ধর্ষণ মামলার প্রকৃত আসামি নয়ন ১৫ দিন আগে পুলিশের কাছে ধরা পড়েন। আদালতে ১৬৪ ধারায় নিজের দোষ স্বীকার করে জবানবন্দিও দেন। আদালত নয়নকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
কিন্তু মামলাটিতে ভুক্তভোগীর ভুলে আরেক নয়ন ২৫ দিন ধরে জেলহাজতে রয়েছেন। তাঁর এবার স্নাতক (পাস) তৃতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কারাগারে থাকায় তাঁর সেই পরীক্ষা দেওয়া হয়নি।
সখীপুর থানা থেকে নির্দোষ নয়নের বিষয়ে প্রতিবেদন আদালতে গেলেও নয়নের জামিন হচ্ছে না। নয়নের বাবা শাহজাহান মিয়া আদালতে গিয়ে আইনজীবীদের পেছনে প্রতিদিনই ঘুরছেন। কিন্তু আইনের মারপ্যাঁচে নির্দোষ নয়নের মুক্তি মিলছে না। তবে খুব শিগগির তিনি মুক্তি পাবেন বলে তাঁর আইনজীবী জানিয়েছেন।
সখীপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আসাদুজ্জামান জানান, প্রেমিকের ফোন পেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রী। মেয়েটিকে কক্সবাজারে নিয়ে একটি হোটেলে দুই রাত রেখে ধর্ষণ করা হয়েছে অভিযোগ এনে মেয়েটির মা গত ২৬ সেপ্টেম্বর সখীপুর থানায় মামলা করেন। মামলার পরদিন এজাহারে থাকা ঠিকানা মোতাবেক প্রধান আসামি নয়নকে (মেয়ের শনাক্তের ভিত্তিতে) গ্রেপ্তার করা হয়। আদালতের মাধ্যমে কারাগারে যাওয়ার আগে নয়ন পুলিশকে বলেন, তিনি সম্পূর্ণ নির্দোষ। তিনি মেয়েটিকে চেনেন না। এমনকি কোনো দিন দেখেনওনি। তিনি সিঙ্গাপুরে যাওয়ার জন্য স্কিল সেন্টারে ভর্তি হয়েছেন। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ওই সেন্টারে ক্লাস করেছেন। তিনি জীবনে কোনো দিন কক্সবাজারে যাননি।
গ্রেপ্তারকৃত নয়নের মা-বাবাও পুলিশকে বলেন, তাঁদের ছেলে প্রতিদিন রাতে খাবার খেয়ে ঘরে ঘুমিয়ে পড়তেন। ঘুম থেকে জেগে সকালের নাশতা খেয়ে আবার ট্রেনিং সেন্টারে ক্লাস করতে যেতেন। বিকেলে ফিরে আসতেন। কোথাও কোনো ভুলের কারণে তাঁদের ছেলেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কারণ, সখীপুর থেকে কক্সবাজারে যেতে কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা সময় লাগে। আসা-যাওয়ায় ২৪ ঘণ্টা লাগলে তাঁদের ছেলে কীভাবে কক্সবাজারে গেলেন, বিষয়টি তদন্ত করে দেখলে প্রকৃত রহস্য খুঁজে পাওয়া যাবে।
এসআই আসাদুজ্জামান জানান, ছেলেটি ও তাঁর বাবা-মায়ের কথা বিশ্বাস করে তাঁরা তদন্ত শুরু করলেন। মেয়েটির কাছে কক্সবাজারের হোটেলের একটি কার্ড ছিল। হোটেলটির ব্যবস্থাপকের সঙ্গে যোগাযোগ করে দুদিনের সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করা হলো। হোটেলের রেজিস্টারে থাকা নয়নের ফোন নম্বর সংগ্রহ করা হলো। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ফোন নম্বরের সূত্র ধরে আসল নয়নকে মামলা হওয়ার ১১ দিন পর ৭ অক্টোবর বাসাইল উপজেলা সদর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সিসিটিভির ফুটেজে থাকা ছবির সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া নয়নের হুবহু মিল পাওয়া যায়। একপর্যায়ে মেয়েটি আসল নয়নকে শনাক্ত করে এবং ভুলের জন্য ক্ষমা চায়। ৮ অক্টোবর প্রকৃত আসামি নয়ন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে ধর্ষণের কথা স্বীকার করলে আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠান।
আসল নয়ন বাসাইল উপজেলার বাঘিল গ্রামের ফারুক হোসেনের ছেলে।
মেয়েটি কেন নির্দোষ নয়নকে আসামি হিসেবে শনাক্ত করল, এ প্রশ্নের জবাবে মামলার বাদী বলেন, চার দিন পর ফিরে এসে তাঁদের মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে জানায়। সে সময় তাঁদের চাপে প্রেমিকের নাম ‘নয়ন’ বলে উল্লেখ করে। বাড়ি থেকে ২০০ গজ দূরে এক নয়নের নাম বললে মেয়েটি তাতে সম্মতি জানায়। পরে ওই নয়নের ঠিকানা সংগ্রহ করে তাকে একমাত্র আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করা হয়। মামলার এক দিন পর পুলিশ নয়নকে গ্রেপ্তার করলে তাঁদের মেয়ে থানায় গিয়ে তাকে শনাক্ত করে।
মেয়েটির মায়ের ভাষ্য, ৭ অক্টোবর আসল নয়ন গ্রেপ্তার হলে তখন তাঁদের মেয়ে জানায়, প্রতারক নয়নের নাম জানা ছাড়া আর কোনো তথ্যই তার জানা ছিল না। ফলে পরিবারের চাপ ও মারধরের ভয়ে সে সময় গ্রেপ্তার হওয়া নির্দোষ নয়নকে সে শনাক্ত করেছিল। তার মেয়ে এ ঘটনায় অনুতপ্ত। এখন আসল নয়ন গ্রেপ্তার হয়েছে। নির্দোষ নয়ন কারাগার থেকে ছাড়া পেলে তার কাছে মাফ চাইবে তাঁদের মেয়ে।
সখীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমির হোসেন বলেন, অল্প বয়সী মেয়েটি আসামিকে শনাক্ত করতে ভুল করায় নির্দোষ নয়ন বিনা অপরাধে ২৫ দিন ধরে কারাগারে রয়েছেন। বর্তমানে দুই নয়নই কারাগারে। তাঁরা আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছেন।
নির্দোষ নয়নের আইনজীবী সেলিম আল দীন বলেন, আগামী দু–তিন দিনের মধ্যে জামিন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তা না হলে ৩০ অক্টোবর অবশ্যই নয়নের মুক্তি মিলবে।
নির্দোষ নয়নের বাবা শাহজাহান মিয়া প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন করায় পুলিশকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, দেশজুড়ে তাঁর ছেলে ধর্ষক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তাঁর পরিবারের সম্মানহানি হয়েছে। তিনি মামলার বাদীর শাস্তি দাবি করছেন।