মিজানুর রহমান খান:
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ গত ডিসেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট দিবসের বাণীতে বলেছিলেন, ‘জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) অন্যতম লক্ষ্য ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার। এটা অর্জনে সকলকে আইনের আশ্রয় লাভসহ ন্যায়বিচার দিতে হবে।’ দ্রুত বিচার মানেই ন্যায়বিচার নয়, তবে এখন বিচারই অধরা।
গত ২৭ এপ্রিল প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বিচারকের অপর্যাপ্ততাকে মামলাজটের জন্য দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ১০ লাখ মানুষের সেবায় ১০ বিচারক। অথচ এই হার যুক্তরাষ্ট্রে ১০৭, কানাডায় ৭৫, ব্রিটেনে ৫১, অস্ট্রেলিয়ায় ৪১ এবং ভারতে ১৮।’ অবশ্যই ওই সব দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থা শোচনীয়। পুলিশ ও আদালত প্রশাসনের দুর্নীতিগ্রস্ততা, ক্ষমতার অপব্যবহার, অপশাসনে অন্যদের সঙ্গে তুলনা চলে না।
বিচারকস্বল্পতায় প্রধান বিচারপতির উদ্বেগ অবশ্যই যথার্থ। প্রধান বিচারপতি মামলার অনুপাতে বিচারকস্বল্পতা এবং অবকাঠামোগত মৌলিক সুবিধাদির অপ্রতুলতাকে মামলাজটের জন্য দায়ী করেন। এর মধ্যে বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের ঠিকুজি পরখ করা পড়ে কি না জানি না, তবে মেধাক্রমে ওপরে থেকেও ত-দন্তে (কার কী রাজনৈতিক ঠিকুজি) আটকে যাচ্ছে। কারণ, প্রার্থীদের কারও বাবা নাকি বিএনপির লোক, কারও ভাই চাকরি করেন ইসলামী ব্যাংকে।
২০১৪ সালে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আইন কমিশন নিম্ন আদালতের মামলার সংখ্যা ২৮ লাখ থাকতে মামলাজট কমাতে অন্তত ৩ হাজার বিচারক নিয়োগের সুপারিশ করেছিলেন। পাঁচ বছর আগে সরকারকে দেওয়া ওই প্রতিবেদনে মাত্র ১ হাজার ৭০০ বিচারক দিয়ে ২৮ লাখ মামলা নিষ্পত্তি ‘একেবারেই অপ্রতুল’ বলে মন্তব্য করেছিল আইন কমিশন। গত পাঁচ বছরে নিম্ন আদালতে ৩ হাজারের পরিবর্তে নতুন বিচারক নিয়োগ পেয়েছেন মাত্র ১১৯ জন। বিচারক নিয়োগকারী স্বাধীন সংস্থা বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের (বিজেএসসি) কার্যক্রমে আমরা সন্তুষ্ট।
কিন্তু তাদেরই সুপারিশ করা ১৫ তম ব্যাচের আটজন কেন ‘নির্বাহী তদন্তে’ আটকে যাবেন, তার স্বচ্ছতা মূল্যায়ন করার এখতিয়ার স্বাধীন সংস্থাটির থাকা উচিত। তদন্তে বিচারিক হাকিমের সম্পৃক্ততা একটি উত্তর হতে পারে কি না, সেটা বড় প্রশ্ন। কারণ, বুঝতে পারি, গোয়েন্দা তদন্ত প্রতিবেদন বিচারক নিয়োগ-প্রক্রিয়ার গতি মন্থর করে দিচ্ছে। বর্তমানে গোয়েন্দা রিপোর্টই চূড়ান্ত, কিন্তু তা ১০ বিচারকের মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় পরিপন্থী। সুপারিশপ্রাপ্তের ‘পূর্ব বৃত্তান্ত’ অবশ্যই বিজেএসসি দ্বারা যাচাইয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দীর্ঘদিন ৩৫ থেকে ৩৮ লাখের মধ্যে ছিল। ২০১৮ সালের সুপ্রিম কোর্টের নতুন প্রতিবেদন (গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত) বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এটা ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সাড়ে ৩৯ লাখ ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে চলমান থাকা দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা প্রায় সাড়ে ৫ লাখ। ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর আপিল বিভাগে প্রায় সাড়ে ২০ হাজার ও হাইকোর্টে সোয়া ৫ লাখের বেশি মামলা হয়। এতে বিচারক ও মামলার অনুপাত দাঁড়ায় আপিল বিভাগে ১: ৩৩১৩ এবং হাইকোর্টে ১: ৫৩৫৬। হাইকোর্টের বিচারপতিরাই মামলার ভারে সবচেয়ে বেশি জবুথবু। নিম্ন আদালতের বিচারক ও মামলার অনুপাত ১: ১৯৯৬।
এদিকে আদালতের বাইরে বিরোধ মীমাংসা, দরিদ্রদের আইনি সহায়তা এবং অনধিক দুই বছর মেয়াদে প্রথম দণ্ডিতদের জেলের পরিবর্তে তাঁদের বাইরে রাখার মতো পদক্ষেপগুলোতে গতি আসছে না। এর কারণ অনুসন্ধান ও দরকারি সুপারিশ দরকার। এটা সুখের বিষয় যে সরকার দীর্ঘদিন পরে আট সদস্যের একটি সুপ্রিম কোর্ট সেল গঠনে লোকবল অনুমোদন করেছে।
