মোঃ রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী:
জাতিসংঘের এক গবেষণা থেকে জানা যায় বাংলাদেশে প্রতিদিনের ব্যবহৃত জিনিসপত্রে ভেজাল এর কারণে সৃষ্টি হতে পারে হরমোন সংক্রান্ত ক্যানসার, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, শিশুর ত্রুটিপূর্ণ জন্ম ও মানসিক বিকারগ্রস্থসহ বেশ কিছু মারাত্মক রোগ। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য মতে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
ভেজাল এখন দেশের সর্বত্রই দেখা মিলছে দৈনন্দিন জীবনে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী থেকে শুরু করে নামীদামী ব্র্যান্ড এর পণ্য সবকিছুইতেই ভেজাল হচ্ছে। এজন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার কোন বিকল্প নেই। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে ভেজাল প্রতিরোধে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন আছে। আমাদের দেশেও বেশকিছু আইন রয়েছে। এসব আইনের মূল উদ্দেশ্য হলো- ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণ, উন্নয়ন, ভোক্তা অধিকার বিরোধী কাজ প্রতিরোধ, ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘনজনিত অভিযোগ নিষ্পত্তি, নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়ার ব্যবস্থা, কোনো পণ্য বা সেবার ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তাকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা, পণ্য বা সেবা ক্রয়ে প্রতারণা রোধ এবং ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি।
একজন পণ্য বিক্রেতা বা পণ্য সরবরাহকারী যেসব কাজ করে আইনত অপরাধী হতে পারেন; নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে পণ্য বিক্রয় বা ঔষধ বা সেবা বিক্রয় অথবা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা, জেনেশুনে ভেজাল মিশ্রিত বা মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বা ঔষধ বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা, স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক দ্রব্য মিশ্রিত কোনো খাদ্য পণ্য বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা, মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতা সাধারণকে প্রতারিত করা, প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করা, ওজন বা পরিমাপে কারচুপি করা, কোনো নকল পণ্য বা ঔষধ প্রস্তুত বা উৎপাদন করা, নিষিদ্ধ ঘোষিত এমন কোনো নকল পণ্য বা ঔষধ প্রস্তুত বা উৎপাদন করা, নিষিদ্ধ ঘোষিত এমন কোনো কাজ করা যাতে সেবা গ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে, অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াকরণ করা, অবহেলা বা দায়িত্বহীনতা দ্বারা সেবা গ্রহীতার অর্থ বা স্বাস্থ্যহানী ঘটানো, কোনো পণ্য মোড়কবদ্ধভাবে বিক্রয়ের সময় মোড়কের গায়ে পণ্যের উপাদান, সর্ব্বোচ্চ খুচরা বিক্রয় মূল্য, মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করার বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করা, আইনানুগ বাধ্যবাধকতা অমান্য করে দোকান বা প্রতিষ্ঠানে সহজে দৃশ্যমান কোনো স্থানে পণ্য ও সেবার মূল্য তালিকা লটকায়ে প্রদর্শন না করা ইত্যাদিসহ বিভিন্ন রকম নিত্য নতুন কায়দায় ভোক্তা অধিকার বিরোধী নানারকম ভেজাল।
এসব অপকর্ম রোধে ভেজাল বিরোধী এবং নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে বাংলাদেশে আইনের অভাব নেই। যে কয়েকটি আইন বিদ্যমান রয়েছে, মূলত অধিকাংশ নামে মাত্র আছে। প্রয়োগ নেই বললেই চলে। আইনগুলোর অধীনে সামান্য কিছু জরিমানা ও দু-এক মাসের কারাদন্ড ছাড়া বড় কোনো শাস্তি দেওয়া হয় না। বাংলাদেশে বর্তমানে খাদ্যে ভেজাল সংক্রান্ত কার্যক্রমের সঙ্গে বেশ কিছু আইন সম্পৃক্ত থাকলেও আগে মূল আইনটি ছিল পিওর ফুড অর্ডিন্যান্স ১৯৫৯। ২০১৩ সালে নিরাপদ খাদ্য আইন কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনটির ৯০ ধারা অনুসারে পিওর ফুড অর্ডিন্যান্স ১৯৫৯ রহিত হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য আইনের অধীনে ২৩ ধরণের অপরাধে এক থেকে পাঁচ বছরের কারাদন্ড ও চার লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। যদিও পৃথিবীর কোন কোন দেশে এ ধরণের অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদন্ড এমনকি মৃত্যুদন্ডের বিধান রয়েছে।
খাদ্যে ভেজাল সংক্রান্তে দন্ডবিধি ১৮৬০, বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ ১৯৫৯, বিশুদ্ধ খাদ্য নীতিমালা ১৯৬৭, বিশুদ্ধ খাদ্য আইন (সংশোধিত) ২০০৫, ভ্রাম্যমাণ আদালত অধ্যাদেশ ২০০৯, পয়জনস অ্যাক্ট ১৯১৯, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ এবং নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ সহ আরো অনেক আইন রয়েছে। বিশেষ করে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজাল মেশানোর সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের কথা বলা হয়েছে। উক্ত আইনে কোন কোন ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১৪ বছরের কারাদণ্ডের বিধানও রাখা হয়েছে । কিন্তু এ আইনের প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অর্থাৎ এ আইনে মামলা তেমন হয়না বললেই চলে। এমনকি কারো কথিত শাস্তি হয়েছে বলেও শোনা যায়নি ।
