মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান :
খাই খাই করে তর জনম গেল তবু তর খাই খাই আর গেল না। চলমান একটি কথা আছে বাঙালিরে বসতে দিলে খাইতে চাই আর খাইতে দিলে শুতে চাই।
আজ ‘আসন্ন ডিসি সম্মেলনে ফৌজদারি অপরাধ আমলে নিয়ে সংক্ষিপ্ত বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষমতা চাইবেন জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)’ সংবাদটি গোচরীভূত হওয়ার পর অনেকটা ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে উপরের কথাগুলো মনে পড়ে গেলো।
যাদের আইন শিক্ষার কোন ব্যাকগ্রাউন্ড নেই, লিগ্যাল প্রিন্সিপ্যাল সম্পর্কে কোন ধারনা নেই তারা অযৌক্তিকভাবে বেআইনি সমাবেশ প্রতিহত করা, অবৈধ দখল উচ্ছেদ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণসহ ‘মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯’ তফসিলভুক্ত ১০৪টি আইনে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে, যা অত্যন্ত হাস্যকর একটি ব্যবস্থা বলে আমার মনে হয়।
দীর্ঘ কঠিন ও দুর্গম পথ পাড়িয়ে দিয়ে মাজদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করা হয় ২০০৭ সালে। একই বছর উক্ত রায় বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন গঠন সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় এবং ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮ সংশোধন করা হয়।
সংশোধিত ফৌজদারি কার্যবিধি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তখনও ডিসি সাহেবদের তথা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছিল। ২০১৯ সালে এসে যখন বিচার বিভাগ তার আপন স্বকীয়তায় অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে আপন মহিমায় এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনই আবারো বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মূল নির্যাসকে ধূলিসাৎ করার জন্য অপতৎপরতা শুরু হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে মোবাইল কোর্টের তৎপরতা যদিও মিডিয়ার মাধ্যমে প্রশংসার দাবীদার তবুও আইনী জ্ঞানের সীমাবদ্ধতায় সাধারন মানুষের ন্যায়বিচার লংঘনের সমূহ সম্ভাবনা থাকে। এবং কিছু ভিডিও দেখে আমার তাই মনে হয়েছে।
জেনে রাখা ভালো, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের বৈধতার প্রশ্নে মামলা গড়িয়েছে হাইকোর্ট বিভাগ পর্যন্ত।২০১৭ সালের ১১ মে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট বিভাগ। একই সঙ্গে ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন (মোবাইল কোর্ট অ্যাক্ট, ২০০৯)-এর ১৪টি ধারা ও উপধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় তা অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ লিভ টু আপিল করার পর আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হাইকোর্টের উক্ত রায় স্থগিত রাখা হয়। বারবার সরকার সময় চাওয়ার পর এরপর থেকে মামলাটি আর কার্যতালিকায় আসেনি। ফলে এ সময়ের মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় হাইকোর্টের রায়ও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। অব্যাহত রয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম।
ডিসি সাহেবরা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২২ ও মাসদার হোসেন মামলায় উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণের তোয়াক্কা না করে এখন বিচারিক এখতিয়ার দাবি করছেন। তারা ফৌজদারি কার্যবিধির বিধি ১৯০ এর ৪ নম্বর উপবিধি বাতিল করে ১ নম্বর উপবিধি সংশোধন করে ‘ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট অ্যান্ড এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট’ যুক্ত করার সুপারিশ করবেন বলে জানা যায়। এছাড়াও উক্ত কার্যবিধির ১৯২ ধারা এবং মামলা বিচারের জন্য প্রস্তুত (Ready for Trial) করতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৫, ১৫৬, ১৫৯, ১৬৪, ১৬৭, ১৯৫-১৯৯, ২০০-২০৪ ধারায় ক্ষমতা প্রদানের সুপারিশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রীয় খাতে দুর্নীতি একটি বহুল আলোচিত বিষয়।যেখানে এদেশে দুর্নীতি কিংবা বকশিশ সরকারী অফিসের একটি নিত্তনৈমিত্তিক বিষয় সেখানে আইন পরিবারের মানুষ হিসেবে আমি হলফ করে বলতে পারি, বেশিরভাগ বিচারক এখনো অত্যন্ত নিষ্ঠা ও মানবিক হৃদয় ধারণ করে মানুষের অধিকার রক্ষায় দিনরাত নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। অথচ সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে তুলনামূলক সবচেয়ে কম সুবিধাভুগী হচ্ছে বেঞ্চের কর্মবীর এসব সদস্যবৃন্দ।
সরকারের কাছে উদাত্ত আহবান থাকবে বিচারবিভাগের স্বাধীনতা ও আপন স্বকীয়তা রক্ষায় মোবাইল কোর্টও যেন বিচার বিভাগের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। এতে জুডিশিয়্যাল ম্যাজিস্ট্রেটরা তাদের আইনী ও বিচারিক জ্ঞান প্রয়োগ করলে সাধারণ মানুষের আরো উপকার হবে বলে আমার বিশ্বাস।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ফেনী ইউনিভার্সিটি।