মানবপাচার বিশ্বব্যাপী একটি সমস্যা। ঘৃণ্য এই অপরাধের শিকার হয়ে প্রতি বছরই মারা যাচ্ছেন অগণিত মানুষ। এদের কতজনেরই বা খবর উঠে আসছে গণমাধ্যমে? সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের মানবপাচারের ঘটনা উদ্বেগজনক ভাবে বেড়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন দেবব্রত চৌধুরী লিটন।
গত ১০ মে তিউনিসিয়ার উপকূলের কাছে ভূমধ্যসাগরে অভিবাসন-প্রত্যাশীদের একটি নৌকাডুবির ঘটনায় ৬৫ জন মরা গেছেন। চলতি বছর এটিই অভিবাসন-প্রত্যাশীদের বহনকারী কোনো নৌকাডুবির সবচেয়ে ভয়াবহতম ঘটনা। এই নৌকাডুবির ঘটনায় সিলেট অঞ্চলের অন্তত ২০ জনের সলিল সমাধি হয়। এ ঘটনার পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়মিতই চালানো হচ্ছে অভিযান। এতে করে মানব পাচারের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িতরা বর্তমান পরিস্থিতিতে খানিক সময়ের জন্য গাঁ ঢাকা দিয়েছে।
বাংলাদেশে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন এবং মানব পাচার অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষা ও অধিকার বাস্তবায়ন ও নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ প্রণয়ন করা হয়। এই আইনে সংঘবদ্ধ মানব পাচার অপরাধের দায়ে অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা অন্যূন ৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে এবং অন্যূন ৫ লক্ষ টাকা অর্থ দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এছাড়া মানব পাচার অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তি অনধিক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অন্যূন ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে এবং অন্যূন ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ঘৃণ্য এই অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা ষড়যন্ত্র বা প্রচেষ্টা চালানোর জন্য অনধিক ৭ বৎসর এবং অন্যূন ৩ বৎসর কারাদণ্ড এবং অন্যূন ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এর পাশাপাশি এই আইনে সংশ্লিষ্ট অপরাধে সহযোগী হওয়ার জন্য ধার্যকৃত দণ্ডের সমপরিমাণ দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ এর অধীনে সংঘটিত অপরাধসমূহ আমলযোগ্য, অজামিনযোগ্য ও অ-আপোষযোগ্য বলে আইনটির ১৬ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে। মানব পাচারের মতো জঘন্য অপরাধের জন্য কোন ব্যক্তি পুলিশ বা ট্রাইব্যুনালের নিকট এ অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। এই অপরাধের দ্রুত বিচারের জন্য সরকার গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা দায়রা জজ বা অতিরিক্ত দায়রা জজ পদ মর্যাদার বিচারকের সমন্বয়ে মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা এই আইনে বলা হয়েছে। তবে, এই ট্রাইব্যুনাল গঠন না হওয়া পর্যন্ত সরকার প্রত্যেক জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালকে মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল হিসেবে নিয়োগ বা ক্ষমতায়িত করতে পারবে। মানব পাচার সম্পর্কিত অভিযোগ আনয়নকারী ব্যক্তিকে পুলিশ প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেয়ার বিধান এই আইনে দেয়া হয়েছে। এমনকি এই আইনি কার্যধারায় অন্যরূপ প্রয়োজন না হলে ওই ব্যক্তির নাম পরিচয় গোপন রাখারও বিধান রাখা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের কোন রায়, আদেশ বা দণ্ডের বিরুদ্ধে রায়, আদেশ বা দণ্ড ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে উচ্চ আদালতে আপীল দায়েরের বিধান রাখা হয়েছে।
আইনটির ৩ ধারায় মানব পাচার সম্পর্কিত ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে- যদি কোন ব্যক্তি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বা বাইরে প্রচারণার মাধ্যমে, অসৎ উদ্দেশ্যে এবং বাধ্যতামূলক শ্রম বা সার্ভিচিউড বা কোন শোষণ বা নিপীড়নমূলক পরিস্থিতির শিকার হইতে পারে মর্মে জানা থাকা সত্ত্বেও অন্য কোন ব্যক্তিকে কাজ বা চাকুরীর উদ্দেশ্যে গমন, অভিবাসন বহির্গমন করিতে প্রলুব্ধ বা সহায়তা করে, তা হলে উক্ত ব্যক্তির কর্মটি মানব পাচারের অন্তর্ভুক্ত হবে। এই আইনটির প্রযোজ্যতা ও প্রাধান্যের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮, সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ এবং অপরাধ ও দণ্ডের দায় দায়িত্বের বিষয়ে দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর তৃতীয় অধ্যায়ের বিধানাবলী কার্যকর হবে।
এছাড়াও এই আইনে জবরদস্তি বা দাসত্বমূলক শ্রম বা সেবা প্রদান, মানব পাচার অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্যে অপহরণ-চুরি-আটক, পতিতাবৃত্তি বা যৌন শোষণ বা নিপীড়নের জন্য আমদানি বা স্থানান্তর, পতিতালয় পরিচালনা বা কোন স্থানকে পতিতালয় হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি, পতিতাবৃত্তির উদ্দেশ্যে আহবান, ভিক্টিম বা মামলার সাক্ষীকে হুমকি মিথ্যা মামলা বা অভিযোগ ইত্যাদি অপরাধের জন্য কঠোর দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ এর ৩০ ধারায় ইলেক্ট্রনিক তথ্য প্রমাণের গ্রহণযোগ্যতা রাখা হয়েছে। এই আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন জরুরি। আইনি সহায়তা নিলে আক্রান্তদের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
বাংলাদেশের মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ শক্তিশালী একটি আইন হওয়া সত্ত্বেও অভিবাসন প্রত্যাশীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বরাবর যেমন নিজের ক্ষতি করছে, তেমনি বিদেশে দেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকে সমুদ্রপথে বিদেশে যাওয়ার সংখ্যা অনেকাংশে বেড়ে গেছে। বাংলাদেশে সরকার পাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারায় পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে বলে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি যদি সত্যি হয় তাহলে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি দুঃসংবাদ, আবার উদ্বেগজনক বিষয়।
সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে পারলে মানব পাচার রোধ করা অনেকাংশে সম্ভব। সবাই যদি সচেতন হই তাহলে পাচাররোধ করা যাবে সহজেই। রাষ্ট্রের আইন বাস্তবায়নে যারা নিয়োজিত রয়েছেন তাদের সদিচ্ছার পাশাপাশি জনগণ সচেতন হলে সহজে পাচারের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব।
পৃথিবীর কোনো আইনই শতভাগ পরিপূর্ণ নয়। সময়ের প্রয়োজনে নতুন নতুন আইন প্রণীত হবে এবং হচ্ছেও। তবে সবার সদিচ্ছা আর সম্মিলিত উদ্যোগ মানব পাচারের মতো ঘৃণ্য অপরাধকে পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলোপ করতে পারে বলে বিশ্বাস রাখতে চাই। এ ছাড়াও পাচারের শিকার হচ্ছেন যারা তাদের প্রতি সকলের সহানুভূতির হাত বাড়াতে হবে। আমাদের অনাদর বা অবহেলায় পাচারের শিকার কেউ যেন সমাজের মূলস্রোত থেকে হারিয়ে না যায় সেদিকে সদয় দৃষ্টি দিতে হবে।
লেখক : আইনজীবী।