অ্যাডভোকেট মুরাদ মোর্শেদ:
বার কাউন্সিল পরীক্ষা সংক্রান্ত গত প্রায় বছর চারেক ধরে লেখালেখির কাজ, বিশেষত বই লেখার কাজ ও ছাত্রদের পড়াতে গিয়ে বেশ কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। পরীক্ষার্থীগণ কীভাবে তাদের জন্য প্রস্তুতকৃত বাজারের বিভিন্ন লেখকের মডেল টেস্ট অনুশীলন করে তা প্রায়ই প্রত্যক্ষভাবে দেখার সুযোগ হয়েছে। তারই আলোকে এই লেখা। পরীক্ষার্থীদের মডেল টেস্ট বইগুলো অনুশীলন করার পদ্ধতিগত ভুল থাকার কারণে তারা কার্যকরভাবে এটা কাজে লাগাতে পারে না, ফলে এমনকি মডেল টেস্ট অনেক প্র্যাকটিস করেও এমসিকিউ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়েন। প্রতি বছর বছর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবার বিধান বার কাউন্সিল আইনে থাকার পরও পরীক্ষা নিয়মিত অনুষ্ঠিত না হবার কারণে পরীক্ষার্থীদের আরো বিরাট হতাশার সাগরে পড়তে হয়। ফলে একবার এমসিকিউ পরীক্ষায় ফেল করা মানে মোটামুটি আড়াই-তিন বছরের এক ধাক্কা সইতে হয়।
এমসিকিউ পরীক্ষা কিন্তু এমন মহাকঠিন কিছু নয়, অন্তত বার কাউন্সিলের পরীক্ষাতো নয়ই। এ বিষয়ে বিস্তারিত যুক্তিমালা অন্য একটি লেখায় তুলে ধরেছিলাম আগেই। তো, এরকম একটি পরীক্ষা পাশ করার জন্য মূল পাঠগুলো সেরে ফেলে যখন মডেল টেস্টগুলো অনুশীলন করবেন, তখন তা সঠিক পদ্ধতিতে অনুশীলন করলেও বার কাউন্সিলের পরীক্ষার পড়া আরো শক্তপোক্তভাবে এগিয়ে যায় এবং পরীক্ষায় পাশ হওয়া নিশ্চিত করা যায়।
যেকোনো মডেল টেস্ট বই যখন আপনি বাজার থেকে কিনবেন, সাথেসাথেই তা অনুশীলন করার জন্য ঝাপিয়ে পড়বেন না। প্রথমেই আপনার প্রস্তুতির লেভেলটি নিজেই মূল্যায়ন করবেন যে আপনার প্রস্তুতির স্তরটি কেমন। আপনার যদি সব মূল আইন পড়া শেষ হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে প্রথমে আরেকবার রিভিশন দিয়ে নেবেন। রিভিশন দেবার পরপরই আমার বিশেষ পরামর্শ থাকবে যে, বিগত সালগুলোতে আসা প্রশ্নগুলো ভালোভাবে চর্চা করার। বার কাউন্সিলের ২০১৭ সালের এমসিকিউ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রটি ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে সাথে আরো কিছু টপিকে আলোচনা করেছি এই নিবন্ধে। আপনি যদি বার কাউন্সিলের পরীক্ষায় যেকোনো মূল্যে পাস করতে চান বা আপনি পড়ুয়া বা কম পড়ুয়া শিক্ষার্থী হোন না কেন, এই নিবন্ধটি আপনার চোখ খুলে দেবে আশা রাখি।
বিগত সালের প্রশ্নগুলো কেন, কীভাবে বিবেচনায় নেবেন?
