মোহাম্মদ আরিফ উদ্দীন চৌধুরী:
সাধারণত ব্যাভিচার বলতে যা বুঝায়, যদি কোন ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তির বিবাহিতা স্ত্রীকে জেনে শুনে ঐ ব্যক্তির স্ত্রীর সাথে এমন ভাবে যৌন সম্পর্ক করে যা ধর্ষনের শামিল নয়, তাহলে ঐ ব্যাক্তি ব্যাভিচার করেছে।
এ বিষয়ে দেশের প্রচলিত আইন ১৮৬০ সালে প্রণীত দন্ডবিধির ৪৯৭ ও ৪৯৮ ধারায় বলা হয়েছে- Sec 497 Adultery: Whoever has sextual intercourse with a person who is and whom he knows or has reason to believe to be the wife of an other man, without the consent or connivance of that man, such sexual intercourse not amounting to the offence of rape, is guilty of the offence of adultery, and shall be punished with imprisonment of either description for a term which may extend to five years, or with fine, or with both. In such case, the wife shall not be punishable as an abettor.
এর অর্থ – যদি কোন ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির স্ত্রী বা যাকে সে অপর কোন লোকের স্ত্রী হিসেবে জানে বা অনুরূপ বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে এমন কোন ব্যাক্তির স্ত্রীর সাথে উক্ত স্ত্রী লোকের স্বামীর সম্মতি বা সমর্থন ব্যতিরেকে এরূপ যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা যাহা নারী ধর্ষনের সামিল নহে, সে ব্যাক্তি ব্যাভিচারের অপরাধে দোষী এবং উক্ত অপরাধে কোন মেয়াদের কারাদন্ড যাহা পাঁচ বছরের অধিক নহে বা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারে। অনুরূপক্ষেত্রে স্ত্রী লোকটি উক্ত দুষ্কর্মের সহায়তাকারীনি হিসেবে দন্ডিত হবে না।
একই সাথে দন্ডবিধির ৪৯৮ ধারায় বলা হয়েছে যে, Sec 498: “Enticing or taking away or detaining with criminal intent a married woman:- Whoever takes or entices away any woman who is and whom he knows or has reason to believe to be the wife of any other man, from that man, or from any person having the care of her on behalf of that man, with intent that she may have illicit intercourse with any person, or conceals or detains with that intent any such woman shall be punished with imprisonment of either description for a term which may extend to two years,or with fine,or with both.
অর্থাৎ- কোন বিবাহিতা নারীকে অপরাধমূলক উদ্দেশ্যে প্রলুব্দকরন বা অপহরন বা আটককরনঃ যদি কোন ব্যাক্তি অপর কোন লোকের স্ত্রী বা যাকে সে অপর কোন লোকের স্ত্রী বলে জানে বা অনুরূপ বিশ্বাস করার কারন আছে এরূপ নারীকে যে কোন ব্যক্তির সাথে অবৈধ যৌন সম্পর্ক করবে এই উদ্দেশ্যে উক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তির পক্ষে অনুরূপ নারীর তত্ত্বাবধানকারী যে কোন ব্যক্তির নিকট হতে অপহরণ বা প্রলুব্ধ করে নিয়ে যায় অথবা উক্ত উদ্দেশ্যে অনুরূপ যে কোন নারীকে গোপন বা আটক করে, সে ব্যক্তি যে কোন মেয়াদের কারাদন্ডে যাহা দুই বৎসর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদন্ডে বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারে।
দন্ডবিধির ৪৯৭ ধারা মতে ব্যাভিচার হতে হলে যে উপাদানগুলি পাওয়া যায় তা হলো- ১. যৌন সম্পর্ক স্থাপন, ২. একজন পুরুষ ও বিয়ে বলবৎ আছে এমন একজন বিবাহিতা স্ত্রীলোক, ৩. যে ব্যাক্তি ব্যাভিচারে লিপ্ত হবেন তিনি জানবেন বা বিশ্বাস করবেন যে, তার সঙ্গীয় নারীটি অপর ব্যক্তির স্ত্রী, ৪. তাহার সঙ্গীয় নারীর বিবাহটি বৈধ ছিলো যা এখনো বলবৎ আছে, ৫. উক্তরূপ কার্যকলাপে বিবাহিতা স্ত্রীলোকটির স্বামীর সম্মতি নেই।
উপরোক্ত উপাদানগুলো বিদ্যমান থাকলে কোন ব্যাক্তিকে ব্যাভিচারের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দেয়া যায়।
তবে ধারাটা বিশ্লেষ করলে কিছু আইনগত প্রশ্ন এসে যায়, যেমন- ১. কেন শুধুমাত্র ব্যাভিচারী পুরুষকে সাজা দেয়ার বিধান রয়েছে? ২. আইনের মাধ্যমে কেন ব্যাভিচারীনি স্ত্রীলোককে সাজা থেকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে? ৩. কেন ব্যাভিচারীনি স্ত্রীলোকের স্বামীর সম্মতির কথা বলা হয়েছে? ৪. কেন ব্যাভিচারীনি স্ত্রীলোকের স্বামীকে মামলা করার অধিকার দেয়া হয়েছে?
