নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারের মূল ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণ হাঁটার পরই চোখে পড়ল কারা গার্মেন্টস ‘ইন্ডাস্ট্রিজ রিজিলিয়ান্স’। কারখানার ভেতরে সুইং মেশিনে সেলাই করে পোশাক তৈরি করছেন বন্দীরা। এসব পোশাক যাচ্ছে বিভিন্ন কারখানায়। সেখান থেকে বন্দীদের তৈরি পোশাক যাচ্ছে বিদেশে।
জেলা কারাগারের ভেতরে কারা গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিজ রিজিলিয়ান্সের মেশিন অপারেটর মো. রতন বলেন, নিটওয়্যারের কাটিং করা কাপড় সেলাই করে টি-শার্ট তৈরি করেন তাঁরা। উৎপাদনভিত্তিক মজুরিতে মাসে তাঁর আয় হয় ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। সেই উপার্জন থেকে স্ত্রী ও সন্তানের জন্য কিছু টাকা বাড়িতে পাঠান। বাকি টাকায় নিজের ও মামলার খরচ চালান।
আরেক মেশিন অপারেটর আলমগীর গাজী বলেন, তিনি একটি হত্যা মামলার আসামি। ১১ মাস ধরে হাজত খাটছেন। কারাগারে বন্দী থাকা পরিবারের জন্য বোঝা। আগে নিজের খরচের জন্য বাড়ি থেকে টাকা আনতে হতো। পোশাক কারখানা চালুর পর থেকে তিনি এখানে ৯ মাস ধরে মেশিন অপারেটরের কাজ করছেন। প্রতি মাসে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা আয় করেন। মাঝেমধ্যে বাবা-মায়ের জন্য টাকা পাঠান তিনি। বন্দী থেকেও পরিবারের জন্য কিছু করতে পারাটা অনেক আনন্দের।
কারাগারে পোশাক কারখানার উৎপাদনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েদি মোহাম্মদ লিটন বলেন, হত্যা মামলায় তাঁর ৩০ বছরের সাজা হয়েছে। ৯ বছর ধরে তিনি কারাগারে বন্দী। তিনি বলেন, প্রতিদিন তাঁরা তিন হাজার টি-শার্ট উৎপাদন করেন। কয়েদি ও বন্দীরা মানসম্পন্ন টি-শার্ট বানাচ্ছেন।
জেলা কারাগার সূত্রে জানা গেছে, কারাগারের ভেতরে অলস সময় কাটে বন্দীদের। নানা ধরনের অপরাধীর সঙ্গে সময় কাটানোর ফলে অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়েন বন্দীরা। অনেকে হতাশায় ভোগেন। মূলত তাঁদের পুনর্বাসন করতেই এই উদ্যোগ। পাঁচ হাজার বর্গফুটের শেডে রিজিলিয়ান্স পোশাক কারখানায় ৫৬টি সুইং মেশিন রয়েছে। কয়েদি, হাজতিসহ দুই পালায় তিন শতাধিক বন্দী সেখানে কাজ করছেন। তাঁরা টি-শার্ট তৈরি করছেন। বন্দীদের মধ্যে একজন উৎপাদন ব্যবস্থাপক রয়েছেন। তাঁর দায়িত্বে বন্দীদের প্রশিক্ষণ, পোশাক উৎপাদনসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা হয়। কারাগারে আটক ১ হাজার ৮৫৩ জন বন্দীর মধ্যে ৪০০ বন্দীই পোশাকশ্রমিক। নতুন বন্দীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা রয়েছে ভেতরে। তৎকালীন জেলা প্রশাসক রাব্বী মিয়ার সহযোগিতায় সমাজসেবা অধিদপ্তর, বিকেএমইএসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় পোশাক কারখানাটি স্থাপন করা হয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন ঢাকা বিভাগীয় সমন্বয়ক মাহবুবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কারাগারে বন্দীদের জন্য পোশাক কারখানা রয়েছে, এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। এটি মানবাধিকারের দিক দিয়ে সংগতিপূর্ণ। কারাগারে বন্দী বেকার বসে থাকবেন কেন? সক্ষম সব বন্দীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে যে যে কাজের উপযুক্ত তাঁকে সেই কাজে লাগানো প্রয়োজন। বন্দীরা যাতে তাঁদের শ্রমের ন্যায্য মজুরি পান, সেদিকটি আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।’
জেলা কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক সুভাষ কুমার ঘোষ বলেন, ‘আমরা কয়েকটি পোশাক কারখানা থেকে সাব–কন্ট্রাক্টে কাজ এনে পোশাক তৈরি করে তাদের দিচ্ছি। ওই পোশাক কারখানা আমাদের বন্দীদের তৈরি পোশাক বিদেশে রপ্তানি করছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রচুর কাজ আছে। মানসম্পন্ন টি-শার্ট তৈরি করা হচ্ছে। আমরা শুধু টি-শার্টের অর্ডার নিচ্ছি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত আমরা ১ লাখ ৩ হাজারটি টি-শার্ট তৈরি করে বিভিন্ন পোশাক কারখানায় সরবরাহ করেছি।’
এ বিষয়ে বিকেএমইএর পরিচালক নাসিম মঈন গণমাধ্যমকে বলেন, বন্দীদের সংশোধন ও পুনর্বাসনের জন্য এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। বিগত দিনে বিকেএমইএ তাদের সহযোগিতা করেছে। ভবিষ্যতেও বন্দীরা যাতে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের ফিরে আসতে পারে, সে বিষয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে।
উল্লখ্য, ২০১৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর বন্দীদের সংশোধন ও পুনর্বাসনের জন্য নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে পোশাক কারখানা ইন্ডাস্ট্রিজ রিজিলিয়ান্সের উদ্বোধন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।