বিচারকদের গাড়ি সুবিধা কেন চাই, কীভাবে চাই (পর্ব-১)

বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের গাড়ি সুবিধা কেন দরকার এবং কীভাবে এই সুবিধা সরকার নিশ্চিত করতে পারে সে বিষয়ে লিখেছেন একরামুল হক শামীম। নিবন্ধের প্রথম পর্বে বিচারকদের গাড়ি সুবিধার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।

পারস্যের বিখ্যাত কবি শেখ সাদির জীবনের গল্পটিতো রীতিমতো কিংবদন্তী। তিনি অতি সাধারণ পোশাকে দাওয়াতে গিয়েছিলেন বলে সমাদর পাননি ঠিকমতো। একইব্যক্তি যখন জাঁকালো পোশাকে গেলেন তখন আপ্যায়নের রোশনাই দেখে কে! যদিও এই জীবন গল্পের মোরাল হলো মানুষের মূল্যায়ন জরুরি, কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আমাদের সমাজ বাস্তবতা বলছে মানুষের সাথে তার চারপাশের অলঙ্কারকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। একজন ব্যক্তি যখন কোনো অনুষ্ঠানে গাড়িসহ যাবেন তার মূল্যায়ন নিসঃন্দেহে রিক্সায় করে যাওয়া অতিথির চেয়ে বেশি হবে।

বাংলাদেশের জুডিসিয়ারির ইতিহাসে বিখ্যাততম মামলা হিসেবে চিহ্নিত মাজদার হোসেন মামলার রায়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত উল্লেখ করেছেন, বিচারকগণ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের চেয়ে আলাদা। তারা সার্বভৌম বিচার ক্ষমতার প্রয়োগ করেন। (Secretary, Ministry of Finance Vs. Md. Masdar Hossain and others, 52 DLR (AD) 82 দ্রষ্টব্য) আমাদের আপিল বিভাগ চমৎকার ভাবে ভারতের অল ইন্ডিয়া জাজেজ অ্যাসোসিয়েশন মামলার সিদ্ধান্তের সংযোগ ঘটিয়েছেন। সেই রায়ে বলা হয়েছে- “The judicial service is not service in the sense of “employment”. The Judges are not the employees.  As members of the judiciary they exercise the sovereign judicial power of the State. They are holders of public offices same way as the members of the council of ministers and the members of the legislature. When it is said that in a democracy such as ours, the executive, the legislature and the and the judiciary constitute the three pillars of the State, what is inapplicable to intended to be conveyed is that the three essential functions of the State are entrusted to the three organs of the State and each one of them in turn represents the authority of the State. However, those who exercise the State power are the Ministers, the Legislators and the Judges, and not the members of their staff who implement or assist in implementing their decisions. The council of ministers on the political executive is different from the secretarial staff or the administrative executive which carries out the decisions of the political executive. Similarly, the Legislators are different from the legislative staff. So also the Judges from the judicial staff. The parity is between the political executive, the Legislators and the Judges and not between the Judges and the administrative executive. The Judges, at whatever level they may be, represent the State and its authority unlike the administrative executive or the members of the other services. The members of the other services, therefore cannot be placed on a par with the members of the judiciary, either constitutionally or functionally. Therefore, while determining the service conditions of the members of judiciary, a distinction can be made between them and the members of the other services.” (All India Judges Association and others vs. Union of India and others, (1993) 4 SCC 288)

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের থেকে অন্য অবস্থানে বিচারকগণের স্থান দেওয়ার মহৎ উদ্দেশ্য যেন কালক্রমে কাল হয়ে দাঁড়াল। যেহেতু বিচারকগণ আলাদা তাই তাদের এতো সুবিধার প্রয়োজন কেন? বিচারকগণ তো সীমাবদ্ধ জীবন যাপন করেন, বাসা থেকে অফিস, অফিস থেকে বাসা, অফিসে নথি, বাসায় নথি। কোথায় তাদের এতো সময় গাড়ি নিয়ে অনুষ্ঠানে যাওয়ার! বিচারকদের আবার গাড়ি লাগবে কেন? তাদের জীবনতো হওয়া উচিত সন্তুর মতো, খাবে দাবে, কাজ করবে আর ন্যায় বিচারের জন্য লড়াই চালাবে। জাগতিক মোহতাদের গ্রাস করবে কেন? দিনশেষে এতো সব মিথ তৈরি করা আমরা ভুলে যাই বিচারকও একজন রক্তে মাংসের মানুষ। তাদের পরিবার আছে, জাগতিক নানাবিধ চাহিদা আছে। মানুষ হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান পাওয়ার আকুতি কার মধ্যে না থাকে?

এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, গাড়ি সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অন্য অনেকের তুলনায় বিচারকগণ বরাবরই পিছিয়ে ছিলেন এবং আছেন। ১৯৮২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর যে পরিপত্র জারি করা হয় তার A-1 সংযুক্তিতে দেখা যায় ৬নং ক্রমিকে সিলেকশন গ্রেডের জেলা ও দায়রা জজগণকে সার্বক্ষণিক গাড়ির প্রাধিকার প্রদান করা হয়। (এস্টাব্লিশমেন্ট ম্যানুয়েল, ভলিয়ম-২, পৃষ্ঠা ৫৮৯) ১৯৮২ সালের ১২ ডিসেম্বরে জারী করা পরিপত্র থেকে দেখা যায় আরও কিছু পদের জন্য সার্বক্ষণিক গাড়ির সুবিধা নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু ১৪১ নং ক্রমিকে কেবল সিলেকশন গ্রেডের জেলা ও দায়রা জজগণকে সার্বক্ষণিক গাড়ির প্রাধিকার প্রদান করা হয়। (এস্টাব্লিশমেন্ট ম্যানুয়েল, ভলিয়ম-২, পৃষ্ঠা ৬১০) তখন কেবল সিলেকশন গ্রেডের জেলা ও দায়রা জজগণ সার্বক্ষণিক গাড়ির প্রাধিকার পেতেন। অথচ একইসময়ে সকল জেলা প্রশাসক সার্বক্ষণিক গাড়ির প্রাধিকার পেয়েছেন। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালের ২৮জুন জেলা জজদের অফিসিয়াল গাড়ি সুবিধার বিষয়ে একটি পরিপত্র জারী করা হয়।এতে উল্লেখ করা হয়, যেসব জেলা জজগণ সার্বক্ষণিক গাড়ি সুবিধা পান না তাদের অফিসিয়াল ব্যবহারের জন্য ডিসি পুল আলাদা গাড়ির (earmark transport) ব্যবস্থা করবে। জেলা জজগণ এই গাড়ি অফিসিয়াল দায়িত্ব পালনের নিমিত্ত প্রয়োজন অনুসারে রিকুইজিশনের ভিত্তিতে ব্যবহার করবেন। (এস্টাব্লিশমেন্ট ম্যানুয়েল, ভলিয়ম-২, পৃষ্ঠা ৫৬৫)

কালের পরিক্রমায় বর্তমানে সকল জেলা ও দায়রা জজগণ সার্বক্ষণিক গাড়ির প্রাধিকার পেয়েছেন। তবে জুডিসিয়াল সার্ভিসের সর্বোচ্চ পদের জন্য গাড়ি সুবিধা নিশ্চিতের নিমিত্ত জুডিসিয়ারির সংগ্রাম লক্ষণীয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারক হিসেবে কর্মরত জেলা জজ পদমর্যাদার অনেক বিচারক এখনও সার্বক্ষণিক গাড়ি সুবিধা পান না। তবু আশার সলতে টিকে আছে এই ভেবে যে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারকগণের জন্য ৪১টি গাড়ি এরইমধ্যে টিওএন্ডই-তে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। (প্রজ্ঞাপন নং ১০.০০.০০০০.১২৮.১৫.০০৫..২০১৫-৮৫৭, তারিখ ১৪/১২/২০১৭, বিচার শাখা-৪ আইন ও বিচার বিভাগ) একসময় হয়তো তা বাস্তবতায় রূপ নিবে। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সময়ে অবকাঠামোগত কিছু সুবিধার আত্মীকরণ হওয়ায় চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের সার্বক্ষণিক গাড়ির প্রাধিকার মিলেছে। তবে একইপদমর্যাদার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজগণ গাড়ি সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আশার কথা এই যে, ১২৮ জন অতিরিক্ত জেলা জজের গাড়ির প্রাধিকার টিওএন্ডই-তে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। (প্রজ্ঞাপন নং বিচার-৪/১ আর-১/২০০৮ (অংশ)-৩৫৪, তারিখ: ১১জুলাই ২০১৮, বিচার শাখা-৪, আইন ও বিচার বিভাগ)। পরবর্তীতে ১২৮টি গাড়ির ড্রাইভারের পদ সৃজন করা হয়েছে। (প্রজ্ঞাপন নং বিচার-৪/১ আর-১/২০০৮ (অংশ)-৪৮, বিচার শাখা-৪, আইন ও বিচার বিভাগ) সার্ভিসের ২য় সর্বোচ্চ পদ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজগণের জন্য সার্বক্ষণিক গাড়ির প্রাধিকার নিশ্চিতে জুডিসিয়ারিকে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়েছে। বিচার বিভাগপৃথকীকরণ সংক্রান্ত মাসদার হোসেন মামলায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য এবং অতিরিক্ত জেলা জজদের বিচারকালীন ঝুঁকি বিবেচনায় তাঁদের জন্য গাড়ি বরাদ্দের প্রস্তাব করে ২০১৪ সালের ২২ জুলাই আইন মন্ত্রণালয় ফাইল উত্থাপন করে। ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ওই প্রস্তাবে অসম্মতি জানিয়ে আইনমন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব তানিয়া ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ‘১২২ জন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজের জন্য ১২২টি গাড়ি টিওঅ্যান্ডইতে অন্তর্ভুক্তকরণ ও গাড়িচালকের পদ সৃজনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অসম্মতি নির্দেশক্রমে জ্ঞাপন করা হলো।’ (অতিরিক্ত জেলা জজরা গাড়ি পাচ্ছেন না, কালের কণ্ঠ, ২২ মার্চ, ২০১৫)

অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজগণের জন্য গাড়ির প্রাধিকার নিশ্চিত হওয়ার পর এখন গাড়ি ক্রয়ের বিষয়টি বাকি রয়েছে। এই কর্ম সম্পন্ন হলে সার্ভিসের ২য় ধাপ পর্যন্ত গাড়ি সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তবে জুডিসিয়ারি যখন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজগণের জন্য গাড়ি সুবিধা নিশ্চিতের সংগ্রামে নিমগ্ন তখন অন্যান্য সার্ভিস এগিয়ে গেছে বহুদূর। সময় এখন গাড়ি সেবা নগদায়নের। ২০১১ সালের ১৪মার্চ ‘প্রাধিকার প্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত বিশেষ অগ্রিম এবং গাড়ি সেবা নগদায়ন নীতিমালা ২০১১’ প্রজ্ঞাপন আকারে জারী করা হয়। এই নীতিমালার ২(গ) বিধিতে প্রাধিকার প্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে সরকারের যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব, বি.সি.এস (ইকোনমিক) ক্যাডারের যুগ্ম- প্রধান বা তদুর্ধ্ব কর্মকর্তাদের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। ৬(৪) বিধি অনুযায়ী এককালীন সুদমুক্ত অগ্রীম হিসেবে ১৬ লক্ষ টাকা প্রদানের বিধান রাখা হয়। ১০ বিধি অনুযায়ী মাসিক বেতন বিলের সাথে ৩০ হাজার টাকা বিশেষ ভাতা উত্তোলনের সুযোগ রাখা হয়। পরবর্তীতে ২০১২ সালের ২১ জুন ‘প্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত বিশেষ অগ্রিম এবং গাড়ি সেবা নগদায়ন নীতিমালা ২০১১ (সংশোধিত)’ প্রজ্ঞাপন আকারে জারী করা হয়। তাতে এককালীন সুদমুক্ত অগ্রীম ২০ লক্ষ টাকায় উন্নীত করা হয়। ২০১৪ সালের ১৭জুন ‘প্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত বিশেষ অগ্রিম এবং গাড়ি সেবা নগদায়ন নীতিমালা ২০১৪’ প্রজ্ঞাপন আকারে জারী করা হয়। তাতে প্রাধিকার প্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নতুন করে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের যুগ্ম-সচিব (ড্রাফটিং) থেকে তদুর্ধ্ব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অন্তর্ভূক্ত করা হয়।এককালীন সুদমুক্ত অগ্রীমের পরিমান ২৫ লক্ষ টাকায় উন্নীত করা হয় এবং গাড়ির ক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ভাতা ৪৫ হাজার টাকা করা হয়। ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি ‘প্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত বিশেষ অগ্রিম এবং গাড়িসেবা নগদায়ন নীতিমালা ২০১৪ (সংশোধিত)’ প্রজ্ঞাপন আকারে জারী করা হয়। ২০১৭ সালের ৩১ আগস্ট ‘প্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত বিশেষ অগ্রিম এবং গাড়িসেবা নগদায়ন নীতিমালা ২০১৪ (পুনঃসংশোধিত)’ প্রজ্ঞাপন আকারে জারী করা হয়। এতে গাড়ির ক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ভাতা ৫০ হাজার টাকা করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ২৫ জুলাই ‘প্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত বিশেষ অগ্রিম এবং গাড়িসেবা নগদায়ন নীতিমালা ২০১৮ (সংশোধিত)’ প্রজ্ঞাপন আকারে জারী করা হয়। এতে প্রাধিকার প্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নতুন করে উপ সচিবদের অন্তর্ভূক্ত করা হয়।

