ড. এস. এম. মাসুম বিল্লাহ

জাস্টিস ইজ নট এ ক্লয়াস্টার্ড ভার্চু

ড. এস এম মাসুম বিল্লাহ

১. সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার বরাতে একটা নির্দেশনা জারি হয়েছে। টিভি বা কাগজে চলমান মামলা নিয়ে সংবাদ পরিবেশন “অনভিপ্রেত” মর্মে খবর পরিবেশন করতে নিষেধ করা হয়েছে। আমি আদেশটির দিকে একনজরে কিছুক্ষণ তপ্পন মেরে চেয়ে থাকলাম। এবং আৎকে উঠলাম। আমলাতন্ত্রের সর্বগ্রাসী রূপ আদালতকেও ধেয়ে আসা জোয়ারের মতো আচ্ছন্ন করেছে বলে মনে হচ্ছে। আমার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে একটা সাংবিধানিক আদালতের অফিস থেকে এ ধরণের একটা প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। নির্বাহী বিভাগের সাথে সমানতালে আদালতও বাকস্বাধীনতা ও প্রেস ফ্রিডম এর উপর বাধা আরোপ করতে পারেন, এ যেন চোখ বিশ্বাস করতে চায়না।

২. রেজিস্ট্রার অফিসের জারি করা ওই “আদেশক্রমে অনুরোধপত্রে” “অনভিপ্রেত” ছাড়া অন্য কোনো কারণ দেখানো হয়নি। কোর্ট হয়তো বলতে চাচ্ছেন যে বিচারাধীন বিষয়ে খবর ছাপালে তা বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে, অনেক সময় বিশেষ ভ্রান্তি ছড়ায়, এবং অনেকক্ষেত্রে, ব্যক্তির গোপনীয়তা/সুনামের অধিকার ক্ষুণ্ণ করতে পারে। বলাই বাহুল্য, এর কোনোটিই এধরণের সেন্সরশিপ আরোপকে বৈধতা দেয়না। যদি এধরণের কোনো সীমাবদ্ধতা আরোপ করতেই হয়, তা আদালতকে জুডিশিয়াল প্রিন্সিপল স্থাপন করে বিচারিকভাবে করতে হবে, অথবা ব্যাপক সংলাপের মাধ্যমে সুষ্ঠু আইনি কাঠামোর মধ্যে করতে হবে। তাই সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার অফিসের আদেশটি পরিত্যাজ্য এবং আদালতে চ্যালেঞ্জযোগ্য। আমার কাছে এটি খালি চোখে সংবিধান বিরোধী একটি সার্কুলার বলে মনে হচ্ছে। “আদিষ্ট হয়ে অনুরোধের” সংস্কৃতি বিচারবিভাগের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়। “উই দ্যা পিপল”–জুরিস্প্রুডেন্স-এ “আদেশ” নামের যেকোনো আইনি ধারণা অগ্রহণযোগ্য।

৩. পার্কের দরজা বন্ধ করলেই কাক আসা বন্ধ হয়না। দ্বার রুদ্ধ করে ভ্রম রুখতে চাইলে সত্য ঢুকার জায়গা পাবেনা। ইংল্যান্ডের আধুনিক আইনবিজ্ঞানের জনক জেরেমে বেনথাম (১৮৪৩) কহেন: “Publicity is the very soul of justice. It is the keenest spur to exertion, and the surest of all guards against improbity. It keeps the judge himself, while trying, under trial”. বেন্থামাইট এই নীতি কমন ল’ সিস্টেমে শত বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত এবং উন্মুক্ত বিচার (open justice principle) নীতি নামে পরিচিত। ওপেন জাস্টিস নীতিতে আদালতের কার্যক্রম এবং প্রেসকে আলাদা করার সুযোগ নেই। আমেরিকার তাত্ত্বিক জন রলস্ বিচারকে স্বচ্ছতার নিরিখে দেখেছেন (জাস্টিস এ্যাজ ফেয়ারনেস, ১৯৭২)। এর একটা অন্যতম দিক হলো ক্ষমতা, অর্থ আর বিচার অভিগম্যতার অসম-বন্টনের সমাজে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে গরিবের পক্ষের হতে হয়। এদেশের বিচারপ্রার্থী অধিকাংশ মানুষই গরিব–এক্ষেত্রে মিডিয়া তাদের বিচারের খবর কাভার না করলে তা কখনই মানসম্পন্ন হবেনা। আইনের ছাত্ররা জানবেন যে, “বিচার শুধু করলেই চলেনা, প্রতীয়মান হতে হয় যে বিচার নিশ্চিত হয়েছে” (লর্ড হিউয়ার্ট, ১৯২৪)। আর লর্ড এটকিনের (১৯৪২) সেই বিখ্যাত কথাটা “বিচার প্রক্রিয়া কোনো আচ্ছাদিত গুণ নয়, একে মানুষের সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করতে হয়।”

৪. মিডিয়া রিপোর্টিং যদি সমস্যা হয়, তবে তা নিরসনে আদালতকেও কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন, কোনো রায় বা আদেশ হলে মিডিয়া রিপোর্টিং এর জন্যে কারণসহ সংক্ষিপ্ত আদেশ সরবরাহ করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টেরও একটা প্রেস উইং থাকা উচিত। এতে করে গণমাধ্যমের অনুমানের আওতাটা কমবে। আদালত বিচারক, আইনজীবী, আইনের শিক্ষক ও সাংবাদিক সহযোগে আদালত রিপোর্টিংয়ের একটা মানদণ্ড নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারেন। এগুলো সার্বিক বিচারিক সংস্কৃতির একটা অংশ। আমাদের দেশে বিচারতো একটা আচারও বটে। আদালত কেন যে পেছনের দিকে হাঁটছেন বলা মুশকিল।

লেখক- জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।