এম শাহনেওয়াজ মনির :
ধরুন কোন এক দেশে জন্যসংখ্যার অনুপাতে ডাক্তারের সংখ্যা কম৷ জনগনের চিকিৎসা জন্য বর্তমানে প্রশিক্ষিত পর্যাপ্ত ডাক্তার নেই। দেশ কি ভালভাবে প্রশিক্ষিত ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ানোর ব্যবস্থা করবে, নাকি শিক্ষক, প্রকৌশলী দিয়ে ২/৩ মাসের ট্রেনিং দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে?
আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো প্রশিক্ষিত ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ানোর ব্যবস্থা করবে। যদি নতুন দক্ষ ডাক্তারের সংখ্যা বাড়াতে সময় লাগে তাইলে বিদ্যমান ডাক্তারদের দিয়ে আরো হাসপাতালের ব্যবস্থা করে একটু বেশি সময় চিকিৎসা করানোর ব্যবস্থা করবে। সেটাও সম্ভব না হলে শিক্ষক, প্রকৌশলী দিয়ে ১/২ মাস যেনোতেনোভাবে চিকিৎসা চালু রাখা যেতে পারে। তবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পর্যাপ্ত দক্ষ ও প্রশিক্ষিত ডাক্তার নিয়োগের ব্যবস্থা করবে৷ যদিও শিক্ষক, প্রকৌশলী দিয়ে চিকিৎসার কোয়ালিটি কেমন হবে তা সহজেই অনুমেয়! এর মধ্যে প্রশ্ন উঠতে পারে শিক্ষক, প্রকৌশলী তাহলে তাদের আসল কাজ শিক্ষা দান করা, ইঞ্জিনিয়ারিং কি হবে৷! এর সঠিক উত্তর আমার আসলেই জানা নেই! পর্যাপ্ত ডাক্তার (শিক্ষিত, প্রাপ্ত ও দক্ষ ) নিয়োগ হলে ২/৩ মাসের ট্রেনিং প্রাপ্ত শিক্ষক, প্রকৌশলী যাদের দ্বারা চিকিৎসা তাতক্ষনিকভাবে বন্ধ করে দিতে হবে।
আমার পরিচিতদের হাতে গোনা কয়েকজন মনে করেন বিচার করার জন্য, আইনের চর্চা করার জন্য আইনের ডিগ্রী বা আইনগত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দরকার নেই। শুধু ৬ মাসের ট্রেনিং নিয়েই বিচার করা যায়, আইন চর্চা করা যায়৷
আইন না পড়েই, আইনের নীতি, আইনের স্পিরিট যদি সঠিকভাবে অনুধাবন না করেই, জুডিসিয়াল মাইন্ড টার্মটি অনুধাবন না করেই শুধুমাত্র কয়েকমাসের ট্রেনিং নিয়েই বিচার করা যায়, আইনচর্চা করা যায় তাহলে আমার অভিমত দেশে বিচারক হওয়ার জন্য এবং আইনজীবী হওয়ার জন্য এলএল বি/এল এল এম ডিগ্রী থাকার শর্ত তুলে দেয়া যেতে পারে । ৬ মাসের আইন বিষয়ক কোর্স দিয়েই পরীক্ষা দিয়েই বিচারক নিয়োগ দেয়া হোক এবং আইনজীবী সনদ দিয়ে প্রাকটিসের অনুমতি দেয়া হোক। এলএলবি/এলএলএম ডিগ্রীর জন্য শুধু শুধু রাষ্ট্রের, জনগনের এত এত অর্থ ও সময়ের অপচয় করার দরকার কি? বার এসোসিয়েশন গুলোর এত এত টাউট ধরার দরকার কি?
সাম্প্রতিক সময়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কয়েকটি বিচারের নমুনা দেখে মনে হল কিছু আইনগত বিষয় আমার আরেকটু ক্লিয়ার হওয়া প্রয়োজন । আমরা সবাই আইনের শাসনের কথা বলছি সেই আইন অনুযায়ী কি আমরা শাসন করছি, বিচার করছি?
