কামাল আহমেদ:
বাংলাদেশে কারাগারগুলোর দুর্দশার কথা নতুন কিছু নয়। সিলেট এবং চট্টগ্রামের দুজন পদস্থ কারা কর্মকর্তার সাম্প্রতিক গ্রেপ্তারের পর প্রকাশিত তাঁদের সম্পদ বিবরণীতে অবশ্য ধারণা হতে পারে, কারাগারগুলো নিশ্চয়ই ধনসম্পদের খনি। না হলে সেখানে কোটি কোটি টাকা উপার্জন কীভাবে সম্ভব? দেশে গণতন্ত্রের যে দৈন্যদশা, তাতে অন্য সব বিষয়ের মতোই সংসদে অথবা মাঠে-ময়দানের রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিতর্কে কারাগারগুলোর আসল চিত্র জানার কোনো সুযোগ হয় না। দেশে যেহেতু বিরোধী দল বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই, সেহেতু এসব বিষয়ে কেউ কোনো প্রশ্নও করে না। সুতরাং, নিশিকালের ভোটে গঠিত সরকারের জবাবদিহিরও কিছু নেই। তবে গত মাসে জেনেভায় জাতিসংঘ কমিটিতে ১০ জন মানবাধিকার বিশেষজ্ঞের জেরার মুখে প্রকাশ পাওয়া কিছু সরকারি তথ্যে আঁতকে উঠতে হয়।
আমাদের কারাগারগুলোতে যত বন্দী আছে, তার ৮১ শতাংশ বিচারাধীন। অর্থাৎ, তাদের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ থাকলেও তারা দণ্ডিত আসামি নয় এবং যতক্ষণ পর্যন্ত আদালতে তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা কারাগারের দেয়ালের বাইরে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা অন্য সবার মতোই নিরপরাধ। আমাদের বিচারব্যবস্থার দুর্বলতা এবং পুলিশ ও তদন্ত সংস্থার অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে বিচারপ্রক্রিয়া যেহেতু দীর্ঘায়িত হয়, সেহেতু কথা উঠতে পারে, ভয়ংকর অপরাধের আসামিদের কারাগারে আটক রাখাই শ্রেয় এবং যৌক্তিক। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্যটি এসেছে এ প্রসঙ্গেই। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটি ক্যাটকে জানিয়েছেন যে সরকারি নিরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে আমাদের দেশে মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দণ্ডিত হওয়ার হার প্রতি এক শ মামলায় মাত্র তিনটি।
আইনমন্ত্রী অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলেছেন যে বাংলাদেশ হচ্ছে বিশ্বের প্রথম দেশ, যেখানে বিচার বিভাগের নিরীক্ষা (জুডিশিয়াল অডিট) পরিচালনা করা হচ্ছে এবং সেই নিরীক্ষাতেই দেখা গেছে ফৌজদারি মামলায় সাফল্যের হার ৩ শতাংশ। একেকটি মামলায় একাধিক আসামিও থাকে। ফলে প্রতি ১০০ জন অভিযুক্তের মধ্যে দণ্ডিত হওয়ার হার হবে আরও কম। কমিটি অবশ্য বিচারাধীন আসামি এবং দণ্ডিত অপরাধীদের যে একসঙ্গে রাখার কথা নয়, তা উল্লেখ করে কারাগার এবং হাজতখানাগুলোর দুর্দশার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। তাদের হিসাবে, এসব বন্দীশালায় ধারণক্ষমতার চেয়ে গড়ে ২১৫ শতাংশ বেশি বন্দী রয়েছে। বন্দীদের ঘুমাতে হয় পালা করে। খাবারের মান খারাপ, এমনকি খাওয়ার পানিও পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায় না। পয়োব্যবস্থা অস্বাস্থ্যকর। নারীদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার সুযোগ প্রায় অনুপস্থিত। দেশের ৬৮টি কারাগারের মধ্যে মাত্র ১২টিতে আছে হাসপাতাল। ১৭০ জন কারা চিকিৎসক পদের মধ্যে মাত্র ডজনখানেক বাদে সব পদই শূন্য। হাজতখানাগুলোর অবস্থা কারাগারগুলোর থেকে উন্নত, এমনটি ভাবতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু রাজনৈতিক বন্দী ও সংবাদকর্মীদের অভিজ্ঞতাগুলো তা বলে না। বিশেষ করে রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলোর সময়ে ‘গণগ্রেপ্তার’–এর নামে যেসব নির্বিচার ধরপাকড় চলে, তখন হাজতখানায় কেউ ঝিমানোরও সুযোগ পায় কি না সন্দেহ।
নির্যাতনবিরোধী কমিটির পর্যালোচনায় কারাগার এবং হেফাজতখানাগুলোর অবস্থা এতটা গুরুত্ব পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু হেফাজতে নির্যাতন এবং মৃত্যুর অভিযোগের যেসব ভয়াবহ পরিসংখ্যান ও বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে হরেদরে আটক হওয়া ব্যক্তিদের দুর্ভোগের বিষয়টি গুরুতর হিসেবে বিবেচিত হবে, সেটাই স্বাভাবিক। হেফাজতে নির্যাতনের প্রধান কারণ সাধারণভাবে দুটো—প্রথমত, জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় এবং দ্বিতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কিছু কিছু সদস্যের ঘুষ নেওয়া বা অবৈধ পন্থায় উপরি আয়ের ব্যবস্থা। অনেকের জন্য বিস্ময়কর হলেও ক্যাটের আলোচনায় দ্বিতীয়টি এবার বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।
সিলেটের একজন পুলিশ কনস্টেবলের কাছ থেকে হেফাজতে নির্যাতনের কৌশলগুলো জেনেছিল আমাদের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। আর তাদের প্রতিবেদন থেকেই আমরা জেনেছি হেফাজত বা রিমান্ডে প্রয়োগ করা কৌশলগুলোর কথা। সা-রে-গা-মা থেরাপি, ব্যাট থেরাপি বা বাদুড়ধোলাই, স্নেক থেরাপি, ওয়াটার থেরাপি, পেনিস থেরাপি, ডান্সিং টর্চার নামে নির্যাতনের যেসব পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, সেগুলো থেকে রক্ষা পেতে জায়গাজমি বন্ধক দিয়ে হলেও ঘুষের টাকা জোগানো তখন ভুক্তভোগীদের স্বজনদের জন্য ফরজ হয়ে পড়ে। তবে রাজনৈতিক মামলা কিংবা স্পর্শকাতর মামলাগুলোতে বারবার রিমান্ড মঞ্জুরের যে চল শুরু হয়েছে, তাতে পুলিশের ভাষ্যমতে স্বীকারোক্তি না দিয়ে পার পাওয়া খুবই বিরল।
প্রশ্ন হচ্ছে, মাত্র ৩ শতাংশ দণ্ডাদেশের জন্য পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাবমূর্তি যখন নিষ্ঠুরতা ও অমানবিক নির্যাতনের অভিযোগে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তখন সেই নীতিকৌশল বদলানোর প্রয়োজনীয়তা কি অস্বীকার করা চলে? এত স্বল্প হারে অভিযোগ প্রমাণের কারণ কি তদন্তকারীদের অদক্ষতা, নাকি ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগটাই সত্যি? এ দুটোর কোনোটিই আমরা বিশ্বাস করতে চাই না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণে তা গুরুত্ব পেয়েছে।
ক্যাট তার পর্যালোচনার উপসংহারে এসব অভিযোগ যে স্বাধীনভাবে তদন্তের সুপারিশ করেছে, তার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তাই অযথা বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। র্যাব, পুলিশ এবং অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের বিদ্যমান ব্যবস্থা কতটা অকার্যকর ও হাস্যকর, তা নিয়েও নতুন করে আলোচনার কিছু নেই। ‘নিজের অপরাধ নিজে বিচার করা’র যুগ অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। এসব বাহিনীর প্রধানেরা এর আগে বহুবার বলেছেন যে কোনো বাহিনীর সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের দায় ওই বাহিনীর নয়, ব্যক্তির। সেই বক্তব্যের আলোকেই বলা প্রয়োজন, স্বাধীন–স্বতন্ত্র তদন্তের দাবিটিও কোনো বাহিনীর বিরুদ্ধে নয়, অভিযুক্ত সদস্য ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
