চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক :
‘একবার এক আমেরিকান চিত্রকারের শখ হল উনি যীশুর ছবি আঁকবেন। যীশু, খ্রিষ্টান ধর্মের প্রবর্তক। আর যীশু মানে তো যেন তেন লোক নয়, একেবারে নিষ্পাপ একজন। তাই, তার মডেলও হতে হবে একে বারে নিষ্পাপ চেহারার কেউ একজন। স্বাভাবিকভাবেই নিষ্পাপ ধরে নেওয়া হয় অবুঝ শিশুদেরকে, যারা পৃথিবীর কঠিন জালে নিজেদের এখনো আটকায়নি, কলঙ্কিত পরিবেশে গাঁ ভাসায় নি। চিত্রকারও তাই করলেন। পুরো শহরে সকল বাচ্চাদের পরখ করা শুরু করলেন। নিষ্পাপদের মধ্যে অধিকতর নিস্পাপের খোঁজে। অনেক খোঁজা খুঁজির পর চিত্রকার পেয়ে গেলেন তার কাক্সিক্ষত যীশুকে, অর্থাৎ যীশুর মডেলকে। বাচ্চাটির বাবা-মা তো ভীষণ খুশী, তাদের সন্তান হতে যাচ্ছে যীশুর মডেল,যার ছবি কিনা সকল খ্রিষ্টানদের ঘরের দেয়ালে সোভা পেতে পারে। যথারীতি যীশুর মডেলকে সামনে রেখে চিত্রকার এঁকে ফেললেন যীশুর ছবি। নিষ্পাপ শিশুর ছবি যতটা নিষ্পাপ হওয়ার কথা তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশী নিষ্পাপ দেখাচ্ছিল ছবিটি। কে জানে হয়ত যীশুর মডেল বলে আধ্যাত্মিক কিছু ছিল ছবিটিতে। যাই হোক, পুরো আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ল ছবিটি, সাথে চিত্রকারের খ্যাতি। সব মিলিয়ে রাতারাতি চিত্রকার বিখ্যাত হয়ে পড়লেন পুরো আমেরিকায়।
এরপর, আরো অনেক ছবি আঁকলেন চিত্রকার। তারপর, অনেক বছর পর ঐ চিত্রকারের আবার শখ হল, জুডাসের ছবি আঁকার। যথারীতি নেমে পড়লেন মডেল খোঁজার কাজে। শয়তানের মডেল হতে হবে খুবই বীভৎস এবং ভয়ংকর চেহারার যাকে দেখেই মানুষের মনে একটা ঘৃণা জন্মাবে। কিন্তু, এবার তো মহাবিপদ। বীভৎস এবং ভয়ংকর চেহারার যাকেই শয়তানের মডেল হওয়ার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে সেই চিত্রকারকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। কেই বা চায় শয়তানের মডেল হতে, আপনি চাইবেন? চিত্রকার মডেল খুঁজতে খুঁজতে হতাশ। তারপরও হাল ছাড়লেন না। আরেকদিন চিত্রকার মডেল খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে একটি শুঁড়িখানার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ তার সামনে দিয়ে একটা বীভৎস এবং ভয়ংকর চেহারার লোক শুঁড়িখানা থেকে দৌড়ে বের হয়ে সামনে যেতে লাগল। চিত্রকার তো মহা খুশী, মনে মনে বলতে লাগলেন, ‘আরে আমি তো একেই খুঁজছি’। তখন চিত্রকার ঐ বীভৎস এবং ভয়ংকর চেহারার লোকটিকে ডাকলেন এবং পিছু পিছু ছুটলেন। অনেক দূর যাওয়ার পর চিত্রকার ঐ লোকের নাগাল পেল এবং শয়তানের মডেল হওয়ার জন্য প্রস্তাব দিল। বীভৎস এবং ভয়ংকর চেহারার সামনে চিত্রকার মনে মনে ভয়ই পাচ্ছিলেন। যেখানে কেউই শয়তানের মডেল হতে রাজি হচ্ছিল না, সেখানে ঐ লোকটি কিছু একটা চিন্তা করে চিত্রকারকে অবাক করে দিয়ে রাজি হয়ে গেল। চিত্রকার ভয় কাটিয়ে এখন খুশীতে আত্নহারা।
মডেলকে নিয়ে গেলেন নিজের বাসায়। মডেলকে সামনে বসিয়ে চিত্রকার শুরু করলেন ছবি আঁকা। চিত্রকার এঁকে চলেছেন শয়তানের ছবি। ছবি আঁকতে আঁকতে হঠাৎ চিত্রকার খেয়াল করল মডেলের চোখে জল, অর্থাৎ শয়তান কাঁদছে। চিত্রকার অবাক হয়ে যখন মডেলকে কাঁদার কারন জিজ্ঞাসা করল, তখন মডেল যা বলল তা আমার আপনার দুই জনেরই সহ্যসীমা এবং চিন্তাসীমার বাহিরে। মডেল কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমিই সেই ছেলে যে কিনা ১২ বছর আগে আপনার যীশুর মডেল হয়েছিলাম আর আজ আমি জুডাসের মডেল; পরিবেশ মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়, তাই না?’
ঠিক তাই, পরিবেশ মানুষকে যীশুর মডেল থেকে জুডাসের মডেলে পরিণত করতে পারে। আর এই পরিবেশকে সুন্দর সাবলীল রাখতেই চাই আইনের শাসন এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ। কিন্তু, বিপত্তি হচ্ছে পরিবেশ বা সমাজের প্রয়োজনেই যে আইন তৈরি হয়েছে, এটা বুঝানোই যত মুশকিল। সাধারণ মানুষের ধারনা, আইন হচ্ছে আইনের ছাত্র,আইনজীবী এবং বিচারকদের বিষয়; অথচ আইন যে প্রতিটি মানুষের জীবনে জরুরী তা তারা বুঝতে অপারগ।
জন্মের পর জন্মসনদ আর মৃত্যুর পর মৃত্যুসনদ এই দুই আইনি প্রক্রিয়া যখন চলে তখন ঐ মানুষটির পৃথিবীর কোনো কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু বুঝার বা জানার মত পরিস্থিতিতে থাকেন না। দুনিয়াতে মাত্র এসেই এবং দুনিয়া থেকে চলে গিয়েও যেখানে আইনের চক্রে আবদ্ধ, সেখানে দুনিয়াতে বেঁচে থাকাবস্থায় চলতে ফিরতে প্রতি কদমে কদমে আইনের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কোনো ব্যক্তি কোনোরূপ আইনি ঝামেলায় জড়াতে না চাইলেও নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে জানতে এবং অধিকার আদায়ের জন্য হলেও যে আইন জানতে হবে অন্তত এতটুকু বুঝা একজন মানুষের অবশ্য কর্তব্য।
উদাহরণস্বরূপ, ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, এটা আমরা সকলেই জানি কেননা সিগারেটের প্যাকেটের গায়েই লেখা থাকে এটা। কিন্তু বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, প্রকাশ্যে ধূমপান করলে ৩০০ টাকা জরিমানা। এই বিধানটা বাংলাদেশের ১০ শতাংশ মানুষ জানে কিনা সন্দেহ। এমনকি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী যারা এই আইন বাস্তবায়ন করে জরিমানা আদায় করবেন, তাদেরই বা কয়জন জানেন বা মানেন তাও আমাদের বোধগম্য নয়। এখানে কোনো পক্ষকেই প্রত্যক্ষভাবে দোষারোপ করা যায় না। কেননা, বাংলাদেশ তথা গোটা ভারতীয় উপমহাদেশেই আইন শিক্ষার পরিধিটা কেবলমাত্র আইনজীবী এবং আইন পেশায় জড়িত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে। আইন শিক্ষা, না আশ্রয় পেয়েছে আমাদের মৌলিক শিক্ষা ব্যবস্থায়, না আধুনিক গণমাধ্যম ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে সরকার আইন শিক্ষাকে দেশের সর্বত্র পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করছে। আইন না জানাটাই আইন না মানার প্রধান কারন না হলেও উল্লেখযোগ্য কারন বললে ভুল হবে না।
বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন যে, ‘সমাজ কখনো খারাপ মানুষের খারাপ কাজের জন্য ধ্বংস হয় না, সমাজ ধ্বংস হয় ভালো মানুষদের নীরবতার কারনে’। তাই এই ভালো মানুষগুলোকেই সর্বপ্রথম আইন জানতে হবে। যখনই আইন সম্পর্কে জানবে কেবল তখনই এর লঙ্ঘন হলো কি না তা বুঝা যাবে, বুঝতে পারবে এর প্রতিবাদ করা উচিত কিনা, বুঝতে পারবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কী প্রয়োজন?
দেশের জনগণকে আইন জানানোটা সরকারী মহল থেকে শুরু করে গণমাধ্যমেরও একটি গুরু দায়িত্ব, কিন্তু সেই দিক থেকে বাংলাদেশে আইন না জানা মানুষের সংখ্যা শুধু সিংহ ভাগই নয় বরং একটি নির্দিষ্ট মহল ছাড়া কেউই আইন সম্বন্ধে জানতে উৎসাহী নন। আইন যেখানে সাহিত্যের মত একটি রসালো বিষয়, সেখানে আইনকে জনগণের সামনে তেঁতো করে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যার ফলে জনগণ উৎসাহ হারিয়ে আইনকে ভয় পেয়ে এর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু, এই আইন না জানাটাও যে এক ধরণের অপরাধ সেটা আমাদের জানা উচিত। কেননা, ‘আদালত সবসময় ধরেই নেয় যে, দেশের সকল মানুষ আইন জানেন’। যখন কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের অভিযোগ উত্থাপিত হয়, তখন আদালত ধরেই নেন যে উক্ত ব্যক্তিটি জানেন তার কাজটি একটি অপরাধ, এবার অভিযুক্ত ব্যক্তিটি আইন জানুক অথবা না জানুক। কেননা, আদালত ধরেই নেন যে, দেশের প্রতিটি মানুষ দেশের প্রচলিত আইন সম্বন্ধে অবগত।
‘না জেনে পাপ করলে, মাফ করেন সৃষ্টিকর্তা’- আমাদের ধর্মমতে আমরা এটা বিশ্বাস করি। সৃষ্টিকর্তা অন্তর্যামী, তাই তিনি জানেন কে জেনে পাপ করেছে আর কে না জেনে ভুল করেছে। আদালত যেহেতু মানব পরিচালিত তাই অন্তরের পরিস্থিতি না জেনেই, ধরে নিবে যে আইন জানে এবং সে হিসেবেই বিচার করবেন। তাই, আমাদের প্রত্যেকেই নিজ দায়িত্বে আইন জানা উচিত এবং আইন মানা উচিত।
লেখক: আইন শিক্ষার্থী