্দি যেকোন পুরুষ অথবা নারী ম্যাজিস্ট্রেট যে কেউ নিতে পারেন। এতদিন নারী ম্যাজিস্ট্রেট এর মাধ্যমে গ্রহণ করার কোন বাধ্যবাধকতা ছিলনা। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একজন পুরুষ ম্যাজিস্ট্রেট এই ২২ ধারার জবানবন্দি গ্রহণ করে থাকতেন।
কিন্তু কোনো মেয়েই দেখতে চান না ধর্ষণের মতো দুঃস্বপ্ন৷ তাই ধর্ষণের শিকার একজন নারী এতটাই লজ্জিত এবং আতঙ্কিত থাকেন, যে তিনি ধর্ষক সম্পর্কে কোনো কথা বলতে বা পুলিশের কাছে গিয়ে সে অভিজ্ঞতা বা ধর্ষক সম্পর্কে জানাতে ভয় পান৷ বিশেষকরে একজন মেয়ে তার শারীরিক বর্ণনা আরেকজন ছেলের কাছে কখনো খোলামেলাভাবে প্রকাশ করতে পারেননা। সুতরাং নারী ভিকটিমের জবানবন্দি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে নারী ম্যাজিস্ট্রেট অগ্রাধিকার দেওয়ার বিধানটি অনেক আগেই প্রয়োজন ছিল। দেরিতে হলেও সুপ্রিম কোর্টের নারী ভিকটিমের জবানবন্দি গ্রহণ করার প্রসঙ্গে দেওয়া নির্দেশনাটি প্রশংসার দাবী রাখে। এখানে উল্লেখ্য যে-
প্রধান বিচারপতির আদেশক্রমে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল ড. মো. জাকির হোসেনের স্বাক্ষরিত এ প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ বর্ণিত অপরাধ সংঘটনে ওয়াকিবহাল ব্যক্তির জবানবন্দি উক্ত আইনের ২২ ধারা অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করাহয়।
‘অপরাধের তদন্ত ও বিচারের স্বার্থে লিপিবদ্ধকৃত উক্ত জবানবন্দি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। বর্তমানে বেশকিছু ক্ষেত্রে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া নারী বা শিশুদের জবানবন্দি পুরুষ ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে। একজন পুরুষ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নারী বা শিশু ভিক্টিম ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের বর্ণনা দিতে সংকোচবোধ করে। ফলে এরূপ নির্যাতনের শিকার শিশু বা নারী ঘটনার প্রকৃত বিবরণ দিতে অনেক সময় ইতস্ততবোধ করে।’
‘এধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার নারী বা শিশুদের জবানবন্দি একজন নারী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক লিপিবদ্ধ করা আবশ্যক। এতে নারী ও শিশু ভিক্টিমরা সহজে ও নিঃসঙ্কোচে তাদের উপর নির্যাতনের বর্ণনা দিতে পারবে।’
‘এমতাস্থায়, সংঘটিত অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের স্বার্থে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার নারী বা শিশুদের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব একজন নারী ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট অর্পনের জন্য চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটগণকে নির্দেশিত হয়ে বিশেষভাবে অনুরোধ করাগেল।’
তবে সংশ্লিষ্ট জেলায় বা মহানগরীতে নারী ম্যাজিস্ট্রেট কর্মরত না থাকলে অন্যকোনো যোগ্য ম্যাজিস্ট্রেটকে উক্ত দায়িত্ব অর্পন করা যেতে পারে বলে সার্কুলারে উল্লেখ করা হয়।
এই সার্কুলারের নির্দেশনাবলী অনুসরণে কোনো সমস্যা বা অসুবিধা দেখা দিলে বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের নজরে আনার জন্যও বলা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশনার ফলে নিঃসন্দেহ নারী ভিকটিমদের জন্য কিছুটা হলেও বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে সহায়তা করবে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার হওয়া নারী ও শিশুর শারীরিক পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত ‘টুফিঙ্গারটেস্ট’ নিষিদ্ধ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছে, ধর্ষণ প্রমাণে শারীরিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে এই টেস্টের কোনও বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি নেই। পাঁচ বছর আগে অর্থাৎ ২০১৩ সালে দুই আঙুলের মাধ্যমে ধর্ষণ পরীক্ষা পদ্ধতির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ব্র্যাকসহ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা একটি রিট আবেদন করেন, উক্ত রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এই রায় দেন।
খুব শিঘ্রই সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারাটিরও সংশোধন চাই। ধারা- ১৫৫ (৪)-এ বলা হচ্ছে, ‘কোনো লোক যখন ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে সোপর্দ হয়, তখন দেখানো যেতে পারে যে, অভিযোগকারিণী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্র সম্পন্ন নারী।’
এই রকম আইনের বিধান একজন নারীর জন্য যথেষ্ট অসম্মানের। আমাদের মনে রাখা উচিৎ, ধর্ষণের ক্ষেত্রে কারোর ব্যক্তিগত চরিত্র অজুহাত হতে পারে না। তাই সাক্ষ্য আইনের এই বিধানটির ব্যপারেও বিজ্ঞ আদালতের সদয় দৃষ্টি আমরা কামনা করি। পাশাপাশি একজন নারী ভিকটিমের পাশে আমাদের নাগরিক দায়িত্বের অংশ হিসাবে দাঁড়ানো এবং যারা নারী নির্যাতনকারী তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলা উচিৎ।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।