মামলার পাহাড় জমেছে উচ্চ আদালতে। সুপ্রিম কোর্টে বর্তমানে ৫ লাখের বেশি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে আপিল বিভাগে ২১ হাজার ৪১০টি এবং হাইকোর্ট বিভাগে ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৫৬২টি। বর্তমানে আপিল বিভাগে সাতজন বিচারপতি এবং হাইকোর্ট বিভাগে ৯২ জন বিচারপতি রয়েছেন। মোট ৯৯ জন বিচারপতির হাতেই চলছে ৫ লাখের বেশি মামলার বিচার কার্যক্রম।
সুপ্রিম কোর্টের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে ৫ লাখ ৯ হাজার ৯৭২টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এ ছাড়া গত জুলাই ও আগস্ট মাসের হিসাব অন্তর্ভুক্ত করা হলে মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তির পরিমাণ আরও বাড়বে। এপ্রিল-মে-জুন এই তিন মাসে আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হয়েছে দুই হাজার ৬১৩টি মামলা। দায়ের হয়েছে দুই হাজার ২১০টি মামলা।
এ সময়ে হাইকোর্ট বিভাগে দায়ের হয়েছে ২৭ হাজার ১০৭টি। এর মধ্যে দেওয়ানি এক হাজার ৩৭৮টি, ফৌজদারি ২১ হাজার ৫৩৪টি এবং রিট তিন হাজার ৭৬৫টি মামলা। নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৫ হাজার ২৩৮টি। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলা ১০৬৯, ফৌজদারি মামলা ৪১ হাজার ৪৭০, রিট মামলা দুই হাজার ৫২৪টি। বিচারাধীন মামলার মধ্যে রয়েছে দেওয়ানি ৯৬ হাজার ৪৫০টি, ফৌজদারি দুই লাখ ৯৭ হাজার ৫০৯টি এবং রিট ৮৩ হাজার ৯০৬টি।
সূত্রে আরও জানা গেছে, চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত আপিল বিভাগে দায়ের হয়েছে ২ হাজার ৮১২টি মামলা এবং নিষ্পত্তি হয়েছে ১ হাজার ৪৪১টি মামলা। এই সময়ে হাইকোর্ট বিভাগে দায়ের হয়েছে ২৯ হাজার ৭৭৭টি মামলা এবং নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৯ হাজার ৮১১টি মামলা।
২০১৮ সালের ১ অক্টোবর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হয়েছে ১ হাজার ৯২৮টি মামলা এবং দায়ের হয়েছে ২ হাজার ৭৫১টি মামলা। এই সময়ে হাইকোর্ট বিভাগে দায়ের হয়েছে ২৫ হাজার ২১৩টি মামলা এবং নিষ্পত্তি হয়েছে ১৬ হাজার ৩০৬টি মামলা। হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ৮০৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এই সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে শতাধিক মামলা। আরও ১৮২টি মামলা শুনানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আগের তুলনায় উচ্চ আদালতে মামলা নিষ্পত্তির হার বেড়েছে, কিন্তু জট কমেনি। উভয় বিভাগে দায়েরের চেয়ে নিষ্পত্তির সংখ্যা বেশি। কিন্তু মামলাজট কমছে না।
জানা গেছে, বিচার বিভাগ পৃথক্করণের সময় উচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল তিন লাখ ১৩ হাজার। ওই সময় উভয় বিভাগে বিচারপতির সংখ্যা ছিল ৮১ জন। বর্তমানে উভয় বিভাগে বিচারপতির সংখ্যা ৯৯ জন। এমন পরিস্থিতিতে উচ্চ আদালতে আরও বিচারপতি বাড়ানোর মত দিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের উচ্চ আদালতে বিচারপতির সংখ্যা অনেক কম। ফলে মামলাজট বাড়ছে, বিচার নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হচ্ছে, পাশাপাশি বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে দুর্ভোগ কমছে না।
