কাজী শরীফ:
আমরা কথায় কথায় ব্রিটিশ শাসনের কথা বলি। প্রায় দুইশত বছর ধরে ইংরেজ শাসন যে আমাদের দেশের অর্থনীতিতে শোষণের রাজত্ব কায়েম করেছিলো তা বলতে বলতে আমাদের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ার মত অবস্থা হয়ে যায়। ইংরেজদের বিপক্ষে আমাদের অবস্থান আমাদের জাতীয়তাবাদের ইঙ্গিত দেয়। লাগান ছবিতে আমির খানদের এ জয়ে আমরা যেনো নিজেদের জয় দেখি। লাগান দেখতে দেখতে কতবার যে চেয়ার ছেড়ে আবেগে উঠে গেছি সে কথা আমার উপরওয়ালা জানেন!
ইংরেজরা ব্রেক্সিট করে আলাদা হয়ে গেলে আমাদের তৃপ্তির ঢেকুর ওঠে। বলি “এবার বুঝ ব্যাটারা!”
এই যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান তা নিয়ে আমার আপত্তি নেই। অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক। আমাদের পূর্বসুরীদের গোলাম বানিয়ে রাখার পাঁয়তারা যে তাদের!
আমার আপত্তির জায়গা হলো ইংরেজদের ক্ষেত্রে আমাদের দ্বিমুখী নীতি নিয়ে। অবশ্য জাতি হিসেবে আমাদের এ চর্চা নতুন নয়। নিজের সুবিধামত ব্যাখ্যা দেয়ায় রাজনৈতিক দল থেকে আইনজীবী কিংবা একেবারে ঘরের বউ কেউই বাদ যান না!
যে আমরা ইংরেজদের আমাদের গোলাম বানিয়ে রাখার বিপক্ষে তারাই পথে ঘাটে সাধারণ মানুষের মুখে স্যার না শুনে ভাই/বোন/দাদা/দিদি শুনলে মেজাজ সপ্তমে চড়িয়ে দিই। এ নিয়ে আগের লেখায় লিখেছি ও তা নিয়ে কতেক বাঙ্গালির রোষেও পড়েছি!
এবার আসি ভিন্ন আলোচনায়। ইংরেজদের এত বিরোধীতার পরও তাদের অনেক কিছুই আমরা ধারণ করে অদ্ভুত সুখ পাই। সম্ভবত দুজন বাঙ্গালি পারস্পরিক কথোপকথনে ইংরেজি বলে যে সুখ পান তা অন্যকিছুতে পাননা! যেখানে দুজনই বাঙ্গালি সেখানেও ইংরেজি কপচাতে আমরা গৌরববোধ করি। আর যদি আবিস্কার করতে পারি আশেপাশের মানুষ আমাদের কথা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে তখন পুনঃ পুনঃ আমরা তা অব্যাহত রাখি। এ প্রসঙ্গে উপমহাদেশের প্রথম দিককার বাঙ্গালি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৮৯৪) দ্বারস্থ হতে হয়। তিনি বলেছিলেন “তুমি রচনায় যাহা প্রকাশ করিতে চাহিলে তাহা যদি প্রকাশ করিতে না পারো তবে রচনা বৃথা হইল।”
আমরা অন্যকেউ বুঝুক আর না বুঝুক ইংরেজি বলতে থাকি আর পরে বাহবা পাওয়ার আশা ছাড়িনা। অবশ্য দু:খের সাথে বলতে হয় বঙ্কিমচন্দ্র নিজেও সবাইকে বুঝাতে পারেননি। তাই তিনি থেকে গেছেন সাধারণ পাঠকের ধরাছোঁয়ার বাইরে!
এই যে ইংরেজদের প্রতি আমাদের আবেগের স্ববিরোধীতা তা ইংরেজি ভাষার প্রচলন থেকেই। আমরা অফিস আদালতের ভাষা হিসেবে ইংরেজি মানতে পারলাম না তখন। ফার্সির জায়গায় ইংরেজি মানা যায়না! তাহলে স্বাভাবিকভাবে এখন বাংলার জায়গায় ইংরেজি মানা উচিত না! অথচ আমি ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে লেখা দেখেছি “উই শেল কমিউনিকেট ইন ইংলিশ।” তার মানে ঢাকার বুকে শহিদ মিনার থাকলেও ঢাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা অচল!
ধান ভানতে কী শিবের গীত করছি! এ আমার মূদ্রাদোষ। আসল প্রসঙ্গে আসি। ইংরেজদের সবকিছুতে লোকদেখানো আপত্তি থাকলেও আইনজীবী ও বিচারকদের পোশাকের বেলায় সে আপত্তি নেই। একজন আইনজীবী ও বিচারক যা এ গরমের দিনে গায়ে চাপান তা এমন পরিবেশেও ইংরেজরা যদি আমাদের পরতে দেখেন খোদার কসম ইংরেজপ্রীতির জন্য আমাদের ভিসা ওপেন করে দিবেন! বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতকে কী দেখানো যায়!
প্যান্ট ও সাদা শার্ট ইন করে গলার বোতাম বন্ধ করে গলায় ব্যান্ড পরতে হয়। মানে বাতাস ঢুকার সব রাস্তা বন্ধ! তার উপর কালো কোট চাপিয়ে এর উপর গাউন পরা! ভাবা যায় সাদা ভিন্ন অন্য রঙের পোশাক টেস্ট ক্রিকেটেই পরেনা আর আমরা গরম ধারণকারী কালোই পরি!
আমাদের আদালতগুলোতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই। এত এত মানুষের মধ্যে আইনজীবী ও বিচারকদের এ পোশাক স্বাস্থ্যকর নয়। আমাদের একজন জ্যেষ্ঠ সহকর্মী কয়েকদিন আগে আদালতেই মাথা ঘুরে পড়ে যান। শারীরিক অস্বস্তি নিয়ে ঠান্ডা মাথায় ন্যায়বিচার করা কঠিন।
আমাদের দেশের শুধু আইনজীবী বিচারকদের কথা কেনো বলছি! এত বছর পড়াশুনা করার পর যে প্রত্যাশিত সমাবর্তন হয় তাতে ইংরেজদের মত পোশাক পরতে হয়। ইংরেজরা ঠান্ডার দেশ বলে পরেন। আমরা গরমের দেশেও কেনো ওদের মতই পরি! আমি ছাত্রজীবন শেষে সমাবর্তনে এ পোশাক ও গরমের কথা ভেবে যাইইনি!
আমাদের আছে নিজস্ব সংস্কৃতি। আমাদের ঐতিহ্য হাজার বছরের। আমাদের বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি কী ইংরেজি জানতেন না! তিনি ইংরেজি জানতেন কিনা সেটা ১৯৭২ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়ার পর তার ইংরেজি শুনলে বুঝতে পারবেন!
আসুন আমরা পরের সংস্কৃতিকে নিজের মনে না করি। আমাদের পোশাক হোক আমাদের মত। আমাদের পরিবেশ উপযোগী। আমাদের নিজস্বতা আছে। আছে সংস্কৃতি, আছে ঐতিহ্য। বিদেশিদের দেখিয়ে দেয়ার এইতো সময়!
লেখক : সহকারী জজ, নোয়াখালী।