আমরা অনেক সময় আইনের স্বরূপ বুঝতে না পেরে বা আইনগত তাত্পর্য অনুধাবন না করে মন্তব্য বা মতামত প্রদান করি, যা প্রকৃত আইনি দৃষ্টিভঙ্গিকে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়। ফলে ত্রুটিপূর্ণ গণঅনুমান (People’s Perception) গড়ে উঠে, যার ফলে কোন ঘটনা বা বিষয়কে কেন্দ্র করে জনসাধারণের ভিন্নরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এ বিষয়টি মাথায় রেখে যারা আইন বিষয়ে পেশাদার নন কিন্তু জানতে আগ্রহী তাদের জন্য লিখেছেন মোঃ আবু হানিফ।
ধরুন আপনি বা আপনার আত্মীয় বা বিশেষ কেউ গ্রেফতার হলেন। আপনি নিশ্চয় উদ্বিগ্ন হবেন। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি তার অধিকার না পাক বা তাকে অযথা হয়রানী করা হোক আপনি নিশ্চয় তা চাইবেন না। আইনও সে কথাই বলে। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন ফরমাল অভিযোগ আছে কিনা বা অভিযোগ থাকলে তার প্রকৃতি কি বা কোন আদালতের পরোয়ানা আছে কিনা ইত্যাদি বিষয়ে জানার জন্য অনেকসময় আইনজীবীর দরকার হয়। তাছাড়া গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির আইনগত অধিকার সুরক্ষিত হচ্ছে কিনা বা তাকে আদালতে আনা হলে অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অন্তবর্তী জামিন নেওয়া যায় কিনা এসব বিষয় নিযুক্ত আইনজীবী দেখে থাকেন। এছাড়াও বিচার চলাকালীন অভিযুক্তের পক্ষে কোন তথ্যগত বা আইনগত বিষয় থাকলে বা অভিযোগটি সঠিক না হলে সে বিষয়েও অভিযুক্তের আইনজীবী আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। অভিযুক্তের সাজা হলে তার বিরুদ্ধে আপিল আবেদন করতেও আইনজীবীর শরনাপন্ন হতে হয়। মোটকথা আইনজীবী আদালতে বা আদালতের বাইরে তার মক্কেলের (অভিযুক্ত ব্যক্তির) প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করেন।
প্রশ্ন করতে পারেন, যে অপরাধ নৃশংসভাবে জনসম্মুখে সংঘঠিত হয়েছে বা যে অপরাধ মানুষকে এত নাড়া দিয়েছে, সে অপরাধের অভিযুক্তের পক্ষে একজন আইনজীবী দাঁড়াবেন কেন? এ প্রশ্ন সাধারণের মনে আসতেই পারে। কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধের তো বিচার হতে হবে। তাকে তো ধরে নিয়ে বিনা বিচারে মেরে ফেলা যাবে না। তাকে বিচারে দোষী পাওয়া গেলে অবশ্যই তার সাজা হবে। কিন্তু সে পর্যন্ত অভিযুক্ত ব্যক্তির আইনগত অধিকার আছে আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে প্রতিনিধিত্ব পাওয়ার। এটি সমগ্র বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত নীতি। এমনকি সামরিক ট্রাইব্যুনালেও অভিযুক্তের পক্ষে প্রতিনিধি রাখা হয়। অভিযুক্তের বক্তব্য না শুনে সাজা প্রদান করা চরম অন্যায় হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এমনকি আজ থেকে দুই হাজার বছরেরও আগে দার্শনিক সক্রেটিসকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, যেমন সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে।
আপনি বলতে পারেন, একজন আইনজীবী কেন একজন আপাতদৃষ্টে অপরাধী ব্যক্তির পক্ষে দাঁড়াবেন? তার নিকট কি সাধারণ মানুষের আবেগের কোন মূল্য নেই? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে হলে আইনজীবী পেশার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যসহ আইনের বিধান, অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার, সুবিচারের ধারণা বিষয়ে জানা আবশ্যক।