উচ্চ আদালতে মামলাজট নিরসনে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক বেশ কয়েকবছর আগে ২৭ দফার কয়েক দফা সুপারিশ করেন। তার মতে, উচ্চ আদালতে যে পরিমাণ মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে, পাশাপাশি দায়েরের সংখ্যা কমছে না। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য উচ্চ আদালতে আরও বিচারক নিয়োগের পরামর্শ দেয় আইন কমিশন। ওই সময় উচ্চ আদালতে মামলাজট কমাতে আইন কমিশনের সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি মনিটরিং সেল স্থাপন এবং মামলা দাখিল ও নিষ্পত্তির সংখ্যা কী কী কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা নিরূপণ করা। এ ছাড়া কোনো দেওয়ানি, ফৌজদারি মোশন আবেদন বা সিআরপিসি এর ৫৬১ এ ধারামতে আবেদন দাখিল করলে বিচারপতিরা প্রথমেই তার মেরিট যাচাই করবেন। মেরিটবিহীন আবেদন করা হলে অবশ্যই সরাসরি খারিজ করবেন। সম্প্রতি সর্বোচ্চ আদালত মামলাজট নিরসনে বেশ কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, দেশে মামলার জট অস্বাভাবিক, এটিকে কমিয়ে আনতে হবে। আমরা চাই জনগণ বিচার পাক, বিচার প্রক্রিয়ায় মানুষের আস্থা টিকে থাকুক। এ জন্য আমাদের মামলার জট কমিয়ে আনতে হবে। তিনি বলেন, মামলার জট নিরসন করা বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম অগ্রাধিকার। আমরা পদ্ধতিগতভাবে সমাধান করার চেষ্টা করছি।
বিচারাধীন মামলা কমানোর নানা উদ্যোগ তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বিচার ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করেছে। বর্তমান সরকার এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, উচ্চ আদালতে মামলাজট কমাতে হলে অবশ্যই আরও অধিকসংখ্যক বিচারক নিয়োগ দিতে হবে। বেঞ্চ বাড়াতে হবে। প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরামর্শ করে বিচারক নিয়োগ দেবেন। তিনি বলেন, দিন দিন মামলা বাড়ছে, কিন্তু বিচারক বাড়ানো হচ্ছে না।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এএম আমিনউদ্দিন বলেন, উচ্চ আদালতে মামলাজট কমাতে অবশ্যই উভয় বিভাগে বিচারক নিয়োগ দিতে হবে। বেঞ্চ বাড়ানোর পাশাপাশি অন্যান্য শাখায় জনবলও বৃদ্ধি করতে হবে। তাহলে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, দেশে প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বাড়ছে, পাশাপাশি মামলাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু সে তুলনায় বিচারকের সংখ্যা বাড়ছে না। মামলা ব্যবস্থাপনায় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনকে আরও উন্নত ও আধুনিক হতে হবে।
বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে দায়িত্ব নেন। এরপর থেকে তিনি মামলাজট কমাতে ও নিম্ন আদালতকে গতিশীল করতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ অব্যাহত রেখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে বিচারক ও এজলাসের সংখ্যা বাড়ানো, আদালতের অবকাঠামো উন্নয়ন, সহায়ক জনবল বৃদ্ধি, মামলা ব্যবস্থাপনা ও বিচার প্রশাসনে তদারকি বাড়ানো প্রভৃতি। ওই উদ্যোগের ফলে গত এক বছরে বেশকিছু মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের সার্বক্ষণিক তদারকি ও প্রায়োগিক নির্দেশনার ফলে বিচারকদের মধ্যে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির স্পৃহা অনেক বেড়েছে বলে সংশ্নিষ্টরা দাবি করেন।
নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক্করণের সময় ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর দেশের সব আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ৭০ হাজার। বর্তমানে সারাদেশে মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৩৫ লাখ। গত ১২ বছরে মামলা বেড়েছে ২০ লাখেরও বেশি। গত ১১ বছরে নিম্ন ও উচ্চ আদালতসহ সারাদেশে প্রায় দেড় কোটি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। সূত্র – সমকাল