অ্যাডভোকেট শহিদুল ইসলাম সজীব

জামালপুরের ডিসি’র আপত্তিকর ভিডিও বনাম দেশের প্রচলিত আইন

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হওয়া বহুল আলোচিত জামালপুরের জেলা প্রশাসক এবং নারী অফিস সহায়কের অন্তরঙ্গ মূহুর্তের ভিডিও নিয়ে সারা দেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ঘটনাটি নৈতিক এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নিঃসন্দেহে মন্দ কাজ। কিন্তু প্রচলিত আইনে কি তারা কোন অপরাধ করেছে? আমাদের সংবিধান আর প্রচলিত আইন কি বলে? বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন অ্যাডভোকেট শহিদুল ইসলাম সজীব

আলোচনার শুরুতে পাঠকদের একটা বিষয় জানানো জরুরী। নৈতিকতা এবং আইন অনেক ক্ষেত্রে এক নাও হতে পারে। এমন অনেক কাজ আছে, যা ধর্মীয় দিক থেকে কিংবা নৈতিকতার দিক থেকে ঠিক না, কিন্তু আইন অনুযায়ী ঐসব কাজ করা কিংবা না করা কোন অপরাধের পর্যায়ে পরে না। মানে প্রচলিত আইন ঐ সকল কাজকে অবৈধ ঘোষণা করে না।

এবার আসি আলোচিত ঘটনার সাথে কোন আইনে অভিযোগ তোলার কথা উঠতে পারে। প্রথমেই সবার মনে যেটা আসে সেটা হচ্ছে বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৪৯৭ ধারার ব্যভিচারের অপরাধ। কিন্তু ৪৯৭ ধারায় অভিযোগ আনার পর্যাপ্ত উপাদান এখানে নেই। কেন? দেখা যাক, ৪৯৭ এ কি বলা আছে। এখানে বলা আছে যে, “যদি কোন ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির স্ত্রী অথবা যাকে সে অপর কোন লোকের স্ত্রী বলে জানে বা তার অনুরুপ বিশ্বাস করার কারন রয়েছে এমন কোন ব্যক্তির সাথে উক্ত অপর লোকের সম্মতি বা সমর্থন ব্যতিরেকে এরুপ যৌন সম্পর্ক করে যা নারী ধর্ষণ এর সামিল নহে, সে ব্যক্তি ব্যভিচার এর অপরাধে দোষী।” তার মানে ৪৯৭ ধারায় অভিযোগ আনবে স্ত্রী লোকের স্বামী। আলোচিত নারী অফিস সহায়ক তালাক প্রাপ্ত মহিলা। তার বর্তমানে আইনগত বৈধ কোন স্বামী নেই। এখানে ৪৯৭ ধারায় কোন অভিযোগ আনবে কে? পর্যাপ্ত উপাদান না থাকায় ৪৯৭ ধারায় অভিযোগ গঠন সম্ভব নয়।

প্রাপ্ত-বয়স্ক নর-নারীর প্রেম, শারীরিক কিংবা মানসিক সম্পর্ক, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক, এগুলো কি বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে অবৈধ? কোন আইনে অপরাধ গঠন করবেন? কি ধরনের অপরাধের অভিযোগ আনবেন? একটা সংবাদে দেখলাম, সাধনা নামের ঐ অফিস সহায়ক সাংবাদিকদের বলেছেন, ডিসি স্যারের কোন দোষ নেই। তার মানে বিষয়টা দু’জনের সম্মতিতে কোন ধরনের বল প্রয়োগ ছাড়াই সম্পন্ন হয়েছে। মহিলা যদি কোন অভিযোগ না করে, ধর্ষণের চার্জ আনা তো প্রশ্নেই উঠে না। সেক্ষেত্রে ডিসি’র অপরাধ কোথায়? মহিলারই বা অপরাধ কোথায়?

এবার আমরা যদি এই ঘটনার বাইরে চিন্তা করি, যেমন কেউ যদি বিবাহ-বহির্ভূতভাবে তথাকথিত “লিভ টুগেদার” করে সেক্ষেত্রে প্রচলিত আইন বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে কিনা। না পারে না। আমরা যেটা ভাবছি, সেটা হচ্ছে নৈতিকতার বিষয়। নৈতিক কিংবা ধর্মীয় দিক থেকে কাজটি অত্যন্ত গর্হিত। কিন্তু আপনি হয়তো শুনে অবাক হবেন, কাজটা বৃটিশদের থেকে ধার করে আনা বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে আইনগত ভাবে কোন অপরাধের পর্যায়ে পরে না। হ্যাঁ, সংবিধান এবং প্রচলিত আইন ব্যক্তি স্বাধীনতার সীমাকে এতোটাই বিস্তৃত করেছে। এ নিয়ে আমরা বিতর্ক করতেই পারি। আইন সংস্কারের দাবিও করতে পারি। কিন্তু আপাতত তো আমাদের আইন মানতেই হচ্ছে।

