অ্যাডভোকেট বেল্লাল হোসাইন:
বাংলাদেশে বর্তমানে যেসকল অপরাধের বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সবাই চরমভাবে উদ্বিগ্ন; সেসকল অপরাধগুলোর ব্যাপারে আইন অত্যন্ত কঠোর ও সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রেখেছে। যে সমস্ত কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে তার মধ্যে মোটা দাগে কিছু আলোচিত অপরাধ নিয়ে কথা বলা যায়; সেগুলো হচ্ছে খুন, ধর্ষণ, মাদকসন্ত্রাস, খাদ্যে ভেজাল ও দুর্নীতি।
চলুন দেখি এই সকল অপরাধের শাস্তি হিসেবে আইনে কী বিধান আছে ?
খুন: দণ্ডবিধি,১৮৬০ এর ৩০২ ধারায় খুনের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন ও জরিমানা রাখা হয়েছে।
ধর্ষণ: দণ্ডবিধি,১৮৬০ এর ৩৭৬ ধারায় ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১০ বছর পর্যন্ত জেল ও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন,২০০০ এর ধারা ৯(১) এ ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও জরিমানা। এবং ৯(২) ও ৯(৩) ধারায় ধর্ষণের ফলে মৃত্যু হলে মৃত্যুদণ্ড ও জরিমানার বিধান আছে।
মাদক সন্ত্রাস: মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯০ রহিত করে সম্প্রতি ২০১৮ সালে নতুন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন করা হয়, এতে ইয়াবা ব্যবহারকারী ও কারবারিদের কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। যদিও ইয়াবা শব্দটি সরাসরি ব্যবহার করা হয়নি। ইয়াবার রাসায়নিক নাম অ্যামফিটামিনকে উল্লেখ করা হয়েছে। এই আইনের তফসিলের ক শ্রেণীর ৫ নং ক্রমিকভুক্ত মাদক যা ২০০ গ্রাম পর্যন্ত রাখার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
খাদ্যে ভেজাল: বিশেষ ক্ষমতা আইন,১৯৭৪ এর ২৫(গ) ধারায় খাদ্যে ভেজালের জন্য মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন বা ১৪ বছর পর্যন্ত জেল ও জরিমানার শাস্তির বিধান আছে। এবং এই আইনের আওতায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে ৩৪ ক ধারামতে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার বিধান আছে।
দুর্নীতি: দুর্নীতি দমন কমিশন আইন,২০০৪ এর ২৭ ধারামতে, দুর্নীতি করে অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে। এবং ৩-১০ বছরের জেল ও জরিমানা করা হবে।
এইসব অপরাধের শাস্তির বিধান অত্যন্ত কঠোর হওয়া স্বত্ত্বেও অপরাধের পরিমাণ কমেছে না বেড়েছে?
কঠোর আইনি বিধান থাকার পরও যেহেতু অপরাধ না কমে বাড়ছে বা স্থির থাকছে সেহেতু আমাদেরকে শুধু নতুন নতুন আইন প্রণয়ন ও বড় বড় শাস্তির বিধানের বাইরে ভিন্নভাবে চিন্তা করতে হবে। শাস্তির ভয় দেখিয়ে অপরাধীকে বশে আনা যাচ্ছে না। তাহলে ভয় দেখিয়ে ফলাফলটা কী?
অনেক আগে এক দেশে পকেটমার এতো বেশিহারে বেড়েছিল যে, পকেটমারের শাস্তি প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ডের আইন করা হয়েছিল! কিন্তু দেখা গেলো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা দেখতে আসা উৎসুক জনতার কারো কারো পকেটমারা হচ্ছিল! তাহলে দেখা গেলো কঠোর আইন ও আইনের প্রকাশ্য প্রয়োগও অপরাধ পুরোপুরি দমনে ব্যর্থ!