সরল ভাষায় যদি বলা হয় তাহলে বলা যায় যে, ব্যাভিচারের অপরাধে নারীকে কখনো দোষী করা যাবে না, ব্যাভিচারে স্ত্রীলোকের স্বামী মামলা করতে পারবে পুরুষ ব্যাভিচারীর বিরুদ্ধে, ব্যাভিচারের অপরাধ সংগঠনে যদি নারীর সহায়তা বা প্রলুব্ধকরণ বা অপরাধের মাত্রা বেশি থাকলেও উক্ত ব্যাভিচারীনি স্ত্রীলোকের কোন দোষ দেয়া যাবে না বা তার বিরুদ্ধে কোনরূপ আইনগত পদক্ষেপ নেয়া যাবে না। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, স্বামীর সম্মতি থাকলে ব্যাভিচারকে আইনগতভাবে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে না।
দন্ডবিধিতে এই ধারা অন্তর্ভূক্ত করে দুটি জাগায় ভুল করা হয়েছে, ১. আইনের দৃষ্টিতে নারী পুরুষকে আলাদা করে পুরুষ জাতির প্রতি গুরুতর অন্যায়। ২. স্বামীর সম্মতির বিধান রেখে নারী জাতির প্রতি অবমাননা।
অন্যান্য দূর্বল জায়গাগুলো বাদ দিলেও এ দুটো বিষয় দেশের প্রচলিত আইন ও আন্তর্জাতিক আইন-অধিকার পরিপন্থী।
আমাদের দেশে রাষ্ট্রের প্রধান আইন হলো আমদের সংবিধান। এটা হলো আমাদের সুপ্রীম ল। সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক যে কোন আইন, কর্মকান্ড, নীতিমালা সবসময় বাতিল বলে গণ্য হবে।
রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার বিষয়ে অনুচ্ছেদ ২৬ এ বলা হয়েছে- সংবিধানের সহিত সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্য ততখানি বাতিল হইবে এবং রাষ্ট অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোন আইন প্রনয়নও করবে না।
অনুচ্ছেদ ২৭ এ আইনের দৃষ্টিতে রাষ্টের সকল নাগরিক সমান এবং আইনের আশ্রয় লাভের ক্ষেত্রে সমান অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে।
অনুচ্ছেদ ২৮ এ ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে রাষ্ট্র কোন নাগরিকের প্রতি বেষম্য প্রদর্শন করবে না এবং রাষ্ট্র-গণজীবনের সর্বস্তরে নারীপুরুষের সমান অধিকারের নিশ্চিয়তা দেয়া হয়েছে।
অনুচ্ছেদ ৩১ এ আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার দেয়া হয়েছে।
সংবিধানের মৌলিক অধিকার বা অনুচ্ছেদ সম্পর্কে কেউ জানুক আর না জানুক, অতি সাধারণ লোকও জানে যে আইনের চোখে সকলে সমান বা আইন সবার জন্য সমান।
এছাড়া সনাতন, ইসলাম, বৌদ্ধসহ বিভিন্ন ধর্মীয় আইনেও এ বিষয়ে কড়া নিষেধ এবং এ অপরাধে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।
১৮৬০ সালে প্রণীত আইনে তৎ সাময়িক সামাজিক পরিস্থিতি, ধর্মীয় বিধান এবং কমন ল বিবেচনা করে উক্ত ধারা দন্ডবিধিতে অন্তর্ভূক্ত করলেও বর্তমান সময়ে তা অকার্যকর এবং মানব অধিকার লঙ্ঘন। যা আমাদের দেশের মতো সভ্য রাষ্ট্রে চলতে পারে না।
তাই দন্ডবিধি ৪৯৭ ধারা সহ তৎ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইন সমূহ সংশোধন পূর্বক কার্যকর ও যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন সময়ের দাবী।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট