এম. এ. সাঈদ শুভ

নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা এখনই বন্ধ হওয়া উচিৎ

এম. এ. সাঈদ শুভ:

নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা একেবারেই সংবিধানের স্পষ্ট লঙ্ঘন। কিছুদিন আগে মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট এর হাইকোর্ট বিভাগ এই রায় ঘোষণা করেছেন। মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ আরো বলেছেন, নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা অবৈধ। বর্তমানে মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট এর আপীল বিভাগে এই মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। একারণে এই বিষয়ে আইনী ও সাংবিধানিক ব্যাখ্যায় যাবো না। রাষ্ট্রের একজন সচেতন নাগরিক এবং আইনের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমার খুবই সাধারণ কিছু পর্যবেক্ষণ এই লেখার মূল উপজীব্য।

আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে আপনি একজন আইনের শিক্ষার্থী হিসেবে বিষয়টাকে কিভাবে দেখেন? আমি কোনো রাখঢাক ছাড়াই বলবো নির্বাহী বিভাগ দ্বারা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা এখনই বন্ধ হওয়া উচিৎ। এটা হওয়া উচিৎ নির্বাহী বিভাগের স্বার্থেই। এতে নির্বাহী বিভাগের ভাবমূর্তিই উজ্জ্বল হবে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ এই বিভাগ অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকান্ডে ভালভাবে মনোযোগ দিতে পারবে। মাঝে মাঝে জনতার রোষানলে পড়া থেকেও বেঁচে যাবে। ইদানিং মাঝে মাঝেই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের জনতার রোষানলে পড়ার খবর পত্রপত্রিকায় সংবাদ হচ্ছে। আচ্ছা কখনো শুনেছেন উত্তেজিত জনতা কখনো তাঁদের বিরুদ্ধে রায় হওয়ায় আদালতের কোনো বিচারকের ওপর চড়াও হয়েছেন?

আসলে বিচার একটি রাজনীতি নিরপেক্ষ বিষয়। বিচারালয় তাই চোখ বন্ধ রেখে ন্যায়দণ্ড ধারণের অঙ্গীকারে আবদ্ধ একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান। নিরপেক্ষতার শপথ নিয়ে দেশের প্রচলিত আইনে বিচারকাজ নিষ্পন্ন করেন বিচারকেরা। কিন্তু বিচারকেরা যে আইনের ভিত্তিতে বিচার করেন, সে আইন তৈরি করেন রাজনীতির মানুষেরাই এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাউকে অভিযুক্ত করে মামলা দায়েরও পুরোপুরি বস্তুনিষ্ঠ ও রাজনীতি নিরপেক্ষ, তা হলফ করে বলা যায় না।

আবার বিচারকেরা রক্ত-মাংসের মানুষ, তাঁদের চোখ-কান সব সময় খোলা থাকে, বাইরের প্রবহমান আলো-বাতাস ও চাপ-তাপ তাঁদেরও প্রভাবিত করতে পারে। কারণ তাঁদেরও আবেগ, অনুরাগ, রাগ-বিরাগ, নানা মানবিক দুর্বলতা থাকা স্বাভাবিক। তা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ বিচারকদের ন্যায়পরায়ণতা, বিচারবোধ, সততা, সৎসাহস এবং সুগভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ওপর নিঃশর্ত বিশ্বাস স্থাপন করে থাকে। বিশ্বব্যাপী এটিই স্বীকৃত নিয়ম ও রীতি।

এত কিছুর পরেও মানুষ আদালতকেই শেষ ভরসাস্থল হিসেবে মনে করে থাকে। বিচারকদের প্রতি মানুষের আস্থা এখনো অনেক। মানুষ যুগ যুগ ধরে বিচারকদের ধৈর্য, সততা, সাহস, ইন্টেগ্রিটি সম্পর্কে জেনে আসছে। বিচারকেরা Principle of Natural Justice অনেক বছর ধরে অধ্যয়ন করে এটা ব্যাপকভাবে উপলব্ধি করে আদালতে সমাসীন হয়ে থাকেন। বিচারকেরা অনেক আইনকানুন শুধুমাত্র পাঠ করেই আসেনা, আইনগুলোর মূল স্পিরিটকে ধারণ করে এজলাসে বিচার করতে বসেন।

অনেক সময় রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বিচারকদের কলম ন্যায়পর আদেশ, রায়ই দিয়ে থাকেন। একবার বঙ্গবন্ধু সুপ্রীম কোর্ট এর সেসময়ের এক বিচারপতিকে প্রশ্ন করেছিলেন বিচারকদের কোন গুনটা থাকা অপরিহার্য? উনি বলেছিলেন সততা। বঙ্গবন্ধু ঐ বিচারপতিকে প্রতিউত্তরে বলেছিলেন সততা তো সব মানুষের মধ্যেই থাকতে হবে। কিন্তু আলাদা করে বিচারকদের যে অপরিহার্য গুনটি থাকতে হবে তা হলো সাহস ও নিরপেক্ষতা। বিচারকদের এই গুনগুলোও বছরের পর বছর ধরে প্রশংসিত।

তবে এটা সত্য যে, ইতিহাসে বিচারালয় ন্যায়দণ্ড ধারণের অঙ্গীকার সব সময় সঠিকভাবে পালন করতে সক্ষম হয়েছে তা দেখা যায় না, কখনো কখনো এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। এই ব্যতিক্রম ঘটেছে রাজনীতির কারণে, আবার পরে রাজনীতিই তা শুধরে নিয়েছে। মানুষ এটাও উপলব্ধি করে বিচারালয়কে কখনোই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়নি। মানুষ কখনো অন্যায়ভাবে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হলে রাজনীতিকেই দোষারোপ করে। এটি বিচার বিভাগের প্রতি আস্থার একটি অন্যতম উদাহরণ। এখনো বড় কোনো ঘটনা ঘটলেই দলমত নির্বিশেষে মানুষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত চায়। বিচার বিভাগের প্রতি আস্থার এটিও একটি জ্বলন্ত উদাহরণ।

সুতরাং এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিচারকদের দ্বারাই বিচারকার্য পরিচালিত হতে হবে। বিচার করতে চাওয়া প্রায় সব মানুষেরই একটা সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষ ক্ষণে ক্ষণে অন্যের বিচার করে ফেলে। কিন্তু কারো বা কোনো কিছুর বিচার করতে চাইলেই কেউ বিচার করে ফেলতে পারবে? আপনি সারাজীবনে কোনো দিন চিকিৎসা বিজ্ঞান না পড়েই কি কোনো রোগীর সার্জারি করতে পারবেন? হয়তো পারবেন। সেক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যু অবধারিত নয় কি? তাহলে এখন আপনাকেই প্রশ্ন করি। মোবাইল কোর্ট এর বিচার কার দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিৎ?

লেখক : সিনিয়র সহকারী জজ, রাজশাহী।