গত ১২ই জুন কুমিল্লার নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে চোর ও ছিনতাইকারী চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ পরে তাদের চারজনকে এক বছর করে এবং একজনকে ৮ মাস মাসের বিনাশ্রম সাজা প্রদান করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। ( খবর – দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক কুমিল্লার কাগজ)
মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ এর ৬(১) ও ৭ ( ২) ধারা অনুযায়ী অনুযায়ী ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট শুধুমাত্র তার সম্মুখে সংঘটিত বা উদ্ঘাটিত তপশিলভুক্ত অপরাধ আসামী দোষস্বীকার করলে তিনি উক্ত অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলেই আমলে গ্রহণ করে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে, স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে আসামী ও উপস্থিত দুইজন সাক্ষীর স্বাক্ষর/ টিপ সই নিয়ে আইন অনুমোদিত সাজা দিতে পারবেন। অপরাধ যদি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী ম্যাজিস্ট্রেট এর সামনে সংঘটিত বা উদঘাটিত না হয় বা অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি দোষ স্বীকার না করে অথবা অপরাধ যদি মোবাইল কোর্ট আইনের তপশীলভূক্ত না হয় তাহলে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে সাজা দিতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বিচারের জন্য নিয়মিত আদালতে পাঠাতে হবে। এই বিষয়টি মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের মাধ্যমে আরো পরিষ্কার করা হয়েছে।
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন বাংলাদেশ সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে বলা আছে আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষতঃ আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।
অর্থাৎ কাউকে আইন অনুযায়ী ব্যতীত জেল, ( স্বাধীনতা হানি), জরিমানা ( সম্পত্তি হানি), করা যাবে না। পাঠকদের সুবিধার্থে বলে রাখা ভালো জেল, জরিমানা ছাড়াও বিভিন্নভাবে স্বাধীনতা, সম্পত্তির হানি ঘঠতে পারে।
মোবাইল কোর্ট আইনের তপশিলে ( বাংলাদেশ কোড অনলাইন ভার্সন দেওয়া) দেওয়া প্রায় ১০০ টি আইনের মধ্যে চোর ছিনতাইকারীকে পুলিশ ধরার পর পরবর্তীতে ভ্রাম্যমান আদালত সাজা দিতে পারে এমন বিধান আমি পাই নাই। এই বিষয়টি মোবাইল কোর্ট আইন এর আওতার বাইরে বলে আমার ব্যক্তিগত অভিমত। এখতিয়ার বহির্ভূত সাজা যদি দেওয়া হয় তা সম্পূর্ণরপে বে-আইনী। অপরাধ করলে সাজা পেতে হবে। তবে সেটার জন্য যেই আইন আছে যেই আদালত আছে সেই আদালতে সেই আইনের অধীনে বিচার হতে হবে। এই বিষয়টি যাদের নূন্যতম আইনের জ্ঞান আছেন তারা সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন।
এ রকম বেশ কয়েকটি সাম্প্রতিক ঘঠনা পত্রপত্রিকায় ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। পত্রিকাগুলোর নিউজ গুলি পুরোপুরি সত্য হলে এই ঘঠনায় আইনের অপপ্রয়োগ হয়েছে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে বলে আমার ব্যক্তিগত অভিমত। পত্রিকাগুলোতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বিষয়ক সাজার বিষয়টি নিউজ করার সময় অবশ্যই কোন আইনের কোন ধারায় কি সাজা দেওয়া হয়েছে তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা উচিৎ। এতে মোবাইল কোর্টের আওতা ও ক্ষমতা নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি ও ভুল ধারণা সৃষ্টি হবে না।
মানুষ ভুলের উর্ধ্বে নয়। ১০০ টি কাজ করতে গেলে ১/২ টি ভুল হতেই পারে। তবে, যখন ভুলের সংখ্যা অগ্রহণযোগ্য ভাবে বেড়ে যায় তখন কাজটি সম্পাদনকারী ব্যক্তির দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠা খুবই স্বাভাবিক।
আমার ব্যক্তিগত অভিমত আইন বুজে, আইনের স্পিরিট বুঝে আইন অনুযায়ী, সংবিধান অনুযায়ী সঠিকভাবে ন্যায়বিচার করার জন্য বা আদালতে আইনের প্রাকটিস করার জন্য আইনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও আইনের ডিগ্রীর বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের মানু্ষের অপরাধ প্রবনতা, সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় মোবাইল কোর্টের প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকারিতা সর্বজনস্বীকৃত। ভারত, পাকিস্থান সহ পৃথিবীর অনেক দেশেই জুডিসিয়াল অফিসার পরিচালিত মোবাইল কোর্ট রয়েছে এবং বেশ ভালভাবেই কাজ করছে। মোবাইল কোর্ট আইনের বেশ কয়েকটি ধারা নিয়ে ৩ টি রীট পিটিশন দায়ের হয় এবং ২০১৭ সালের ১১ মে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাস সমন্বয়ে গঠিত গঠিত হাইকোর্ট ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের ৫, ৬ (১), ৬ (২), ৬ (৪), ৭, ৮ (১), ৯, ১০,১১, ১৩ ও ১৫ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মর্মে রায় দিয়েছেন । হাইকোর্ট বিভাগ রায়ের মাধ্যমে মোবাইল কোর্টের প্রয়োজনীয়তা বেশ গুরুত্বের সাথে আলোচনা করেছেন এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এর মাধ্যমে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা অবৈধ ঘোষনাসহ মোবাইল কোর্ট আইনের কয়েকটি ধারা অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন। একইসাথে মোবাইল কোর্ট জুডিসিয়াল অফিসারদের মাধ্যমে পরিচালনা করার পক্ষে রায় দিয়েছেন। পরবর্তীতে সরকার উক্ত রায়ের বিপক্ষে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে আপীল দায়ের করলে আপীল বিভাগ আপীল নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করেছেন। বিষয়টি আপীল বিভাগে বিচারাধীন। সুতরাং মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগ মোবাইল কোর্ট নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দের মাধ্যেমে পরিচালনা সংক্রান্ত হাইকোর্টের অবৈধ ঘোষনা ও জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দের মাধ্যমে পরিচালনা সংক্রান্ত রায় সঠিক কিনা, সাংবাদিকভাবে বৈধ কিনা তার বিচার করবেন।
বিঃ দ্রঃ এই লেখাটি কোন ব্যক্তি বা কোন সার্ভিসকে ছোট করে লেখার জন্য নয়। একজন আইনের ছাত্র হিসেবে দেশের সচেতন একজন নাগরিক হিসেবে আইনগত ও সাংবিধানিক তাড়না থেকেই লিখাটি লেখা। আমার আইনগত বিশ্লেষণে ভুল হতে পারে। যুক্তিসঙ্গত ভিন্নমতকে স্বাগত।
লেখক- সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।