বিভিন্ন অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হটলাইনে (১০৬) গত দুই বছরে ফোন এসেছে প্রায় ৩১ লাখ। এসব ফোনকলের মধ্যে দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধের অভিযোগ পেলেই অভিযান পরিচালনা করছে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম।
দুই বছরে অভিযান চালানো হয়েছে সাড়ে ৬শ’রও বেশি। হাতেনাতে ঘুষের টাকাসহ গ্রেফতার হয়েছেন ৪৫ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। দুদকের জনসংযোগ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। হটলাইনে পাওয়া ৪৩টি অভিযোগ তফসিলভুক্ত হওয়ায় অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া অনেক অভিযোগ অনুসন্ধান শেষে মামলাও হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ১০৬-হটলাইন চালু হয়েছে। এর মাধ্যমে দুদকে সারা দেশের মানুষ তাদের অভিজ্ঞতা, দুর্নীতির কারণে ভোগান্তিসহ নানা ধরনের অনিয়মের কথা জানাতে পারছেন।
জনগণ যেভাবে অভিযোগ করছেন, তাতে কমিশনের দায়িত্ববোধ আরও বেড়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, সব অভিযোগের বিষয়ে আমরা হয়তো নিতে পারি না। কিন্তু ১০৬ মানুষের অভিযোগ জানানোর প্লাটফরম হিসেবে পরিণত হয়েছে। তিনি জানান, সেবা খাতে দুর্নীতির অভিযোগ পেলেই অভিযান পরিচালনা হচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
কমিশনের আইসিটি শাখা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই থেকে ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত হটলাইনে ফোনকল এসেছে প্রায় ৩১ লাখ। এ হিসাবে প্রতি কার্যদিবসে গড়ে ফোন এসেছে প্রায় সাড়ে ৬ হাজারের মতো।
কমিশনের পাঁচ কর্মকর্তা পালাক্রমে প্রতি ২ ঘণ্টা অন্তর সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত প্রতি কর্মদিবসে এসব ফোনকল রিসিভ করছেন।
১০৬ বা হটলাইনে সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটি ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত অভিযোগ নেয়া হয়। দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য ভুক্তভোগীরা যাতে সরাসরি জানাতে পারেন সেজন্য দুদক ২০১৭ সালে ২৭ জুলাই ১০৬ নম্বরটি চালু হয়।
অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দুদকের একজন মহাপরিচালকের নেতৃত্বে একটি বিশেষ এনফোর্সমেন্ট ইউনিট গঠন করা হয়েছে। অভিযোগের ভিত্তিতে এই ইউনিট গত দুই বছরে সাড়ে ছয়শ’ অভিযান পরিচালনা করেছে।
এই দলের অভিযানে এ পর্যন্ত বরখাস্ত হয়েছেন ৪০ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। ফাঁদ পেতে গ্রেফতার করা হয়েছে ৪৫ জনকে। অবৈধভাবে গৃহীত ৭১ লাখ টাকা ফেরত পাওয়া গেছে। বেদখল হওয়া ১৩১ একর পাহাড়, ২৪০ একর বনভূমি, ৪২০ একর কৃষিজমি উদ্ধার হয়েছে।
উচ্ছেদ হয়েছে ৬১ ইটভাটা। ৪টি প্রতিষ্ঠানে ১৮৬ জনের নিয়োগ দুর্নীতির উদঘাটন করা হয়েছে। এক হাজার ২৭ কোটি টাকার দুর্নীতি উদঘাটন হয়েছে। অভিযান চলার সময়ে স্থানীয় প্রশাসন মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ১৯ জনকে বিভিন্ন প্রকার দণ্ড দিয়েছে, আবার অনেককে জরিমানাও করেছে।
নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে এমন প্রায় ২৩ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ বন্ধ করেছে এনফোর্সমেন্ট ইউনিট।
এসব অভিযান পরিচালনায় কমিশনের সশস্ত্র পুলিশ ইউনিটের পাশাপাশি জেলা-উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতাও নেয়া হয়। হটলাইনে পাওয়া অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে সংস্থাটি এই সময়ে অনেক সরকারি দফতরে হানা দিয়ে তাৎক্ষণিক অনেক ব্যবস্থা নিয়েছে।
সরকারি হাসপাতাল, বিআরটিএ, তিতাস গ্যাস, ওয়াসা, রাজউক, বিমান, সিভিল এভিয়েশন, এলজিআরডি, জেলা প্রশাসক কার্যালয়, ভূমি অফিস, সাবরেজিস্ট্রার কার্যালয়, পল্লী বিদ্যুৎসহ সরকারি দফতর ও সরকারি সেবা সংস্থার কার্যালয়ে অভিযান চালিয়েছে দুদকের এনফোর্সমেন্ট দল।
এনফোর্সমেন্ট দলের অভিযানে উদ্ধার করা হয়েছে সরকারি সংস্থার সিবিএ নেতাদের দখলে থাকা বিলাসবহুল গাড়িও। সরকারি হাসপাতালগুলোতে দুদকের অভিযান ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সমালোচনা হয়েছে স্কুলে স্কুলে অভিযানের।
দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, ১০৬ নম্বরটি এখন তাদের রাডার। এর মাধ্যমে তারা পৌঁছে গেছেন প্রতিটি মানুষের কাছে।
এর মাধ্যমে প্রতিনিয়তই ধরা পড়ছে ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা, জালিয়াতি, সরকারি সম্পদ আত্মসাতের ঘটনা। দুদক মনে করছে, হটলাইনটির মাধ্যমে সারা দেশের দুর্নীতি পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছে। দুর্নীতিবাজরা আতঙ্কের মধ্যে আছেন।
অনেক অভিযোগকারীই দুদক আইনের তফসিলভুক্ত দুর্নীতির অভিযোগের পাশাপাশি তফসিলবহির্ভূত অভিযোগ করেন। তফসিলবহির্ভূত অভিযোগের মধ্যে আছে, ব্যক্তিগত বিরোধ, যৌতুক, বিদ্যালয়ে পাঠদানে গাফিলতি, পারিবারিক বিরোধ, সামাজিক সমস্যাসহ বিভিন্ন বিষয়।
অভিযোগ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধগুলো সম্পর্কে দেয়া তথ্য লিপিবদ্ধ করার পাশাপাশি তফসিলবহির্ভূত অপরাধের বিষয়ে অভিযোগকারীদের করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিচ্ছেন।
সূত্র জানায়, দুদকের সুনির্দিষ্ট তফসিলভুক্ত অপরাধগুলোর মধ্যে যেগুলো গুরুতর, সেগুলো অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু অপরাধের অভিযোগ সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠিয়ে সেগুলোর ওপর ব্যবস্থা নিয়ে দুদককে জানাতে হবে বলে জানান দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ।