মোঃ জোবায়ের :
বিবাহ একটি সামাজিক বন্ধন, যা দুজন ভিন্নধর্মী জেন্ডারের মধ্যে তাদের অনুগামী ধর্মের রীতি নীতি অনুসারে অনুষ্ঠিত। বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ, এদেশের অধিকাংশ মানুষ শরিয়া আইন অর্থাৎ ইসলামীক বিধি-বিধানের অনুসারী। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শরিয়া আইনের বিধান অনুসারে নিজেদের পরিচালিত করে থাকে; তেমনি ভাবে অন্য ধর্মের অনুগামীরাও তাদের ব্যক্তি জীবন নিজ ধর্মের বিধান অনুসারে পরিচালিত করে থাকে।
মানুষ যখন বিয়ে করে তখন তারা তাদের ধারণ করা ধর্মিয় বিধান মতে উক্ত বিবাহ সম্পন্ন করে; অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা ইসলামিক রীতি নীতি মতে, তেমনি ভাবে হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীরাও তাদের ব্যক্তিগত ধর্মের বিধান মতে নিজেদের মধ্যে বিবাহ সম্পন্ন করে।
নিজ ধর্মের রীতি নীতি ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোন ব্যক্তি যদি অন্য কোন ধর্মের নারী বা পুরুষকে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণিত আইনের বিধান অনুসারে বিয়ে করতে চায়, তখন উক্ত বিবাহকে বিশেষ বিবাহ বলা হয়। অর্থাৎ কোন মুসলিম পুরুষ (কিতাবিয়া মহিলা ব্যতীত) অন্য কোন ধর্মের নারীকে বিয়ে করতে চাইলে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণিত বিশেষ বিবাহ বা Special Marriage Act-1872 এর বিধান মতে বিবাহটি সম্পন্ন হবে,তখনি উক্ত বিবাহ বিশেষ বিবাহ বলে গন্য হবে।
বিশেষ বিবাহের পূর্ব শর্তসমূহ:
দুইটি ভিন্ন ধর্মে নারী-পুরুষ বিয়ে করতে চাইলে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন Special Marriage Act-1872 এর বিধান অনুসারে নিম্নোক্ত শর্তসমুহ পালন করা অবশ্যক:
তারা উভয় নোটারী বা প্রথম শ্রেণির গেজেটেড ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর উপস্থিত হয়ে এই মর্মে প্রত্যয়ণ করবেন যে, তারা কেউই কোন ধর্মের অনুসারী না , অর্থাৎ তারা কোন ধর্মেরই রীতি নীতি অনুযায়ী নিজেদেরকে পরিচালিত করেন না।
বি:দ্র: উক্ত প্রত্যয়ন কেবলই বিশেষ বিবাহ আইন অনুসারে বিবাহ সম্পন্ন করার জন্যই করে থাকবে; এর অর্থ এই নয় যে, তারা কোন ধর্মের অনুসারী না বা চিরদিনের জন্য তারা তাদের নিজ ধর্ম ত্যাগ করেছে!
তাদের উভয়কে সুস্থ মস্তিস্ক এবং প্রাপ্ত বয়স্ক হতে হবে অর্থাৎ পুরুষের ক্ষেত্রে ২১ বছর এবং নারীর ক্ষেত্রে ১৮ বছর।
বি: দ্র: তবে ২১ এবং ১৮ বছর সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বে বিয়ে করতে চাইলে অভিভাবকের সম্মতি নেয়া একান্ত আবশ্যক। তবে, Gregorian Calendar অনুসারে বিবাহ সম্পন্ন করার জন্য পুরুষের ক্ষেত্রে ১৮ বছর এবং নারীর ক্ষেত্রে ১৪ বছর হলে আইনত বিবাহটি বৈধ হবে।
বিবাহের পূর্বে তাদের কারোই স্বামী বা স্ত্রী বর্তমান থাকবে না, অর্থাৎ বিবাহের সময় স্বামী বা স্ত্রী বর্তমান থাকলে উক্ত আইন অনুসারে তারা কেউই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে না।
রক্ত সম্পর্কিয় বা অন্য কোন কারনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া আইনত বারিত।
বিবাহের পূর্বে বিশেষ বিবাহ নিবন্ধকের নিকট নোটিশ প্রদান করা এবং নোটিশ প্রদান করার পূর্বে কমপক্ষে ১৪ দিন বিবাহ নিবন্ধকের স্থানীয় এলাকায় তাদের দুজনের যে কেউ বসবাস করতে হবে।
বিশেষ বিবাহ আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ:
ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে বিশেষ বিবাহ আইন ১৮৭২ এর বিধান মতে বিবাহ সম্পন্ন হলে; পরবর্তীতে উভয় যদি মনে করেন যে,উক্ত বিবাহটি দীর্ঘায়ু করা তাদের পক্ষে সম্ভবপর হচ্ছে না তখনই উরাড়ৎপব অপঃ-১৮৬৯ এর বিধান মতে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন। এক্ষেত্রে পুরুষকে একচ্ছত্র অধিকার প্রদান করলেও নারীকে কত গুলি কারনের মধ্য দিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে হয়।
বিশেষ বিবাহে আপত্তি প্রদান:
নোটিশ প্রদান করার ১৪দিন পর যে কেও দেওয়ানী আদালতে মামলা দায়ের করার মাধ্যমে বিবাহের পূর্বে এই মর্মে আপত্তি উত্থাপন করতে পারবে যে, তাদের মধ্যে বিবাহটি সংঘটিত হলে বিশেষ বিবাহ আইন ১৮৭২ এ বর্ণিত শর্ত বা শর্ত সমুহের লঙ্গন হবে। তবে বিয়ে বন্ধ করার ক্ষেত্রে আপত্তি আইনত গ্রহনীয় নয়।
বিশেষ বিবাহ আইনে বহু বিবাহ:
কোন ব্যক্তির স্বামী বা স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে বিশেষ বিবাহ আনই অনুসারে উক্ত বিবাহটি আইন সীদ্ধ হয়নি বলে গন্য হবে এবং যা ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৪ ও ৪৯৫ ধারার বিধান মতে Offence of Bigamy.
বিশেষ বিবাহ আইনে উত্তরাধিকারী:
বিশেষ বিবাহ আইন অনুসারে কোন বিয়ে অনুষ্ঠিত হলে এবং বিয়ের পক্ষদ্বয়ের রেখে যাওয়া সম্পত্তি উত্তরাধিকারী আইন ১৯২৫ এর বিধান অনুসারে তাদের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বন্টন হবে। তবে, তাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি মৃত্যুর পূর্বে উইল বা টেস্টামেন্ট করে গেলে উক্ত আইনের বিধানাবলী প্রযোজ্য না হয়ে এক্ষেত্রে উইল বা টেস্টামেন্টের বিধানাবলী প্রযোজ্য হবে।
সুতরাং বিশেষ বিবাহ আইনে বিয়ে করতে চাইলে একজনকে মুসলিম হতেই হবে। তবে দুজনেই হিন্দু বা বৌদ্ধ হলে তারা নিজ ধর্ম বা বিশেষ বিবাহ আইন অনুসারে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেন। উক্ত আইনে দত্তক নেয়ার ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে।
লেখক : আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট।