বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের গাড়ি সুবিধা কেন দরকার এবং কীভাবে এই সুবিধা সরকার নিশ্চিত করতে পারে সে বিষয়ে লিখেছেন একরামুল হক শামীম। নিবন্ধের প্রথম পর্বে বিচারকদের গাড়ি সুবিধার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। আজ দ্বিতীয় ও শেষ পর্বে আলোচনা করা হয়েছে বিচারকদের গাড়ি সুবিধা কীভাবে নিশ্চিত করা যায় সে বিষয়ে।
বিচারকগণের জন্য গাড়ি সুবিধা কীভাবে চাই তা বোধগম্য করতে তিনটি পর্যায় উল্লেখ করা প্রয়োজন।
প্রাথমিক পর্যায়: গাড়ি সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রাধিকারের শতভাগ নিশ্চিত করা। এরমধ্যে রয়েছে-
ক. ৪১জন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারকের গাড়ি সুবিধা নিশ্চিত করা।
খ. ১২৮জন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজের গাড়ি সুবিধা নিশ্চিত করা।
গ. জেলা জজ আদালত ও সিজেএম আদালতের মাইক্রোবা সসংখ্যা বৃদ্ধি করা।
১৯৯৪ সালের ৮ মার্চ সরকারী দপ্তর/বিধিবদ্ধ ও স্বশাসিত সংস্থার যানবাহন মান-নির্ধারণ (স্ট্যান্ডারডাইজেশন) প্রসঙ্গে প্রজ্ঞাপন জারী করা হয়। তাতে মাইক্রোবাসের যে মান নির্ধারণ করা হয় তা নিম্নরূপ:
(ক) ৪ সিলিন্ডার বিশিষ্ট পেট্টোল চালিত ১৪০০-২০০০ সিসি ক্ষমতা সম্পন্ন ৯-১৫ আসন ৩-৫ দরজা বিশিষ্ট।
১৪০০ – ২০০০ সিসি (পেট্রোল)
১। টয়োটা
২। মিৎসুবিসি
৩। নিশান
৪। ইসুজু
(খ) ৪-৬ সিলিন্ডার বিশিষ্ট ডিজেল চালিত ১২-১৫ আসন বিশিষ্ট, ১৪০০-২৫০০ সিসি ক্ষমতা সম্পন্ন
১৪০০-২৫০০ সিসি (ডিজেল)
১। টয়োটা
২। মিৎসুবিসি
৩। ইসুজু
(এস্টাব্লিশমেন্ট ম্যানুয়েল, ভলিয়ম-২, পৃষ্ঠা ৬৪২)
উক্ত মান নির্ধারণ থেকে এটি স্পষ্ট হচ্ছে যে, মাইক্রোবাস সমূহের সর্বনিম্ন আসন ৯ ও সর্বোচ্চ আসন ১৫। বিচারকগণের নিরাপত্তার স্বার্থে গাড়িতে একজন পুলিশ সদস্যের উপস্থিতি প্রয়োজন। ড্রাইভারের জন্য একটি সিট তো থাকতেই হবে। এমতবস্থায় সর্বোচ্চ ১০জন বিচারকের জন্য একটি মাইক্রোবাসের মান-নির্ধারণ বিবেচনায় নিয়ে নতুন মাইক্রোবাস জেলা জজ ও সিজেএম এর কার্যালয়ের টিওএন্ডই-তে অন্তর্ভূক্ত করা প্রয়োজন।বর্তমানে অনেক জেলায় বিচারক সংখ্যা ১৫-২০ হলেও তাদের জন্য কেবল একটি মাইক্রোবাস রয়েছে। এক্ষেত্রে কাজের শুরুটা করতে হবে সংশ্লিষ্ট জেলা জজ ও সিজেএম কার্যালয় থেকে।
মাধ্যমিক পর্যায় : এ পর্যায়ে আরও কিছু পদের জন্য গাড়ি সুবিধা নিশ্চিতে উদ্যোগ গ্রহণ করা যায়।
ক. যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজগণ ও তদুর্ধ্ব পর্যায়ের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাগণকে প্রাধিকারভূক্ত কর্মকর্তার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করে গাড়ি সেবা নগদায়নের সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য ‘প্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত বিশেষ অগ্রিম এবং গাড়িসেবা নগদায়ন নীতিমালা ২০১৮ (সংশোধিত)’ এর ২(গ) বিধিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
খ. জেলার লিগ্যাল এইড কর্মকর্তাকে বিভিন্ন প্রয়োজনে উপজেলা পর্যায়ে যেতে হয়। উপজেলা লিগ্যাল এইড কমিটি ও ইউনিয়ন লিগ্যাল এইড কমিটির সঙ্গে সুষ্ঠু যোগাযোগের স্বার্থে জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তাগণের জন্য সার্বক্ষণিক গাড়ি সুবিধা নিশ্চিতে উদ্যোগ গ্রহণ করা যায়।
গ. আমাদের চৌকি আদালতগুলো বরাবরই অবহেলিত। চৌকি আদালতের বিচারকগণের জন্য সরকারি গাড়ির কোনো সুবিধা নেই। ফলে তাদেরকে রিক্সায় করে অফিসে যেতে হয়। এটি বিচারকের মর্যাদার সঙ্গে যুৎসই নয়। তাছাড়া চৌকি আদালতের বিচারকগণকে বিভিন্ন মিটিংয়ে অংশগ্রহণের জন্য জেলা সদরে যেতে হয়। চৌকি আদালতের বিচারকগণ উপজেলা পর্যায়ের সর্বোচ্চ বিচারিক কর্মকর্তা। সামগ্রিক বিষয়ে বিবেচনায় নিয়ে চৌকি আদালতের বিচারকগণের জন্য সার্বক্ষণিক গাড়ি সুবিধা নিশ্চিতে উদ্যোগ গ্রহণ করা যায়।
ঘ. প্রটোকল প্রদানের স্বার্থে জেলা জজের টিওএন্ডই-তে একটি জিপ গাড়ি অন্তর্ভূক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা যায়।
ঙ. আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে সিজেএম/সিএমএমএর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাছাড়া সিজেএম/সিএমএমকে সিআরআরও অনুযায়ী থানা পরিদর্শন করতে হয়। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সিজেএম/সিএমএম এর টিওএন্ডই-তে একটি জিপ গাড়ি অন্তর্ভূক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা যায়।
চ. সামারি কোর্ট পরিচালনার জন্য সিজেএম/সিএমএম এর টিওএন্ডই- তে দুইটি পিকআপ গাড়ি অন্তর্ভূক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা যায়।
ছ. জেলা জজ ও সিজেএম/সিএমএম এর অধীনে গাড়ির পুল তৈরি করা যেতে পারে। তখন ভারতের মতো প্রতি ৫জন বিচারকের জন্য একটি করে পুলের গাড়ি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
জ. সিনিয়র সহকারী জজ ও সহকারী জজগণের জন্য সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে গাড়িক্রয়ের জন্য ঋণ সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ভারতের মতো গাড়ির ক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশেষ জ্বালানী ভাতার প্রবর্তন করা যেতে পারে।
ঝ. নির্বাচন সংক্রান্ত কাজে গাড়ির জন্য জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রশাসনের উপর নির্ভর করতে হয়। এই অবস্থা থেকে পরিত্রান পেতে অস্থাবর সম্পত্তি হুকুম দখল আইন, ১৯৮৮ এর ৩(১) ধারায় সংশোধন করে সিজেএম/সিএমএম-দের গাড়ি রিকুইজিশনের ক্ষমতা প্রদান করা যায়।
ঞ. বিচারকগণ যেন ব্যক্তিগত চিকিৎসার কাজে পুলের গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন সেই সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
চূড়ান্ত পর্যায় : এ পর্যায়ে সকল পর্যায়ের বিচারকগণের জন্য গাড়ি সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। ২য় পর্যায়ের কাজ সম্পন্ন হলে যুগ্ম জেলা জজ পদ পর্যন্ত গাড়ি সুবিধা নিশ্চিত হবে। তারপর বাকি থাকবে সহকারী জজ ও সিনিয়র সহকারী জজগন। প্রশাসন সার্ভিসে ইউএনও সার্বক্ষণিক গাড়ির প্রাধিকার পেয়েছেন। সম পরিমান সার্ভিস-সময় বিবেচনায় সিনিয়র সহকারী জজগণও গাড়ি সুবিধা পেতে পারেন। এসিল্যান্ডগণ গাড়ির সুবিধা পেয়েছেন। সম-পরিমান সার্ভিস-সময় বিবেচনায় সহকারী জজগণ গাড়ি সুবিধা পেতে পারেন। উল্লেখ্য সিপিসি ও সিআরপিসির বিধান অনুযায়ী স্থানীয় পরিদর্শনের সুযোগ সহকারী জজ/জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের রয়েছে। এই বিষয় বিবেচনায় নিয়ে গাড়ি সুবিধা নিশ্চিতে কাজ করা উচিত।
বাংলাদেশ সরকারের সপ্তম পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে, “Besides, there must vehicle facilities for all judges in every tire to ensure their safety of transportation and movement.” (7th Five Year Plan, Page- 160)
বিচারকগণ দাবী আদায়ে রাস্তায় মিছিল মিটিং করে না। আমরা কেবল সরকারের সপ্তম পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনায় উল্লেখিত অঙ্গীকারের কথা মনে করিয়ে দিতে পারি।
লেখক : সংযুক্ত কর্মকর্তা (সহকারী জজ), আইন ও বিচার বিভাগ, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
আরও পড়ুন : বিচারকদের গাড়ি সুবিধা কেন চাই, কীভাবে চাই (পর্ব-১)