বর্তমানে সরকারের উপসচিব থেকে তদুর্ধ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ গাড়িসেবা নগদায়নের সুবিধা পেলেও জুডিসিয়াল সার্ভিসের সমপর্যায়ের সদস্যগণ এ থেকে বঞ্চিত। সাধারণত সার্ভিসের১০-১২বছরের মধ্যে প্রশাসন সার্ভিসের কর্মকর্তাগণ উপসচিব হচ্ছেন। সেখানে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসের ৩য় ব্যাচের কর্মকর্তাদের চাকরির মেয়াদ ১১ বছর এবং ৪র্থ ব্যাচের কর্মকর্তাদের চাকরির মেয়াদ ৯বছর। ৪র্থ ব্যাচ এখনও সিনিয়র সহকারী জজ হিসেবে কর্মরত।এই ব্যাচ যুগ্ম জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতি পেলেও আগামী ৪-৫ বছর যুগ্ম জেলা জজ হিসেবে কাজ করতে হবে। সেক্ষেত্রে সার্ভিসে চাকরির মেয়াদ ১৩-১৪ বছর হলেও উক্ত ব্যাচের কর্মকর্তাগণ গাড়ির প্রাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। ফলে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসের যুগ্ম জেলা জজ পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের জন্য গাড়িসেবা নগদায়ন সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি।

বিচারকগণের জন্য গাড়ির সুবিধা প্রয়োজন কল্যানকর রাষ্ট্রের স্বার্থেই। কারণ রাষ্ট্র বিচারকগণকে সম্মান প্রদর্শন করলে তা রাষ্ট্রের সফলতাকেই বিজ্ঞাপিত করে। ১৯৭২ সালে যখন আমাদের সংবিধান প্রণীত হয় তখন সংবিধানের ২য় পরিচ্ছেদে থাকা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি আদালতে বলবৎ যোগ্য করা হয়নি। গণপরিষদে এ নিয়ে সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত আপত্তি উত্থাপন করলে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য মোঃ আছাদুজ্জামান বলেছিলেন, বর্তমানে রাষ্ট্রের সক্ষমতা কম, রাষ্ট্রের সক্ষমতা তৈরি হলে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি আবশ্যিকভাবে সকলের জন্য নিশ্চিতকল্পে রিভিউ করা হবে। (গণপরিষদ বিতর্ক, ১৯৭২ দ্রষ্টব্য)  সময়ের পরিক্রমায় রাষ্ট্রের সক্ষমতা অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্র এখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর মতো মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছে। এর বাইরেও রাষ্ট্রের অনেক মেগা প্রজেক্ট চলমান রয়েছে। রাষ্ট্রের এমন সক্ষমতার নিরিখে ১৭০০ বিচারকের জন্য সার্বক্ষণিক গাড়ি সুবিধা প্রদান করা রাষ্ট্রের জন্য কষ্টকর হবেনা। এক্ষেত্রে প্রয়োজন আন্তরিকতার।

প্রাসঙ্গিকভাবে বিচারকগণের গাড়ি সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করা যায়। অল ইন্ডিয়া জাজেজ অ্যাসোসিয়েশন একটি রিট মামলা দায়ের করলে ১৯৯২ সালে ভারতের সুপ্রীম কোর্ট রায় প্রদান করে। তাতে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত বিচারকগণের গাড়ির সুবিধার ব্যাপারে উল্লেখ করেন-

“We shall now deal with the claim for transport. In most of the States the District Judge has been provided a motor car and in some of the States the Chief Judicial Magistrate is also provided with such transport, be it a car or jeep. There are still some States like Rajasthan, Haryana and Madhya Pradesh where provision of a car for every district judge has not yet been made. We direct that every District Judge should be provided with a car by March 31, 1992, and it shall be the obligation of the other States where such facility has not been provided to ensure the same within the time limit.

“The chief judicial magistrate is a touring officer apart from doing trial work as a magistrate. Mandate of the Code of Criminal Procedure requires him to undertake some touring. The quality of criminal justice administration would very much depend upon the mobility of the Chief Judicial Magistrate. We, therefore, direct that in such States and Union Territories where provision of independent transport for the Chief Judicial Magistrate has not been made, the same should be done by September, 30, 1992. We are further of the view that in stations with more than four judicial officers a common transport should be provided for the purpose of taking them from the residence to the Court and back and meeting their other official purposes and such vehicle should be placed under the control of the senior most officer in the pool. The arrangement should be that for every five officers, there should be a vehicle. Provision for this aspect should be made by March 31, 1993. This direction has become necessary as judicial officers should not be forced to travel along with litigants and lawyers. In many sensitive cases, records are carried by them. In some disturbed areas, instances of harassment to judicial officers taking advantage of their using common transport have come to light. We direct that every State and Union Territory would file a compliance report in the Registry of this Court in respect of these three aspects within one month from the expiry of the outer limit indicated for each of them.

(All India Judges’ Association v. Union of India, AIR 1992 SC 165=(1992) 1 SCC 119)

এই রায়ের প্রেক্ষিতে ভারত সরকার বিচারপতি জগন্নাথ শেঠির নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করে। এটি শেঠি কমিশন নামে সুপরিচিত।এই কমিশন ভারতের প্রথম ন্যাশনাল জুডিসিয়াল পে কমিশন। ১৯৯৯ সালের ১১ নভেম্বর শেঠি কমিশন প্রতিবেদন প্রদান করে। এই কমিশন বিচারকগণের গাড়ি সুবিধার ব্যাপারে যেসব সুপারিশ প্রদান করে সেগুলো হলো-

  1. (a) The existing system of providing independent vehicles to every Principal District Judge / Chief Judicial Magistrate / Chief Metropolitan Magistrate as directed by the Supreme Court must continue.

(b) Needless to state that the Principal Judge of City Civil Court in every city where City Civil Court has been constituted should be provided an independent vehicle.

(c) The Chief Judges of Small Causes Courts, who are in the cadre of District Judges, should be provided with independent vehicles.

(d) The First Additional District Judge and First Additional/Principal City Civil Court Judge should also be provided with an independent vehicle.

  1. Instead of one pool car for five Officers, it should be one pool car for a maximum of four Officers. That does not mean that there shall be no pool car if there is any station with less than 4 Officers. Indeed, if there are less than 4 Officers, it is but necessary to provide them also a pool car.
  2. If there is a lady Judicial Officer to be ferried in the pool car, she should be provided the front seat of the car.
  3. Since there is a complaint that 100 litres of petrol for pool car is found to be generally inadequate, we recommend 150 litres in Metropolitan cities and outside thereof 125 litres per month.
  4. We further recommend that the Judicial Officers may be allowed to utilise the pool car for their personal requirements when it is not on duty for Court purposes, at a rate of Rs.3.50 per K.M. This shall be properly arranged and supervised by the Principal District Judge or Chief Administrative Officer.
  5. The Judicial Officer who owns Car be given the following litres of petrol / diesel or equivalent price thereof in the type of city or location as mentioned here in below:

Type of City / Location

Ceiling limit of petrol /diesel (in Litres)

‘A’ and ‘A-1’

75

District Centre

The classification of cities on the basis of population criteria adopted by the respective States best suited to their local conditions referred to in the case of CCA be adopted for the purpose of conveyance allowance.

  1. The Judicial Officer who owns Scooter be given 25 litres of petrol or equivalent price thereof.
  2. The Judicial Officer who owns Car may be given the option to avail of the pool vehicle facility or petrol / diesel as aforesaid.
  3. The Judicial Officers may be given liberal soft loans with nominal interest as Motor Car Advance upto a ceiling of Rs.2.5 lakhs with convenient installments for repayment.
  4. As the number of Officers availing the pool vehicle facility decreases the excess number of poor vehicles shall be surrendered to High Court / State Government.
  5. The cadre of car drivers should be frozen and surplus drivers, if any, should be redeployed elsewhere and surplus vehicles should also be disposed of.