বর্তমানে দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালতের প্রচলন রয়েছে । এই আদালত সংক্ষিপ্ত বিচার করে থাকে । বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ ও বাংলাদেশ স্টান্ডার্ড এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) অর্ডিন্যান্স আনুযায়ী ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয় । তবে এতে শাস্তির মেয়াদ কম। এই কারণে গুরুতর অপরাধ করেও ভেজালকারীরা কম সাজায় পার পেয়ে যায়। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ২৭২ ও ২৭৩ ধারায় খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তির বিধান রয়েছে। ২৭২ ধারায় বিক্রয়ের জন্য খাদ্য ও পানীয়তে ভেজাল মেশানোর দায়ে কোন ব্যক্তিকে অনধিক ০৬ (ছয়) মাস পর্যন্ত শাস্তির বিধান রয়েছে। ২৭৩ ধারায় ক্ষতিকর খাদ্য ও পানীয় বিক্রয়ের অপরাধেও ০৬ (ছয়) মাসের শাস্তির বিধান রয়েছে ।
কোনো ভোক্তার অধিকার লঙ্ঘন হলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর-এ অভিযোগ দায়ের করা যাবে। একজন ভোক্তা, একই স্বার্থসংশ্লিষ্ট এক বা একাধিক ভোক্তা, কোনো আইনের অধীন নিবন্ধিত কোনো ভোক্তা সংস্থা, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ বা তার পক্ষে অভিযোগ দায়েরের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা, সরকারি বা সরকার কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো সরকারি কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ী ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের আওতায় অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। তবে কারণ উদ্ভব হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে অভিযোগ দায়ের করা করতে হবে। এ সময়ের পর অভিযোগ করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। অভিযোগ করার সময় নির্ধারিত কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করা প্রয়োজন। অভিযোগ অবশ্যই লিখিত হতে হবে।
অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাৎক্ষণিক ভাবে আদায়কৃত জরিমানার অর্থের ২৫% অভিযোগকারীকে প্রদান করা হবে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর ধারা ৭৬(৪) অনুযায়ী। এছাড়াও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর ৬৬ ধারা অনুযায়ী একজন ভোক্তা চাইলে অধিকার আদায়ে দেওয়ানী আদালতে মামলা করতে পারে। আবার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর অধীনে অপরাধসমূহের সর্বোচ্চ শাস্তি ৩ বছর কারাদন্ড বা ২ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয়দন্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। যেখানে মামলা করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মচারীদেরকে।
সবশেষে বলতে বাধ্য হচ্ছি, মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিতের লক্ষ্যে এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ও ভোক্তা অধিকারবিরোধী কার্য প্রতিরোধের লক্ষ্যে নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ প্রণয়ন করা হলেও উভয় আইন কার্যকর হওয়া পরবর্তী যে হারে ভেজাল পণ্যের উৎপাদন ও বিপণন চলছে তাতে আইন দু’টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যে এখনো সফলতার পথে ইতিবাচক অবদান রাখতে সমর্থ হয়নি তা দেশের নাগরিক ও ভোক্তাদের কাছে স্পষ্ট এবং একইসঙ্গে হতাশাজনক।
বাংলাদেশে এখন আলোচিত বিষয় হচ্ছে খাদ্যে ভেজালরোধে অভিযান। ভেজাল বিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, বিএসটিআই, বাংলাদেশ পুলিশ ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান। ভেজাল প্রতিরোধে বিএসটিআই বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন(পণ্যমান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান) এর কার্যক্রম আরও কার্যকর করতে হবে। ভেজাল প্রতিরোধে প্রশাসনকে আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী। মাঝে মধ্যে ভেজাল বিরোধী পরিদর্শন টিম বাজার পরিদর্শন করায় ভোক্তাদের কাছে স্বস্তিদায়ক মনে হয়। যেহেতু এখন ভেজালের ধরণেও এসেছে ভিন্নতা। যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তির। এসব বিষয় চিন্তা করে ভেজাল বিরোধী অভিযানে আরও বেশী কৌশলগত, নিয়মিত ও জোরদার করা এখন সময়ের দাবী। ভেজাল বিরোধী অভিযানে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের উপরই নির্ভর করছে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা, নির্ভর করছে অভিযানের প্রকৃত সফলতা এবং আইনের কার্যকারিতা। দেশের প্রতিটি মানুষের জীবনধারণের জন্য খাদ্যের সংস্থান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এটি নাগরিকদের একটি মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্রকে নাগরিকদের জন্য খাদ্যের সংস্থানের পাশাপাশি সে খাদ্য যেন নিরাপদ হয় তা নিশ্চিত করতে হয়। একথা সত্য যে, শুধুমাত্র সরকারী উদ্যোগে ভেজাল প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তবে মূল এবং শক্ত ভূমিকা সরকারকেই নিতে হবে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্য ভেজালমুক্ত করতে হলে আইনের বাস্তবায়নের পাশাপাশি সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগের সেতুবন্ধনে ভেজাল এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে সফল করতে প্রয়োজন সর্বস্তরের মানুষের সচেতনতা এবং অংশগ্রহণ। ভোক্তা অধিকার বাস্তবায়নে নিজেদেরকে সুসংগঠিত ও সোচ্চার হয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম; ইমেইল: ll.braihan@gmail.com