অ্যাডভোকেট মুরাদ মোর্শেদ:
পত্র-পত্রিকা পড়েন বা দেশের খবর নিয়মিত রাখেন তাদের সবার কাছেই ১৪৪ ধারা জারি হবার খবর একটা কমন খবর। ১৪৪ ধারা জারি করা হয় যেন একটি নির্দিষ্ট স্থানে আশঙ্কাজনক কোনো বিপদ না ঘটতে পারে। ধরা যাক, দেশের প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দল একই দিনে একই স্থানে সমাবেশ বা জনসভা ডেকেছে। সেখানে চরম প্রতিপক্ষমূলক দল দুইটির জনসভাকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে এমন আশঙ্কায় ১৪৪ ধারা জারি করে উভয় পক্ষকেই সেখানে হাজির হওয়া থেকে এবং অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটা থেকে বিরত রাখা হয়। তার মানে একটি অপরাধ বা শান্তি বিঘ্নিত হবার সম্ভাব্য একটি ঘটনাকে আগেই প্রতিরোধ করা হয়। এরকম আরো বেশ কিছু বিষয় আছে যেখানে সম্ভাব্য বড় অপরাধকে প্রতিহত করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া যায়। এবার সে সম্পর্কেই আলোচনা। তার সাথে আরো আলোচনা হবে, ফৌজদারি অপরাধ দমনে বিচার বিভাগের পাশাপাশি অবিচ্ছেদ্য অংশ পুলিশ বিভাগের বিচার বিভাগের সাথে সম্পর্কিত বিষয়ে পুলিশের তদন্ত ক্ষমতা ইত্যাদি প্রসঙ্গে। ‘অপরাধ দমন’ শীর্ষক ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৬-১৫৩ এবং পুলিশের নিকট সংবাদ প্রদান করা ও তাদের তদন্ত ক্ষমতা সম্পর্কে ১৫৪ থেকে ১৭৬ পর্যন্ত এর বিস্তৃতি।
মনে আছে নিশ্চয়ই যে, দণ্ডবিধিতে জনশৃঙ্খলাবিরোধী অপরাধ সম্পর্কে একটি অধ্যায় ছিলো। বেআইনি সমাবেশ, দাঙ্গা এবং মারামারি – এই তিনটি অপরাধ উল্লেখে দণ্ডবিধিতে উক্ত ১৪১-১৬০ ধারা পর্যন্ত জনগণের শান্তি যেন বিঘ্নিত না হয় সেদিকে খেয়াল রেখে এই ধারাগুলোর অবতারণা। আরেকটু গভীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বোঝা যায় যে, জনশান্তি বিঘ্নকারী অপরাধগুলো মূলত আরো বড় অপরাধের কোনো না কোনো প্রস্তুতির অংশ।মূল বড় অপরাধ সংঘটিত হবার আগেই অপরাধটিকে যেন প্রতিহত বা প্রতিরোধ করা যায় সে বিবেচনাতেই এগুলোকে ফৌজদারি অপরাধের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে এসবের শাস্তির বিধান করা হয়েছে। অনুরূপভাবে, ফৌজদারি কার্যবিধিতেও এ সম্পর্কে বিধান আছে ‘অপরাধ দমন’ শিরোনামে। খুব কমন কথা আমরা সকলেই জানি – Prevention is better than cure. কথাটি আমরা ছোটবেলায় পড়েছিলাম আমাদের অসুখ-বিসুখ বা স্বাস্থ্য সম্পর্কে। কিন্তু এই কথাটিকে অপরাধের ক্ষেত্রেও আপনি সমরূপে প্রযোজ্য বলে গণ্য করতে পারেন। যেমন, একটি অপরাধের সম্ভাবনা বা আশংকা আছে, তা যদি অপরাধটি সংঘটিত হবার আগেই থামিয়ে দেয়া যায়, তা নিঃসন্দেহে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক।সেই বিবেচনাতেই ফৌজদারি কার্যবিধির অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় বা ভাগ হলো ‘অপরাধ দমন’ সংক্রান্ত ভাগ।
তো, এই ‘অপরাধ দমন’ শীর্ষক ফৌজদারি কার্যবিধির এই ভাগটির বিস্তৃতি ১০৬-১৫৩ পর্যন্ত, যার ভেতরে কার্যবিধির ৮ থেকে ১৩ অধ্যায়গুলো আছে। অধ্যায়গুলোর শিরোনামসমেত ধারাগুলোর বিস্তৃতি একটি চিত্র আপনাদের জন্য তুলে ধরলে নিশ্চয়ই কাজে দেবে। দেখুন।
অধ্যায় ৮ [১০৬-১২৬ক] : শান্তিরক্ষা ও সদাচরণের জন্য মুচলেকা প্রসঙ্গ
অধ্যায় ৯ [১২৭-১৩২] : বেআইনি সমাবেশ
অধ্যায় ১০ [১৩২ক-১৪৩] : গণউৎপাত