পরবর্তীতে ভারতের সুপ্রীম কোর্ট কিছু সংশোধন সাপেক্ষে ২০০২ সালের ২১ মার্চ শেঠি কমিশনের সুপারিশসমূহ গ্রহণ করে। [All India Judges’ Association v. Union of India, (2002) 4 SCC 247]

প্রসঙ্গত, একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, ভারত অনেকগুলোতে রাজ্যের সমন্বয়ে ঘটিত বিধায় এবং জেলা ব্যবস্থা রাজ্য সরকারের অন্তর্ভূক্ত থাকায় জেলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তাদের সুবিধার তারতাম্য থাকা স্বাভাবিক। তবে সংবিধানের ১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশ একটি একক প্রজাতন্ত্র। সংবিধানের ১১৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গঠিত অধস্তন আদালতের সর্বোচ্চ পদে রয়েছেন জেলা জজ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিচার কর্ম-বিভাগের সর্বোচ্চ পদধারীদের সুবিধা বেশি হবে। কেবল জেলার কর্মকর্তা হিসেবে জেলা জজগণকে দেখার সুযোগ নেই। সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত কাজের ধরণ অনুযায়ী জেলা জজগণ জেলা পর্যায়ে কাজ করেন।

তারপরেও জেলা পর্যায়ের জেলা প্রশাসকের অফিসের প্রাপ্ত সুবিধা থেকেও পিছিয়ে রয়েছে জেলার বিচারিক প্রতিষ্ঠান। জেলা প্রশাসকের কার্যায়ের যানবাহনের টিওএন্ডই পর্যালোচনা করলেই তা স্পষ্ট হবে। ২০১০ সালের ৪ এপ্রিল প্রজ্ঞাপন নং ০৫.১৩৯.০২৮.০১.০০.০০৫.২০১০-১১২ মূলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের যেসব সরঞ্জাম টিওএন্ডই-তে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে তাতে এ, বি ও সি ক্যাটাগরির জেলা উল্লেখ করা হয়েছে। তিনটি ক্যাটাগরিতেই গাড়ি সুবিধা সমান রাখা হয়েছে।

এ, বি ও সি ক্যাটাগরির জেলার প্রশাসকের কার্যালয়ের টিওএন্ডই-তে যেসব গাড়ি অন্তর্ভূক্ত রয়েছে সেগুলো হলো –

১. কার- ২টি

২. জীপ -৯টি, জেলা প্রশাসক ১টি, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ৫টি, ডিডিএলজি ১টি (আপগ্রেডেশন সাপেক্ষে), প্রটোকল ১টি, আইন-শৃঙ্খলা ১টি

৩. পিকআপ – ২টি (ডাবল কেবিন) মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, বিভিন্ন পরীক্ষা ও জাতীয় দিবসসমূহের মালামাল পরিবহন

৪. মাইক্রোবাস – ১টি অফিসারদের অফিসে যাতায়াতের জন্য।

(এস্টাব্লিশমেন্ট ম্যানুয়েল, ভলিয়ম-২, পৃষ্ঠা ৮৮১-৮৮৪)

উল্লেখিত তালিকাটি দেখলেই স্পষ্ট হবে জেলা পর্যায়ের বিচারিক প্রতিষ্ঠান গাড়ি সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কতোটা পিছিয়ে রয়েছে। বিচারপতিগণ জেলা পর্যায়ে গেলে তাদের প্রটোকল প্রদানের দায়িত্ব জেলার বিচারকগণের। অথচ প্রটোকলের জন্য জেলা বিচার বিভাগের কোনো গাড়ি নেই। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অথচ আইন-শৃঙ্খলা বাবদ জেলা বিচার বিভাগের কোনো গাড়ি নেই। ম্যাজিস্ট্রেটগণের সামারি কোর্ট পরিচালনার বিধান সিআরপিসিতে রয়েছে। তবে সামারি কোর্ট পরিচালনা বাবদ কোনো পিকআপ গাড়ি জেলা বিচার বিভাগের নেই।

লেখক : সংযুক্ত কর্মকর্তা (সহকারী জজ), আইন ও বিচার বিভাগ, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

চলবে …