এখানে স্মরণ করা প্রয়োজন, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু বন্ধে আইন তৈরির দাবি স্বাধীনতার পর সব সরকারই নানা অজুহাতে প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। ২০১৩ সালের যে হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণ আইনের কৃতিত্ব সরকার দাবি করে, সেটিও হেফাজতে নির্যাতিত একজন সাংসদের (সাবের হোসেন চৌধুরী) উত্থাপিত বেসরকারি বিলের সফল রূপায়ণ। হেফাজতে নির্যাতন বন্ধে ক্যাট যে সুপারিশগুলো করেছে সেগুলোর মধ্যে আছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে যারা তালিকাভুক্ত রয়েছে, তার বাইরেও রাষ্ট্রের অন্য যেকোনো কর্মকর্তার ক্ষেত্রে বিধানটি কার্যকর করা; ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দায় বা কমান্ড রেসপনসিবিলিটি নিশ্চিত করা; হেফাজতে নেওয়া স্বীকারোক্তিকে আইনগতভাবে গ্রহণ না করা এবং স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বদলে অপরাধ তদন্তে বৈজ্ঞানিক বা ফরেনসিকস অনুসন্ধানকে গুরুত্ব দেওয়া। এখন বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি হচ্ছে ফরেনসিক অনুসন্ধানে (যেমন অপরাধে ব্যবহৃত অস্ত্র ও ঘটনাস্থলে আঙুলের ছাপ কিংবা ডিএনএর মিল, সিসিটিভির ফুটেজ, অন্যান্য আলামতের সঙ্গে অভিযুক্তের যোগসূত্র) পাওয়া প্রমাণগুলো তুলে ধরে অপরাধীকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে উদ্বুদ্ধ করা।
হাজতখানা এবং কারাগারগুলোর স্বাধীন পরিদর্শন ব্যবস্থার বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ রকম নিবারণমূলক ব্যবস্থা চালু থাকলে অন্তত ফেনীর কারাগারে স্থানীয় সাংসদের সহযোগীদের তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে কারাগারের ভেতরে ঢুকে ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ শুনতে হতো না। সর্বোপরি, ক্যাটের পর্যবেক্ষণে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবার পরবর্তীকালে হুমকি, হয়রানি ও প্রতিশোধের ভয়ে বিচার চাইতেও সাহস করে না বলে যে অভিমত এসেছে, তা দূর করতে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র নজরদারির কোনো বিকল্প নেই।
ক্যাটের পর্যবেক্ষণে নির্যাতন–সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে ৭৫টির বেশি সুপারিশ রয়েছে, যেগুলো নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইতিমধ্যেই তাদের ইতিবাচক মতামত বা সম্মতি জানিয়ে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ভবিষ্যতে সেগুলো নিয়ে আরও বিতর্ক-আলোচনা হবে। তবে প্রকৃত দোষীর সঙ্গে অভিযুক্তের অবিশ্বাস্য অনুপাতের কারণেই কারাগার এবং হেফাজতের আলোচনা জরুরি। কেননা, এত বিপুল সংখ্যায় নিরপরাধ মানুষ হেফাজতি হিসেবে বছরের পর বছর অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হবে এবং কেউ কেউ অপরাধীদের সংসর্গে পড়ে অন্ধকারের পথ অনুসরণে প্রলুব্ধ হবে, এই অসুস্থ প্রক্রিয়া আর চলতে দেওয়া উচিত নয়। এই অসুস্থতা সমাজে অপরাধের বিস্তার ঘটায়, তা প্রতিকার করে না।
লেখক : সাংবাদিক (সূত্র – প্রথম আলো)