মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান:
গত দু’দিন আগে ‘মোবাইল কোর্ট বিচার বিভাগের হাতে ফিরিয়ে দেয়া হোক’ এই শিরোনামে লিখা প্রকাশ হওয়ার পর প্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেই গঠনমূলক বিতর্ক করেছেন আর অনেকে আমাকে ব্যাক্তিগত বিশদগার করেছেন। জাতি হিসেবে আমরা এমন যে, কোন বিষয় আমাদের স্বার্থে লাগলে আমরা তা সহজভাবে নিতে পারিনা।
যারা সমালোচনা করেছেন তাদের প্রশ্ন কিংবা মন্তব্যের জবাব নিন্মে কিছু অংশ (সংকলিত) তুলে ধরার চেষ্টা করেছি:-
বাংলাদেশেই হয়তো সম্ভব হচ্ছে বুয়েট বা মেডিক্যাল থেকে পাস করা একজন বিসিএস দিয়ে executive Magistrate হয়। যা রাষ্ট্রের কেবল দক্ষ মানব সম্পদ (Human Resource) এর অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। সে রাষ্ট্রের জন্য মহা মূল্যবান সম্পদ কিন্তু রাষ্ট্রীয় শিক্ষা ও নিয়োগ কাঠামোর দূর্বলতায় তাঁর মেধাকে রাষ্ট্র সঠিকপথে কাজে লাগাতে পারছেনা।
একজনের কথার জবাব দিতে গিয়ে বললাম-Legislature আইন প্রণয়ন করবে , Judiciary আইন তথা সংবিধানের গাইড হিসেবে কাজ করবে, বিচার করবে এবং আইনের ব্যাখ্যা দেবে, আর Executive সে অনুযায়ী রাষ্ট্রে আইনের প্রয়োগ করবে। সংবিধানে রাষ্ট্রের প্রত্যেক অঙ্গ (organ) এর কাজগুলো নির্দিষ্ট করে বলাও আছে।
এটাকে কেউ কেউ উত্তরে বলেছেন–এটা ক্ল্যাসিক্যাল ধারণা। আমি বলব উন্নত বিশ্বের অনেকগুলো রাষ্ট্র এখনও separation of power এবং check & balance যুগপৎভাবে কার্যকর করে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কার্যকরিতা টিকিয়ে রেখেছে। শতাব্দীর পরিবর্তনে নতুন কোন ফর্মুলার অভিষেক ঘটলে তখন তা দেখা যাবে। যুগের প্রয়োজনে হয়তো আমরাও আমাদের সাংবিধানিক কাঠামো তখন পরিবর্তন করে নিতে হবে।
কেউ কেউ বলেছেন সরকার যাকে চাইবে তাকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেসি দিতে পারবে। আমি বলব এখানেও আপনার বা আপনাদের জানার ভুল আছে – সরকার কেবল প্রশাসনের নির্দিষ্ট পদের লোকজনকে তা দিতে পারে, যাকে তাকে নয়। পাশাপাশি Cr.PC ১০ ধারাটা ভালো করে দেখে নিতে অনুরোধ করব।
আরেক মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বলেছি: আপনারা যেহেতু Jurisprudence তথা আইনবিজ্ঞান জানেন না , আইন এবং ন্যাচেরাল জাস্টিস এর প্রিন্সিপ্যাল গুলো সম্পর্কে ওয়াকেবহাল নন, আপনারা যেহেতু আইন ব্যাখ্যার ক্যাপাবিলিটি অর্জন করতে পারেন নি, আপনারা হয়তো আইনের কেবল literal interpretation করতে পারবেন কিন্তু Golden Rule, mischief rule এবং harmonious construction করতে কখনোই পারবেন না।
আপনারা যেহেতু কেউ বায়োকেমিস্ট্রি পড়েছেন, কেউ মাইক্রোবায়োলজি, কেউ এপ্লাইড ফিজিক্স, কেউ ব্যবসা, কেউ বাংলা, কেউ ইংলিশ, কেউ ইতিহাস, কেউ ইসলামের ইতিহাস, কেউ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, কেউ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং, কেউ ইইই পড়েছেন; সেহেতু এসব বিচার আচারে এসে আপনারা মানুষকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করবেন এর বেশি কিছু নয়। যেমন ডাক্তার সেজে হাতুড়ে ডাক্তার চিকিৎসা করলে রোগীর যা হয় আর কি! হাতুড়ে ডাক্তারেরও উদ্দেশ্যও কিন্তু রোগী ভালো করা অর্থাৎ জনকল্যাণ। তাই বলে আপনি হাতুড়ে ডাক্তার দিয়ে রোগীর চিকিৎসা করাবেন? প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের জন্যকল্যান হবে নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা যার আছে তিনি যদি সে কাজ করেন।
Executive এর লোকজন অত্যন্ত দক্ষ তাতে কোন সন্দেহ নেই কিন্তু এখনো তারা চিন্তার বিশালতা আনতে পারেনি, রাষ্ট্রের দূর্বল নিয়োগ কাঠামোকে উপজীব্য করে যুগে যুগে কিভাবে জুডিশিয়ারীর উপর কর্তৃত্ব করবেন আপনারা কেবল সেই চিন্তায় থাকেন। কেউ কেউ মোবাইল কোর্ট চালানোর জন্য অমেরিকার জুরী সিস্টেমের কথা বলেছেন। সেখানে জুরী সিস্টেম থাকলে ওনারা কেন মোবাইল কোর্ট চালাতে পারবেন না এমন মন্তব্য করেছেন।
সেটার উত্তরে বলব– আপনাদের মোবাইল কোর্ট এর সাথে ঐ জুরী সিস্টেমের আকাশ পাতাল পার্থক্য আছে। আমরিকাতে (USA) মামলার পক্ষের আবেদনের ভিত্তিতে কেবল জুরীদের নিয়োগ করা হয় অন্যথায় নয়। জুরীরা শুধু overall পর্যবেক্ষণ করে বিচারকের কাছে সংখ্যাগরিষ্ট মতামত দেবেন কিন্তু আইনের ব্যাখ্যা করবেন ঠিকই বিচারক, রায়ও দেবেন বিচারক। তারমানে এতেসমাজের বিভিন্ন দক্ষ শ্রেনী পেশার মানুষের মতামত ও বিচারকের মতামত যখন একীভূত হবে তখন ন্যায়বিচার আরো সুসংহত হয় বলে আমার মনে হয়।
কিছু জটিলতার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে K.M Nanavati Vs. State of Maharashtra মামলার পর ১৯৭৩ সালে আইন সংশোধন করে জুরির মাধ্যমে বিচারের নিয়ম তুলে দেয়া হয়। বাংলাদেশে তো এটা নাই–ই কিন্তু এর সাথে মোবাইল কোর্টের সামঞ্জস্য কোথায়, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়।
কেউ কেউ বলেছেন বিচার বিভাগ এমনিতে মামলাজটে(back log) ন্যুব্জ, তাহলে মোবাইল কোর্ট কেমনে চালাবে? প্রথমে তাঁদের উদ্দেশ্যে আমি বলব এই অজুহাতে কি আপনারা মোবাইল কোর্টের মত আদালত যার সাথে মানুষের অধিকারের প্রশ্ন জড়িত, সেটা কি আইনঙ্গনের হাতুড়ে বিচারকদের হাতে তুলে দেবেন??
এবার আপনাদের মামলা জটের বিষয়ে বলি– বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের সেবায় মাত্র ১০ বিচারক। অথচ এই হার যুক্তরাষ্ট্রে ১০৭ এবং কানাডায় ৭৫, বিচারক ও মামলার অনুপাত দাঁড়ায় আপিল বিভাগে ১: ৩৩১৩ এবং হাইকোর্টে ১: ৫৩৫৬। হাইকোর্টের বিচারপতিরাই মামলার ভারে সবচেয়ে বেশি জবুথবু। নিম্ন আদালতের বিচারক ও মামলার অনুপাত ১: ১৯৯৬।
তাছাড়া মামলাবাজ এক জেনারেশনের মধ্য দিয়ে আমরা সময় পাড় করছি। কথায় কথায় অহেতুক মামলা করার প্রবণতাও মামলাজট বাড়ায়। মামলা বাড়লেও যদি বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তি (ADR ) কে আরো গতিশীল করা যায়, গ্রাম আদালত ও কনসিলিয়েশন বোর্ড কে আরো কার্যকর করা যায় তাহলেও মামলা জট অনেকাংশেই কমানো সম্ভব।
আবার অনেক দেশের সামাজিক–রাজনৈতিক পরিস্থিতির চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থা শোচনীয়। পুলিশ ও প্রশাসনের দুর্নীতিগ্রস্ততা, ক্ষমতার অপব্যবহার, অপশাসনে বিশ্বের অন্যদের সঙ্গে তুলনা চলে না। এসব অনিয়মের চাপ পড়ে বিচার বিভাগের উপর। আপনাদের জ্ঞাতার্থে বলি সাগর–রুনী হত্যা মামলার প্রতিবেদন গত সাত বছরে ৬৩ বার সময় নিয়ে এখনো পর্যন্ত জমা দিতে পারেনি তদন্ত সংস্থা।
এসব আইন অঙ্গনের বাইরের লোকদের বুঝতে হলে মামলার ট্রায়াল প্রসিডিউর সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে অন্যথায় আপনাদের বুঝানো অসম্ভব।মামলা জটের অন্যতম আরেকটি কারণ মান্দাতা আমলের পুরনো আইনগুলো। বিশেষ করে ফৌজদারী ও দেওয়ানী পদ্ধতিগত আইনগুলো পরিবর্তন করে যুগোপযুগী আইন প্রণয়ন করলে মামলাজট কমানো সম্ভব।
মামলাজটের সবচেয়ে বড় কারণ মামলার অনুপাতে বিচারকের তীব্র সংকট এবং অবকাঠামোগত মৌলিক সুবিধাদির অপ্রতুলতা।
এখন আমার প্রশ্ন এসব সরকারী সিদ্ধান্ত ও প্রশাসনিক কাজের বাস্তবায়ন কি আদালতে কিংবা এজলাসে বসে বিচারকগন করবেন? অথবা বিচারকদের কি সে এখতিয়ার আছে? বিনয়ের সাথে জবাবটা চাই সমালোচকদের কাছে।
বিনয়ের সাথে বলব আমাদের সকল প্রশাসনের দক্ষ সদস্যবৃন্দের প্রতি ১০০% সম্মান আছে কিন্তু আপনারা বিচার করতে না আসাটা রাষ্ট্র ও জনগনের জন্য মঙ্গলজনক হবে। জোর করে কাঁঠাল গাছে আম ফলানো যায় না। আর যারা আইনী জ্ঞান রাখেন রাষ্ট্রের বিচারের কাজটা পরিপূর্ণভাবে তাদের কাঁদে তুলে দেন। পাশাপাশি বিচারকাজে বিচারককে নিজেদের এখতিয়ার অনুযায়ী সহায়তা দিয়ে যান, তাতে দেশ ও দশের জন্য মঙ্গলজনক।
মোদ্দাকথা যার কাজ সে যদি ঠিকভাবে পালন করেন তাহলেই কেবল সত্যিকার অর্থে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠন সম্ভব।
লেখক- সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ ও প্রক্টর, ফেনী ইউনিভার্সিটি