প্রবীণ বৌদ্ধ ভিক্ষু ভদন্ত অমৃতানন্দ থেরোকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও উদ্বেগ জানিয়েছেন জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ মোর্চার নেতৃবৃন্দ। এক যৌথ বিবৃতিতে মোর্চার নেতৃবৃন্দ বলেন, আমরা মনে করি, এ হত্যাকাণ্ড পরিষ্কারভাবেই পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস। এ হত্যাকাণ্ডের পিছনে দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার সুস্পষ্ট প্রয়াস বিদ্যমান।
বিবৃতিতে বলা হয়- আমরা মনে করি, মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মূল চেতনা ধারণ করেই চলবে। কিন্তু সে পথে প্রায়শই সাম্প্রদায়িক অপশক্তি শত্রুর ছোবল দেওয়ার চেষ্টা চালায়। তারাই এ ধরনের সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্র করে বাংলাদেশের গতিপথ পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়কালে তারা সংবিধান পাল্টে দিয়ে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি বদলে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা করেছিলো। আজ যখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায়, তখনও সেই পুরনো শত্রুরাই দেশের অভ্যন্তরে নানাভাবে সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে।
যে প্রক্রিয়ায় একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যা করা হলো, তার আলামতগুলো লক্ষ্য করলেই এর পিছনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হবে। হত্যকাণ্ডের শিকার ভিক্ষু ভদন্ত অমৃতানন্দ থেরো একজন ৭৫ বছর বয়সী বৌদ্ধ ভিক্ষু। ২৪ আগস্ট রাতে ঢাকা থেকে ট্রেনে করে ফেরার পথে ট্রেনের মধ্যেই তাঁকে হত্যা করে গোমতী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। ২৫ আগস্ট তার মরদেহ নদীর পাড় থেকে উদ্ধার করা হয়। তাঁর কাছে নগদ ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা থাকলেও তার একটি টাকাও হত্যাকারীরা নেয়নি। আর এমন একজন ইহজগতের লোভলালসার উর্ধে ওঠা প্রবীণ ভিক্ষুকে হত্যার পিছনে পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য প্রতীয়মান হয় না।
আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে বলতে চাই, বাংলাদেশ যখন মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর শরণার্থীদের নিয়ে এক গভীর সঙ্কটের কাল পার করছে, তখন হঠাৎ করেই বৌদ্ধ ভিক্ষু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আমাদের ভাবিয়ে তোলে। দুই বছর আগেও যখন মিয়ানমারের বৌদ্ধ প্রভাবিত শাসকদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে এসেছিলো, তখনও একটি গোষ্ঠী ওই ঘটনার জন্য বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপর নানাভাবে হামলা-আক্রমণের চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু তখন এদেশের মানবতাবাদী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ মিয়ানমারের শাসকদের এহেন অন্যায় কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে এখানে আসা রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি মানবিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো। আমরা মনে করি, এটাই বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনার প্রকাশ। মিয়ানমারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপর দায় চাপানোর কোনো সুযোগ নেই। বরং রোহিঙ্গা সঙ্কটের চরম এই সময়ে এসে একজন প্রবীণ বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আমাদের আন্তর্জাতিকভাবেই প্রশ্নের মুখোমুখি করবে।
আমরা পরিষ্কারভাবেই বিশ্ব মানবতা এবং বিশ্বশান্তির পক্ষে। বিশ্বের কোথাও কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক হানাহানি ও রক্তপাতের ঘটনাকে আমরা সমর্থন করি না। আমরা মনে করি, এ হত্যাকাণ্ডের দ্রুত ও যথাযথ তদন্ত করে হত্যাকারীদের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। একইসাথে কোনোভাবেই যেন কেউ বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক শান্তি বিনষ্টের কোনো অপচেষ্টা পরিচালনা করতে না পারে, সেজন্য সরকার ও জনসাধারণকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।
বিবৃতিতে যারা স্বাক্ষর করেন: জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ মোর্চার আহ্বায়ক ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজ, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ মোর্চার প্রধান সমন্বয়ক এফ এম শাহীন। এছাড়া মোর্চার কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ যথাক্রমে- সাংবাদিক বাণী ইয়াসমিন হাসি, লেখক ও গবেষক ফারাবী বিন জহির অনিন্দ্য, সাংবাদিক ও এক্টিভিস্ট রবিউল ইসলাম রূপম, উন্নয়নকর্মি ও প্রাক্তন ছাত্রনেতা মুনতাহা নূর, রাজনৈতিক কর্মি কোহেলী কুদ্দুস মুক্তি, সাংবাদিক সাবিরা ইসলাম, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক খায়ের মাহমুদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. বদরুল হাসান কচি, সাংবাদিক ও কবি মামুন রশীদ, আবৃত্তিশিল্পী ড. শাহাদাত হোসেন নিপু, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক জাকিয়া সুলতানা মুক্তা, সাংবাদিক হাবিবুর রহমান রোমেল, সাংস্কৃতিক সংগঠক অনিকেত রাজেশ, প্রাক্তন ছাত্রনেতা অর্ণব দেবনাথ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক জয়নাব বিনতে হোসেন শান্তু এবং জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ মোর্চার সমন্বয়ক বাপ্পাদিত্য বসু।