অধ্যায় ১১ [১৪৪] : উৎপাত বা আসন্ন বিপদে জরুরি ক্ষেত্রে অস্থায়ী আদেশ
অধ্যায় ১২ [১৪৫-১৪৮] : স্থাবর সম্পত্তি বিষয়ক বিরোধ
অধ্যায় ১৩ [১৪৯-১৫৩] : পুলিশের নিবারণমূলক ব্যবস্থা
এর প্রতিটি অংশেই একটি অপরাধ হবার সম্ভাবনা আছে এমন পরিস্থিতিতে সেটি প্রতিরোধ করা সম্পর্কে করণীয় নিয়ে বলা আছে মূলত। কার্যবিধির চতুর্থ ভাগ এটি। এর শিরোনামটাই হলো – ‘অপরাধ দমন’; মানে অপরাধ হবার আগেই সেটিকে নিয়ন্ত্রণে আনা। সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এই অংশের তাৎপর্য অনেক ব্যাপক। শিরোনামটি মনে রেখে এর ভেতরের অধ্যায়গুলোর শিরোনামগুলো ভালো করে লক্ষ্য রাখলে এই অধ্যায়টি সহজেই মনে রাখতে পারবেন।
সবশেষ ১৩ অধ্যায়টিকে পাত্তা দেবার কিছু নেই, সেখানে অপরাধ দমনে পুলিশের করণীয় সম্পর্কে বলা আছে। ওদিকে শুরুর অধ্যায়ের ১০৬ ধারাটি বাদে মূলত মূলত জেলা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের ক্ষমতা সম্পর্কে বলা আছে, কোনো বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট এর ক্ষমতা বা কার্যাবলী এর বিষয়বস্তু নয়। মনে রাখা সহজ। আবার, ১২ অধ্যায়ে দেখুন – এর বিষয়বস্তু স্থাবর সম্পত্তি। স্থাবর সম্পত্তি প্রসঙ্গ এলেই অনেকের মনে হতে পারে এটি দেওয়ানি কার্যবিধির বিষয়। কিন্তু, স্থাবর সম্পত্তি সংক্রান্ত কোনো বিরোধে ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হতে পারে। সে সংক্রান্ত কোনো বড় অপরাধ সংঘটিত হবার বিপদ এড়াতে এই অধ্যায়ের অবতারণা। ১৪৪ ধারাসমেত এই ১২ অধ্যায়টি ভালোভাবে পড়তে হবে।এতো গেলো এই অংশের প্রথম অংশ।
দ্বিতীয় অংশটি হলো ১৫৪-১৭৬ ধারা। এটি কার্যবিধির পঞ্চম ভাগ যেখানে ফৌজদারি কার্যবিধির আরেকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচিত হয়েছে। এর শিরোনাম ‘পুলিশকে সংবাদ প্রদান ও তাদের তদন্ত ক্ষমতা’। শিরোনামেই বিষয়টি স্পষ্ট। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় পুলিশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের সমস্ত কার্যকলাপের সীমা-পরিসীমা এই ধারাগুলোতে অনেক বিস্তারিত বর্ণনা আছে। এগুলো নিয়ে কোনো প্রাথমিক স্তরের আলোচনা করা নিরর্থক, কেননা, এর সবগুলো ধারাই আপনাকে ঠোটস্থ রাখতে হবে। গুরুত্ব বিবেচনায় ১৫৪-১৭৬ ধারাগুলোর শিরোনাম বা বিষয় উল্লেখ করে একটি ছক দিয়ে রাখলাম বিগত সালগুলোতে প্রশ্নের পরিমাণ উল্লেখ করে। এই ধারাগুলোর বিষয়ভিত্তিক বিভক্তিও করে দেয়া আছে সর্ববামের কলামে। মনোযোগ দিয়ে এই বিভক্তিগুলো মূল ধারা পড়ার সময় মিলিয়ে নেবেন যেন এই সব ধারা মনে রাখতে সুবিধা হয়।
উপরের চার্টে প্রশ্নের সংখ্যা মনে হবে যে খুব কমই প্রশ্ন আসে এখান থেকে। বিগত ৪টি বার কাউন্সিল পরীক্ষায় মাত্র ৮টি প্রশ্ন এসেছে, মানে গড়ে ২টি করে প্রশ্ন! কিন্তু এখান থেকে অনেক প্রশ্ন দিয়েও দিতে পারে, দণ্ডবিধিতে যেমন একবার এক অধ্যায় থেকেই ২০টি প্রশ্নের ভেতরে ৮টি প্রশ্ন দিয়ে দিয়েছিলো! এটি ভালো করে পড়ার কোনোই বিকল্প নেই। এটা সারাজীবন কাজে লাগার মতো অধ্যায়।
আজ এটুকুই। সকল শিক্ষার্থী-পরীক্ষার্থীর জন্য শুভকামনা আমার পক্ষ থেকে।
লেখক : আইনজীবী ও ‘আইনের ধারাপাত – MCQ মডেল টেস্ট বুক’ এর রচয়িতা এবং ফাউন্ডার – juicylaw.com ও আইনকানুন একাডেমি
আরও পড়ুন – ফৌজদারি কার্যবিধি কীভাবে পড়বেন? [প্রথম পর্ব]