তবে কি এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার কোন ফলাফল থাকবে না? থাকবে। আলোচিত জেলা প্রশাসক এবং নারী অফিস সহায়কের বিরুদ্ধে সরকারি চাকুরী বিধিমালায় বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। তবে মনে রাখা ভালো এ ধরনের ব্যবস্থা কোন জুডিশিয়াল প্রসেডিং না।
সরকারি কর্মচারিদের (প্রায় সবার) আচরণ ও শৃঙ্খলা যে সকল আইন ও বিধিদ্ধারা নিয়ন্ত্রিত হয় সেগুলো হল-
(ক) সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮
(খ) সরকারি কর্মচারি (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮,
(গ) The Government Servants (Conduct) Rules, 1979, and some other rules and SROs

সরকারি কর্মচারি (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ এর “অসদাচরণ” কে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে-
“বিধি ২ (খ) “অসদাচরণ” অর্থ অসংগত আচরণ বা চাকুরী শৃঙ্খলার জন্য হানিকর আচরণ, অথবা সরকারি কর্মচারীদের আচরণ সংক্রান্ত বিদ্যমান বিধিমালার কোনো বিধানের পরিপন্থি কোনো কার্য, অথবা কোনো সরকারি কর্মচারীর পক্ষে শিষ্টাচার বহির্ভূত কোনো আচরণ, এবং নিন্মবর্ণিত আচরণসমূহও ইহার অর্ন্তভূক্ত হইবে, যথাঃ (অ) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আইনসংগত আদেশ অমান্যকরণ; (আ) কর্তব্যে অবহেলা প্রদর্শন; (ই) আইনসংগত কারণ ব্যতিরেকে সরকারের কোনো আদেশ, পরিপত্র এবং নির্দেশ অবজ্ঞাকরণ; (ঈ) কোনো কর্তৃপক্ষের নিকট কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে অসংগত, ভিত্তিহীন, হয়রানিমূলক, মিথ্যা অথবা তুচ্ছ অভিযোগ সংবলিত দরখাস্ত দাখিল; অথবা (উ) অন্য কোনো আইন বা বিধি-বিধানে যে সমস্ত কার্য অসদাচরণ হিসাবে গণ্য হইবে মর্মে উল্লেখ আছে এইরূপ কোনো কার্য।”

উপরের (উ) বিধি অনুযায়ী আমাদের যেতে হয় “1) The Government Servants (Conduct) Rules, 1979. Rule 27A runs as “Conduct towards female colleagues-No government servant shall use any language or behave with his female colleagues, in any manner, which is improper and goes against the official decorum and dignity of female colleagues.”

কাজেই উক্ত কেলেঙ্কারিকে ‘অসদাচরণ’ ধরে নিয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। সম্ভবত সেটাই করা হচ্ছে। আগেই বলেছি এই ধরনের ব্যবস্থা কোন জুডিশিয়াল প্রসেডিং না। নিয়মিত ফৌজদারী আদালতে ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা অন্য কোন বিচারকের ক্রিমিনাল কেস চালানোর মত কোন অপরাধ আদতে দেখা যাচ্ছে না। এটা আইনের সীমাবদ্ধতা নাকি আমাদের দর্শনগত সমস্যা সেটা নিয়ে আমরা বিস্তর আলোচনা চালাতে পারি।

প্রায়শই আমরা পুলিশকে বিভিন্ন আবাসিক হোটেল কিংবা ফ্ল্যাট থেকে যুবক-যুবতীদের গ্রেফতার করে আদালতে প্রেরণ করতে দেখি। এ ধরনের মামলায় পুলিশ সাধারণত বেশ্যাবৃত্তির অভিযোগ তোলে। আইনে বেশ্যাবৃত্তির সংজ্ঞা স্পস্ট করা আছে। দু’জনের সম্মতি থাকলে আর ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য না থাকলে সেটা কখনোই সেই সংজ্ঞার মধ্যে আসে না। বাধ্যহয়ে প্রসিকিউসন মামলা থেকে ধীরে ধীরে সরে আসে। আর অভিযুক্তরা অব্যাহতি পেয়ে যায়। আসলে এখানে নৈতিকতার দোহাই দিয়ে বেশিদূর যাওয়া যায় না। মূলত এ সংক্রান্ত প্রচলিত পর্যাপ্ত আইন নেই যার মাধ্যমে অভিযোগ গঠন করে বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়া যায়।

অবাক হওয়া এখানেই শেষ নয়! আইনগত ভাবে ডিসি কিংবা ঐ মহিলার বিরুদ্ধে কোন জুডিশিয়াল প্রসেডিং তো নেওয়াই যায় না, বরং যে বা যারা ঐ গোপন ব্যক্তিগত ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে উনারা দু’জন চাইলে তাদের বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা ঠুকে দিতে পারেন। এভাবে অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া তথ্য প্রযুক্তি আইনে স্পষ্ট অপরাধ।

যতটুকু আলোচনা হলো তার সবই আইন সংক্রান্ত বিষয়। বাস্তবিক জীবনে এ সকল ঘটনায় আমরা হতবাক হয়ে যাই। এমন ঘটনায় জড়িত লোকগুলোর পরিবারের সদস্যদের মানসিক অবস্থা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। মজবুত পারিবারিক বন্ধন ছাড়া শুধু আইনের ধারা-উপধারা দিয়ে মানুষের বৈচিত্রময় জটিল আচরণ নিয়ন্ত্রণ কতটুকু সম্ভব তা নিয়ে ভাবার অবশ্যই অবকাশ আছে।

লেখক: আইনজীবী, শরীয়তপুর জজ কোর্ট; email: mdshahidulislam0038@gmail.com