প্রথমে আইনজীবীর পেশা সম্পর্কে বলি। একজন ডাক্তারের নিকট কোন রোগী এলে ডাক্তারের দায়িত্ব হচ্ছে রোগীর চিকিৎসা করা। রোগী যদি চোর, ডাকাত, বদমাশ হয় সেটা দেখা তার কাজ নয়। তিনি এ কারণে চিকিৎসা না করে একজন রোগীকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে পারেন না। বরং সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিকেও অসুস্থ হলে চিকিৎসা দেওয়া হয়। একজন আইনজীবী যেকোন লোককে আইনী সেবা দিতে পারেন। সবচেয়ে ঘৃণিত মানুষটিরও আদালতে আইনজীবী নিয়োগ দেওয়ার অধিকার রয়েছে। একজন চরমমাত্রার অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তির আইনজীবী হওয়া মানে অভিযুক্তের পক্ষে মিথ্যা সাফাই গাওয়া নয়, বরং তার পক্ষে কোন তথ্যগত, আইনগত বা পদ্ধতিগত কোন সুযোগ থাকলে তা আদালতে উপস্থাপন করা। সঠিক আইনি ব্যাখ্যা আদালতে উপস্থাপন করাও আইনজীবীর কাজ। তিনি অভিযুক্ত পক্ষে নিয়োগ পান অভিযুক্তের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য। আইন বা ঘটনা অভিযুক্তের পক্ষে না থাকলে আইনজীবী অভিযুক্তকে বাঁচাতে পারেন না। কিন্তু তিনি পেশাগতভাবে চেষ্টা করেন। তার মানে তিনি একজন অপরাধীর অপরাধকে বৈধতা দেন বা সমর্থন করেন ব্যাপারটা সে রকম না।
এবার আসি আইনগত বিষয়ে, একজন আইনজীবীকে যেকোন ব্যক্তির পক্ষে আদালতে দাঁড়ানোর জন্য আইনগতভাবেই রাষ্ট্রীয় সংস্থা কর্তৃক অনুমতি বা সনদ প্রদান করা হয়। তাকে স্বীয় দায়িত্ব পালন করতে বাধা দেওয়া বেআইনী এবং দন্ডনীয় অপরাধ। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে আইনজীবীর সাথে আলাপ করার এবং আইনজীবীর মাধ্যমে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার প্রদান করা হয়েছে। তাছাড়া অন্যান্য আইনেও আইনজীবীদের আদালতে স্বীয় মক্কেলের পক্ষে দাঁড়ানোর অধিকার দেওয়া হয়েছে।
তাহলে একজন আইনজীবীর কি নৈতিকতা থাকবে না? অবশ্যই থাকবে। তাদের পেশাগত নৈতিকতার লিখিত ও অলিখিত আইন আছে। তবে সেটা কোন অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে তাকে দাঁড়াতে বাধা দেয় না। অর্থাৎ তার পেশাগত নৈতিকতার বিষয়টি আলাদা (এটি অত্র আলোচনার বিষয় নয়)।
মাঝে মাঝে দেখা যায়, অমুক অভিযুক্তের পক্ষে যেন কোন আইনজীবী না দাঁড়ায় এরকম তুঘলকি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আমার মতে এটা মূলত একটি বেআইনী চর্চা। কেউ স্বেচ্ছায় না চাইলে ভিন্নকথা। কিন্তু কারো আইনজীবী হিসাবে আদালতে দাঁড়াতে বাধা দেওয়া বেআইনী।
উপরের আলোচনাগুলো মূলত ফৌজদারী বিচার সংক্রান্ত। দেওয়ানী বা সমপ্রকৃতির বিচারিক ব্যবস্থায়ও একজন আইনজীবীর আদালতে প্রতিপক্ষ বা আপাতদৃষ্টে অনিষ্টকারী ব্যক্তির পক্ষে দাঁড়ানোর অধিকার আছে। আইন তাকে সে সুযোগ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ৬ষ্ঠ সংশোধনীতে আইনজীবীর মাধ্যমে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকারকে সুবিচারের একটি উপাদান হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
সুতরাং কোন আইনজীবী যদি কোন অনিষ্টকারী গণসমালোচিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে আদালতে নিযুক্ত আইনজীবী হিসাবে বক্তব্য দেন, তার জন্য উক্ত আইনজীবীকে ব্যক্তিগতভাবে কটাক্ষ করা, তার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে দোষারূপমূলক সম্মানহানীকর উক্তি করে হেয় করা কোন সুনাগরিকের কাজ হতে পারে না, যেটি প্রকারান্তরে দন্ডনীয় অপরাধ। যারা বুঝে বা না বুঝে এটি করছেন তারা যুক্তিহীনভাবে একপেশে আবেগে গা ভাসাচ্ছেন।
লেখক : যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ (সংযুক্ত কর্মকর্তা), আইন ও বিচার বিভাগ