চাঁদা না পেয়ে মো. ফারুক হোসেন কামাল নামের এক ঠিকাদারকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগে করা মামলাসংশ্লিষ্ট নথি হাইকোর্ট থেকে গায়েব হয়ে গেছে। ফলে কাফরুল থানার এক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে করা ওই মামলার বিচার ঢাকার জজ আদালতে বন্ধ রয়েছে প্রায় চার বছর। নথি না পাওয়ায় মামলার বিচার কার্যক্রমের ওপর হাইকোর্টের দেওয়া স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের জন্য আইনি পদক্ষেপ নিতে পারছে না নিহতের পরিবার ও তাদের পক্ষে আইনি সহযোগিতা প্রদানকারী মানবাধিকার সংগঠন ব্লাস্ট।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রারের কাছে লিখিতভাবে আবেদন দিয়েও নথির হদিস পাওয়া যায়নি। ফলে নিম্ন আদালতে মামলাটির নথি না পাওয়ার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, নথিটি এখনো পাওয়া যায়নি। তবে তা খোঁজা হচ্ছে।
এ বিষয়ে ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট এস এম রেজাউল করিম বলেন, ‘ফারুক হত্যাসংক্রান্ত মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের জন্য আমরা দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চেষ্টা করছি। আমাদের আগেও তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু হাইকোর্টের দেওয়া স্থগিতাদেশ-সংক্রান্ত নথি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওই নথির জন্য হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রারের কাছে লিখিতভাবে আবেদন দিয়েছি। কিন্তু নথি এখনো পাওয়া যায়নি। ওই নথি না পাওয়ায় হাইকোর্টের দেওয়া স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের কোনো উদ্যোগ নিতে পারছি না। ফলে ঢাকার আদালতে মামলাটির বিচার শুরু করা যাচ্ছে না।’
ফারুককে হত্যার বিষয়ে তাঁর বোন পারভীন হকের করা মামলার অভিযোগে বলা হয়, ফারুক হোসেন কামালকে ২০১২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ধরে নিয়ে যান কাফরুল থানার এসআই নুরুজ্জামান। ফারুকের কাছে পুলিশের সোর্স বাবু (রতন) ও এসআই নুরুজ্জামান বিভিন্ন সময় চাঁদা দাবি করতেন। চাঁদা না পেয়ে ঘটনার দিন ফারুককে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর ওই দিন রাত ১১টায় ফারুকের সঙ্গে থানায় দেখা করেন পারভীন হক। পরদিন ২০ ফেব্রুয়ারি পারভীন হক তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে গেলে থানায় তাঁকে খুঁজে পাননি। তবে থানা পুলিশ ২১ ফেব্রুয়ারি ফারুককে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করে। কিন্তু তাঁর শারীরিক অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে মহানগর হাকিম রিমান্ড মঞ্জুর না করে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। কারা কর্তৃপক্ষ ২২ ফেব্রুয়ারি কারা হাসপাতালে ভর্তি করে ফারুককে। কিন্তু শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (ডিএমসিএইচ) ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিত্সাধীন অবস্থায় ২৮ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১১টায় মারা যান ফারুক হোসেন। এ ঘটনায় থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দিয়েও প্রতিকার না পেয়ে ফারুক হোসেনের বোন পারভীন হক ওই বছরের ৬ নভেম্বর ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে এসআই নুরুজ্জামান, সোর্স বাবুসহ পাঁচজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। পরবর্তী সময়ে আদালতের নির্দেশে কাফরুল থানা মামলা গ্রহণ করে।
এ মামলায় তদন্ত শেষে পুলিশ এজাহারনামীয় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। এরপর মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকা মহানগর আদালতে পাঠানো হয়। এই আদালত থেকে মামলাটি ২০১৫ সালে ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে পাঠানো হয়। বিশেষ জজ আদালতে ২০১৫ সালের ২৯ নভেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। অভিযোগ গঠনের পর আসামি নুরুজ্জামান হাইকোর্ট থেকে জামিন নেন। তিনি মামলাটি অন্য আদালতে স্থানান্তরের জন্য ২০১৬ সালে হাইকোর্টে আবেদন করেন (ক্রিমিনাল মিসসেলেনিয়াস নম্বর ৩৩৯৮০/২০১৬)। বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি আমীর হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আবেদনের ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ১৭ অক্টোবর এক আদেশে মামলার কার্যক্রম এক মাসের জন্য স্থগিত করেন এবং রুল জারি করেন। এরপর হাইকোর্টের অন্য একটি বেঞ্চ ওই বছরের ৮ নভেম্বর এক আদেশে এক বছরের জন্য স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়িয়ে দেন। পরবর্তী সময়ে বিচারপতি শওকত হোসেন ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর এক আদেশে স্থগিতাদেশের মেয়াদ আরো এক বছর বাড়িয়ে দেন।
এদিকে ঢাকার আদালতে মামলার বিচারকাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পারভীন হক আইনি সহযোগিতা চেয়ে ২০১৬ সালের ২ ডিসেম্বর ব্লাস্টের কাছে আবেদন জানান। এরপর ব্লাস্ট আইনগত সহায়তা দিতে উদ্যোগ নেয়। এরই অংশ হিসেবে ব্লাস্টের পক্ষ থেকে রুল শুনানির জন্য হাইকোর্টে আবেদন জানানো হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে নথি না পাওয়ায় ব্লাস্টের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত গত ২৩ মে বিচারপতি মো. হাবিবুল গনি ও বিচারপতি মো. বদরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চের কার্যতালিকার ১৫৪ নম্বরে রাখা হয় আদেশের জন্য। কিন্তু মামলার নথি উপস্থাপন না হওয়ায় ওই দিন আদালত আদেশ দিতে পারেননি। নথি না পেয়ে অবশেষে গত ২৮ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার গোলাম রব্বানীর কাছে লিখিত আবেদন দেয় ব্লাস্ট। এর পরও মামলার নথির খোঁজ মেলেনি। সূত্র: কালের কণ্ঠ