বিগত সালের প্রশ্নগুলোর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে একটি সাধারণ পরিসংখ্যানগত কারণে। দেখতে দেখতে জুডিসিয়ারির ১০টি এমসিকিউ এবং বার কাউন্সিলের ৪টি এমসিকিউ পরীক্ষা ইতিমধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই পরীক্ষাগুলোতে যেসব প্রশ্ন এসেছে এই প্রশ্নগুলো পর্যােলোচনা করেই বোঝা যায় যে, বার কাউন্সিল বা জুডিসিয়ারি এমসিকিউ পরীক্ষার প্রশ্নের গঠনপ্রণালী এবং বৈশিষ্ট্য। প্রথমত আপনি মনে রাখবেন যে, বার কাউন্সিল বা জুডিসিয়ারিতে আসা বিগত সালের প্রশ্ন ও উক্ত ধারাটি সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলোতেই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগুলো আইনে উল্লেখ রয়েছে যেগুলো হরহামেশাই লাগে অথবা এগুলো এমনসব গুরুত্বপূর্ণ ধারণা যা কিনা একজন আইনের শিক্ষার্থী হিসেবে আপনার জানা বাঞ্ছনীয়।
এই প্রশ্নগুলো গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, বিগত সালের প্রশ্নগুলো থেকে হয় সরাসরি রিপিট প্রশ্ন নয়তো উক্ত ধারা থেকে অন্যান্য তথ্য সংক্রান্ত নতুন প্রশ্ন আসে। ফলে আপনি যখন বিগত সালে আসা কোনো প্রশ্নের সংশ্লিষ্ট ধারার সমস্ত তথ্য জেনে রাখবেন বা মনে রাখতে পারবেন, দেখবেন যে, সেখান থেকেই অন্তত ৪০ বা ৫০ ভাগ পর্যন্ত প্রশ্ন কমন পাবেন বা আপনার আয়ত্বের ভেতরে থাকবে।
আপনি যে সত্যি সত্যি উক্ত ধারাগুলো ভালোভাবে পাঠ করলে আনুমানিক ৫০ ভাগ কমন পাবেন, তার একটি পরিসংখ্যানিক চিত্র নিচেই প্রমাণ হিসেবে তুলে দিলাম।
উপরের ছকে থাকা তথ্যগুলো বিস্তারিত ব্যাখ্যার কোনো প্রয়োজন নেই আশা করি। শুধু মোট সব নিচের লাইনটি খেয়াল করুন যে, ২০১৭ সালের ১০০টি প্রশ্নের ভেতরে ৬৪টি প্রশ্নই এমন সব ধারা থেকে এসেছে যেগুলো কিনা বিগত সালে এসেছিলো। এমনকি অন্তত ১০টি প্রশ্ন আছে যেগুলো হুবহু এসেছে! অন্যদিকে, যেসব ধারা থেকে বিগত সালগুলোতে একবারও প্রশ্ন আসেনি এমন ধারা থেকে এসেছিলো ৩৬টি প্রশ্ন। অর্থাৎ, একেবারে নতুন অথচ গুরুত্বপূর্ণ ধারা এগুলো।
তবে ২০১৭ সালে ৬৪টি প্রশ্ন এসেছিলো বলে আবার এমন মনে করার কোনো কারণ নেই যে, আপনি আগামী পরীক্ষাতেও এই একই শতকরা হারে প্রশ্ন কমন পাবেন। অন্যান্য সালের প্রশ্নগুলো পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, অন্তত ৩৫ ভাগ প্রশ্ন বিগত সালের ধারাগুলো থেকে কমন পড়ে। সবমিলে গড়ে ৪০ থেকে ৫০ ভাগ প্রশ্ন কমন পাবার সম্ভাবনা আছে বা থাকে।
আপনারা অনেকেই ভাবতে পারেন, এতোগুলো প্রশ্নের কমনসমৃদ্ধ পরীক্ষাতেও এতো শিক্ষার্থী কেন ফেল করলো। এটা ঠিক যে, অনেক বিগত প্রশ্ন থেকে কমন ছিলো, কিন্তু ২০১৭ সালের পরীক্ষাটি সবচেয়ে কঠিন এবং সবচেয়ে মানসম্মত প্রশ্ন ছিলো। কিছু প্রশ্ন হুবহু ছিলো, কিন্তু আগে আসা ধারাগুলো থেকে প্রশ্ন আসলেও সেগুলো ছিলো আরো ক্রিয়েটিভ এবং উক্ত ধারা থেকেই অন্যান্য তথ্য থেকে প্রশ্ন এসেছিলো।ফলে অনেকে ভুলভাবে ভুল পদ্ধতিতে পড়ার কারণে পাস করতে পারেনি।