অপরাধ সংঘঠিত হয় দুটি উপাদানের উপস্থিতিতে। সেগুলো হলো মেনস রিয়া বা অপরাধী মন ও এক্টাস রিয়া অর্থাৎ মন্দ চিন্তায় আসক্ত হয়ে মন্দ কাজের মাধ্যমে। তাহলে দেখা যাচ্ছে শুরুতেই আমাদের মাইন্ডসেট অপরাধ সংঘটনে ভূমিকা রাখছে। কাজেই সমাজে অপরাধের মাত্রা কমিয়ে আনতে মানসিক স্বাস্থ্যের বা মনের উপর কাজ করতে হবে। অপরাধ বা অন্যায় কাজ যে নিজের ও অন্যের জন্য ক্ষতিকর তা মন থেকে চূড়ান্তভাবে বিশ্বাস করার আগ পর্যন্ত অপরাধীরা কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করবে না। আমাদের দেশে রিফর্মেটিভ শাস্তির স্কিম অনেক কম। যতটুকু আছে তাও অনেকটা অকার্যকর। বিশ্বের অন্যান্য দেশে শুধু অপরাধীর কৃত অপরাধকর্ম নিয়ে মেতে থাকা হয়না। বরং কেন সে অপরাধ করলো অর্থাৎ অপরাধের মোটিভ খুঁজে বের করে সংশোধনমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়। আমাদের উদ্দেশ্য যদি কাউকে শুধু শাস্তি দেয়া হয়, তবে আর কিছু বলার নেই। তবে যদি সমাজ থেকে অপরাধের বিষবৃক্ষ মূলোৎপাটন করার সদিচ্ছার কথা আসে তবে অবশ্যই মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নের উপর জোর দিতে হবে।
অপরাধ দমনে সামাজিক কার্যক্রম যেমন হওয়া উচিত
- সহিংসতা ও দুর্নীতিবিরোধী প্রচার প্রচারণা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সকল গণমাধ্যমে বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যহ নির্দিষ্ট সময় ধরে ব্রডকাস্ট করার বিধান করতে হবে।
- শিক্ষিত, পেশাজীবি শ্রেণির লোকদের মানবিক, মানসিক চিন্তাধারা উন্নয়ন ও নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করতে মাসিক সুকর্মী সভার আয়োজন ও পূর্ববর্তী মাসের ভালো কাজের জন্য স্বীকৃতি দেয়া।
- সমাজের তুলনামূলক অসচেতন শ্রেণীর মানুষজন যাদের মূলত যথাযথ তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সহজ প্রবেশাধিকার নেই তাদেরকে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের আওতায় সমাজকেন্দ্রে ধারাবাহিকভাবে সহিংসতাবিরোধী কন্টেন্টগুলো দেখাতে হবে।
- পরিবহন শ্রমিক ভাইদেরকে গাবতলী, মহাখালী,সায়দাবাদ ও প্রত্যেক জেলা শহর বাস-ট্রাক স্ট্যান্ডে কমপক্ষে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে ডকুমেন্টারিগুলো জেলাপ্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় মাল্টিমিডিয়ায় দেখাতে হবে।
- প্রত্যেক গার্মেন্টেসে সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে সবাইকে এক জায়গায় করে ডকুমেন্টারি দেখাতে হবে।
- অভিভাবকদের নিজ নিজ সন্তানদের আচার আচরণের ব্যাপারে কমিউনিটিতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি পাড়া, মহল্লায় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিউনিটি ওয়েলফেয়ার কমিটি করতে হবে।
- মাদকের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি কেস স্টাডি করে দেখা গেছে বেশিরভাগ সহিংসতামূলক কর্মকান্ডের হোতারা মাদকসেবী। মাদকের জন্য পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন আলগা হয়ে যায়। দায়বদ্ধতা কমে যায়। শাসন অধিকার ব্যর্থ হয়ে যায়।
- ধর্মীয় অনুশাসন মানা ও মানতে উৎসাহিত করতে হবে। সত্যিকারের ধার্মিক মানুষের আচার ব্যবহারে আলাদা ইতিবাচকতা থাকে,তা সে যে ধর্মেরই হোক না কেন।
সর্বোপরি সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে ও অর্থনৈতিক বৈষম্যরোধে সকল পর্যায় থেকে কাজ করতে হবে।
লেখক: সিনিয়র অফিসার (আইন), অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড; মহাব্যবস্থাপকের সচিবালয়, বরিশাল সার্কেল। ই-মেইল: bellal.sincere@gmail.com