দেশের বিচার বিভাগীয় ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গত জানুয়ারিতে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন মামলাজট কমাতে একটি বিশেষ প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেন। তিনি হাইকোর্টের ১২টি দ্বৈত বেঞ্চকে প্রতি বৃহস্পতিবার শুধু পুরোনো মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। গত তিন মাসে ৩০ হাজারের বেশি মামলা কমে গেছে। এর মানে দাঁড়ায় শুধু সুষ্ঠু মামলা ব্যবস্থাপনা দিয়েও একটা পরিবর্তন আনা সম্ভব।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৮-এর অধীনে ওই মামলাগুলো জামিনসংক্রান্ত এবং তা ‘কারিগরি’ কারণে পড়ে ছিল। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ সম্প্রতি এক দিনে ১ হাজার ১২টি জামিনের মামলা নিষ্পত্তি করেন। হাইকোর্টের ওই একই বেঞ্চ গত ৪ ফেব্রুয়ারি আরও একটি ব্যতিক্রমী আদেশ দেন। মাদারীপুরের একটি মাদক মামলার (২০১৫) আসামিকে জামিনদানের আদেশে হাইকোর্ট ১৯৯০ সালের মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে সারা দেশে দায়ের হওয়া ১০ বছরের পুরোনো মামলা ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির আদেশ দেন। কিন্তু তাতে গতি নেই। উপরন্তু ২০১৮ সালের নভেম্বরে নতুন মাদক আইন কার্যকর হওয়ার পরে সারা দেশে দায়ের হওয়া মাদক মামলার বিচার স্তব্ধ। কারণ, আইন বলেছে, মাদক মামলা ট্রাইব্যুনালেই চলবে। আর এই মুহূর্তে দুঃখজনকভাবে কোনো মাদক ট্রাইব্যুনাল নেই, কারণ তা গঠনই করা হয়নি। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সপ্তাহ দুয়েক আগে হাইকোর্টকে বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে আদালতের উদ্বেগ তিনি সরকারকে অবগত করেছেন।
সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ মতে অধস্তন আদালত নিয়ন্ত্রণ করবেন হাইকোর্ট। তবে এই প্রথম দেখলাম হাইকোর্ট ১০৯ অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে ওই নির্দেশনা দিলেন, একে স্বাগত জানাই। গত ফেব্রুয়ারিতেই দেওয়া আরেকটি আদেশে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ১০ বছরের পুরোনো মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তির নির্দেশনা দিয়েছিলেন। জ্যেষ্ঠ আইনবিদ আমীর-উল ইসলাম মনে করেন, হাইকোর্টকেই নেতৃত্ব দিতে হবে, এ জন্য তাঁর একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় থাকতে হবে।
আগেই বলেছি, হাইকোর্টের বিচারকদের ওপর চাপ বেশি। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীনের সঙ্গে কথা বলি। তাঁর কথায়, মানুষকে ন্যায়বিচার দিতে হবে। মূল সমস্যা হলো সারা দেশে অহেতুক মামলা করার চলমান প্রবণতা বন্ধ করা। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, নিম্ন আদালত যদি যথাদায়িত্ব পালন করেন তাহলে হাইকোর্টের ওপর এত চাপ পড়ে না।
গত ৮ এপ্রিল জয়নুল আবেদীন হাইকোর্টে একটি মামলা পরিচালনা করেছিলেন। নিয়ম হলো হাকিম জামিনের দরখাস্ত নাকচ করলে তার বিরুদ্ধে জজ আদালতে আপিল হবে। সেখানেও তা নামঞ্জুর হলে অভিযুক্ত ব্যক্তি হাইকোর্টে আসতে পারবেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আপিলের শুনানির তারিখ পড়ে দুই মাস পরে। হাইকোর্ট ওই জামিনের দরখাস্ত এক সপ্তাহের মধ্যে শোনার আদেশ দেন। নিম্ন আদালত যদি ফেলে না রেখে জামিন দেবেন কি দেবেন না, সেটা সুরাহা করতেন, তাহলে আসামি হাইকোর্টে এই প্রশ্নে আসতেন না।
গতি আনতে ই-জুডিশিয়ারি, বিচারপতি নিয়োগ আইন চালু এবং সরকারি কৌঁসুলিদের বেতন বাড়িয়ে তাঁদের নিয়োগে সার্ভিস কমিশন (বিজেএসসি) দিয়ে করানোর মতো বিষয় অগ্রাধিকার পাচ্ছে বলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন। তবে সংস্কার আনা কী কঠিন, তার একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো সুপ্রিম কোর্টের একটি উদ্যোগ। প্রথমবার অনধিক দুই বছর দণ্ডিতদের জেলে না পুরে প্রবেশন কর্মকর্তার কাছে পাঠানোর বিধান চালু করতে তাঁদের নির্দেশনার দুই মাস পরেও কেউ তামিল করেছেন বলে জানি না।
বিচারক সংখ্যা বাড়াতেই হবে। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। নির্বাচনের আগে গত সেপ্টেম্বরে, শুধু এক মাসেই শান্ত ও সহিংসতামুক্ত রাজধানী ঢাকায় পুলিশ বাদী হয়ে ৫৭৮টি নাশকতার মামলা করেছিল।
লক্ষণীয় যে, ১ অক্টোবর, ২০১৮ পরবর্তী ৯০ দিনে সারা দেশে নতুন মামলার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪ লাখে উন্নীত হয়। এর অর্থ দাঁড়ায় ৩০ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের আগে প্রতিদিন গড়ে মামলার সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ হাজার। প্রতি ঘণ্টায় ২০৭টি মামলা হয়েছে। তবে এই সময়ে প্রতি ঘণ্টায় মামলা নিষ্পত্তির হার ছিল ১৩২ টি।
এ রকম মামলা তাই মেধাবী বিচারক নিয়োগে কুলাবে না। মেধাবী পুলিশ লাগবে। রাজনীতিটাও ঠিক করতে হবে।
লেখক : প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক; ই-মেইল: mrkhanbd@gmail. com (সূত্র : প্রথম আলো)