তাহলে কী দাঁড়ালো? দাঁড়ালো এটাই যে, বিগত সালে আসা সব প্রশ্ন পড়ার সাথে সাথে উক্ত ধারায় আরো যেসব তথ্য আছে সেগুলো ভালোভাবে আয়ত্ব করা – এটাই আপনার প্রথম কাজ এবং এতে করেই মোটামুটি নিশ্চয়তার সাথে বলা যায় যে, এখান থেকেই আপনি পাস করার জন্য প্রয়োজনীয় নম্বর তথা ৫০ নম্বর তুলতে পারবেন।
একবারও না আসা ধারাগুলো থেকে প্রশ্ন আসার সম্ভাবনা সম্পর্কে
কিন্তু শুধুই ৫০ নম্বরের কনফার্মেশন নিয়ে পরীক্ষার হলে যাওয়াটা নিঃসন্দেহে বোকামী হবে। বাকী ৫০ ভাগ কমন পাবার জন্য কীভাবে পড়তে হবে? সেটিরও একটি ভালো গাণিতিক পদ্ধতি আছে। সবকিছুতো আর এই লেখায় বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। তবে, আপনাদের বোঝার সুবিধার্থে একটা বিষয় বলি যে, যেসব ধারা থেকে বিগত সালে প্রশ্ন এসেছিলো সেই ধারাগুলোর বাইরেও আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধারা ও ধারণা রয়েছে যেগুলো থেকে এখনো কোনো প্রশ্ন আসেনি। সেই ধারাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। আমি বিগত সালের আসা প্রশ্নগুলোর ছক তৈরি করতে গিয়ে দেখি যে, অনেকগুলো অতি গুরুত্বপূর্ণ ধারা থেকে একবারও প্রশ্ন আসেনি; কিন্তু সেসব প্রশ্ন আসাটা অনেক ন্যায্য। ফলে সেইসকল ধারাগুলো ভালোভাবে পড়ে নিলেই অবশিষ্ট আনুমানিক আরো ৫০ ভাগ প্রশ্ন কমন পেয়ে যাবেন। আপনাদের জন্য আরেকটি চার্ট দিয়ে দেই যে, ধারাভিত্তিক সাজেশন বের করতে চাইলেও সর্বমোট কতটি ধারা আপনাকে অতিরিক্ত পড়তে হবে।
এবার উপরের ছক বা চার্টটি থেকে দেখুন যে, সবগুলো আইন মিলে সর্বমোট ৩৩২টি ধারা-বিধি-অনুচ্ছেদ থেকে প্রশ্ন এসেছিলো বিগত বার কাউন্সিল ও জুডিসিয়ারি উভয়টি মিলে। এর বাইরে একটিবারও প্রশ্ন আসেনি এমন আরো ধারা চিহ্নিত করতে গেলে সর্বমোট ৪৭৩টির বেশি ধারা-বিধি-অনুচ্ছেদ হয় না। আমার নিজের অনেক পরিশ্রমলব্ধ গবেষণা থেকেই বলছি একথা।
অনেকের কাছে মনে হতে পারে যে, ৩৩২টি ধারার পরে আবারো ৪৭৩টি ধারা? চমকে উঠছেন? ভয় পেয়ে যাচ্ছেন? একটু সবুর করুন। মোটেও ভয়ের কিছু নেই। কেননা, যে ৪৭৩টি ধারার কথা বলা হচ্ছে সেটা মূলত ধারণা আকারে বিশ্লেষণ করলে সর্বমোট আনুমানিক ২০০টির বেশি হবে না। ক্যামনে, কীভাবে? সেটাই জানুন নিচের প্যারায়।
দণ্ডবিধি থেকে আমরা বোঝার চেষ্টা করি, আসুন! মিথ্যা সাক্ষ্য সংক্রান্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি শুরু হয়েছে ১৯১ ধারা দিয়ে। শেষ হয়েছে একেবারে ২২৯ ধারায় গিয়ে। এর ভেতরে মাত্র দুইটি ধারা থেকে প্রশ্ন এসেছিলো – ১৯৩ এবং ২১১ ধারা থেকে। তাহলে এর ভেতরে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ ধারা নেই? আছে। যেমন, শুরুর ১৯১ এবং ১৯২ ধারা দুইটিতে মূলত দুইটি সংজ্ঞা দেওয়া আছে যথাক্রমে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া এবং মিথ্যা সাক্ষ্য উদ্ভাবন করা বিষয়ে। আর ১৯৩ ধারায় এসবের শাস্তি একযোগে বলা আছে। আবার ১৯৪ এবং ১৯৫ ধারাতে আরো দুইটি বিশেষ ক্ষেত্রের শাস্তি বলা আছে। ফলে, বিগত পরীক্ষাগুলোতে আসা ১৯৩ ধারাটিই শুধু পড়ে গেলে কিন্তু প্রস্তুতির বেশ ঘাটতি থেকেই যায়। ১৯৩ ধারা জানবেন, কিন্তু ১৯১, ১৯২, ১৯৪ আর ১৯৫ ধারা সম্পর্কে জানবেন না – এটা মানানসই হয় না। উপরন্তু, ধারাগুলো গুরুত্বপূর্ণ এবং ধারাবাহিক সম্পর্কিত ধারা – ধারণার দিক থেকে একটিই বেসিক ধারণা। সুতরাং, ছাড় দেবার কোনোই সুযোগ নেই।
আবার, দণ্ডবিধির জনশৃঙ্খলা বিরোধী অপরাধের অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় থেকে ১৪১-১৬০ পর্যন্ত ধারাগুলো থেকে মাত্র ১৪১ ধারা থেকেই প্রশ্ন এসেছে বিগত সালগুলোতে। অথচ ১৪১ থেকে ১৪৯ প্রতিটি ধারা থেকেই প্রশ্ন আসার মতো বহু প্রশ্ন রয়েছে। দাঙ্গা, দাঙ্গার শাস্তি, মারামারি ও মারামারির শাস্তি এসব ধারা থেকে প্রশ্নও আসেনি। এগুলোও জরুরি।
মডেল টেস্ট অনুশীলন করবেন কীভাবে?
এবার আসি, পূর্ণাঙ্গ মডেল টেস্টগুলো অনুশীলন কীভাবে করবেন সে বিষয়ে সরাসরি কথায়। বাজারে এখন পর্যন্ত মডেল টেস্ট বই আকারে নতুন মাত্র দুইটি বই বাজারে এসেছে। আরো অনেকগুলো আছে যেগুলো মূলত গতবারের বইয়েরই রিপ্রিন্ট বা পুনঃর্মুদ্রন মাত্র। আরো কিছু বই হয়তো প্রকাশিত হবে পরীক্ষার তারিখ দিলে। অনেকেই এসব বই নিয়ে সরাসরি মডেল টেস্ট দিতে ঝাপিয়ে পড়ছেন। অনেকে হয়তো একটার পর একটা মডেল টেস্ট দিতে দিতে শেষও করে ফেলেছেন। কিন্তু, আপনার উচিত হবে – লেখার শুরুতেই বলে আসা পরামর্শটি পালন করে তারপরে মডেল টেস্টগুলোতে অংশ নেওয়া। পরামর্শটি আরেকবার রিমাইন্ডার দিই। প্রথমেই বিগত সালের প্রশ্নগুলো ভালোভাবে রিভিশন দেবেন সংশ্লিষ্ট ধারাটির অন্যান্য তথ্যগুলো বিশ্লেষণ সাপেক্ষে। এরপরেই মাত্র মডেল টেস্টে অংশ নেবেন। একটি করে মডেল টেস্ট দেবেন সময় নিয়ে এবং সাথে সাথে সেগুলোর সমস্ত না পারা প্রশ্নগুলো ভালোভাবে শিখেই মাত্র পরবর্তী মডেল টেস্টে হাত দেওয়া। ধরা যাক, ১ নং মডেল টেস্ট প্রশ্নে আপনি ১৮টি প্রশ্ন একেবারেই পারলেন না। সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর-সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো খুঁজে নিয়ে ভালোভাবে আয়ত্ব করবেন। এরপরে এই মডেল টেস্টটি অন্য আরেকটি মডেল টেস্ট অনুরূপভাবে শেষ করার পরে ফিরে এসে আবারো দেবেন পরের সপ্তাহে। এতো পুরনো পড়াটি আরো পাকাপোক্ত হয়ে উঠবে।
আশা করি, এই নিবন্ধের আলোচনা আপনাদের অনেক কাজে দেবে আত্মবিশ্বাসের সাথে আপনার পড়াকে গুছিয়ে নেবার ব্যাপারে। সবাই ভালো থাকবেন। বার কাউন্সিল পরীক্ষার্থীদের সাফল্য কামনা করি।
লেখক : আইনজীবী ও ‘আইনের ধারাপাত – MCQ মডেল টেস্ট বুক’ এর রচয়িতা এবং ফাউন্ডার – juicylaw.com