জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করে ১১ বছরে প্রতিকারের পাশাপাশি ৯৫ লাখ টাকার বেশি পেয়েছেন অভিযোগকারীরা। অভিযুক্ত ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আদায় করা জরিমানার অংশ থেকে তাঁদের এই টাকা দেওয়া হয়েছে।
অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, টাকা পাওয়া অভিযোগকারীদের অন্তত ৬০ শতাংশেরই অভিযোগ ছিল পণ্যের দাম বেশি নেওয়া। এর বাইরে মোড়কজাত পণ্যে উৎপাদন বা মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ না থাকা, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মানসম্মত পণ্য না পাওয়া এবং অনলাইনে পণ্য কিনে প্রতারিত হওয়ার ঘটনাও উল্লেখযোগ্য।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাছ থেকে কোনো পণ্য বা সেবা নিয়ে কেউ প্রতারিত হলে তিনি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করতে পারেন। পরে তদন্ত বা শুনানি শেষে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে জরিমানা করা হয়। আইন অনুযায়ী জরিমানার টাকার ২৫ শতাংশ পান অভিযোগকারী। বাকি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়।
অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পণ্য বা সেবা নিয়ে অভিযোগ করে টাকা পাওয়ার পাশাপাশি অভিযোগের সংখ্যা বেড়েছে। অধিদপ্তরের নিয়মিত অভিযান, সচেতনতামূলক নানা কার্যক্রম এবং ভোক্তাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে এই বৃদ্ধি ঘটেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৯ সালের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন পাসের মাধ্যমে। তখন থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত অভিযোগের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৭৯টি। যেগুলো নিষ্পত্তি করে অভিযোগকারীদের দেওয়া হয়েছিল মোট ২ লাখ ১২ হাজার ৭৫০ টাকা। আর চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে গত ২০ অক্টোবর পর্যন্ত অভিযোগ এসেছে ২ হাজার ৩৫৩টি। এর মধ্যে ৩৭৯টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করে অভিযোগকারীদের ৯ লাখ ৬৬ হাজার ৯০০ টাকা দেওয়া হয়েছে।
অধিদপ্তরের এক সহকারী পরিচালক নাম না প্রকাশের শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, প্রতিকার পাওয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে প্রচার এবং তাঁদের কার্যক্রমের কারণে অভিযোগের হার বেড়েছে।
অভিযোগের ধরন সম্পর্কে তিনি বলেন, পণ্য ও সেবা—দুই ধরনের বিষয় নিয়েই অভিযোগ আছে। পণ্যের ক্ষেত্রে বেশি দাম নেওয়া সংক্রান্ত অভিযোগই বেশি।
গত সোমবার (২১ অক্টোবর) একটি ফার্মেসিকে জরিমানা করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওই ফার্মেসির বিরুদ্ধে বিদেশ থেকে আমদানি করা একটি ওষুধ আগের চেয়ে প্রায় ৫০ টাকা বেশি দামে বিক্রির অভিযোগ এসেছিল। সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় ওই ফার্মেসিকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এর মধ্য থেকে আড়াই হাজার টাকা পেয়েছেন অভিযোগকারী।
আবার বাড়িমালিকের বিরুদ্ধে গ্যাসের দাম বেশি নেওয়ার মতো অভিযোগের কথাও জানিয়েছেন অধিদপ্তরের আরেক সহকারী পরিচালক আবদুল জব্বার মণ্ডল। তিনি বলেন, মোহাম্মদপুরের এক বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে এক ভাড়াটে অভিযোগ করেছিলেন, নির্ধারিত গ্যাসের দামের চেয়ে বাড়ির মালিক বেশি টাকা নিচ্ছেন। শুনানিতে এর সত্যতা পাওয়া যায়। বাড়ির মালিক ৮০০ টাকার জায়গায় ১০০০ টাকা নিয়েছিলেন। এই অপরাধে গত বৃহস্পতিবার বাড়ির মালিককে জরিমানা করে তার ২৫ শতাংশ অভিযোগকারীকে দেওয়া হয়েছে।
অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ২৬ হাজার ১৩২টি অভিযোগ এসেছে। এগুলোর মধ্যে ২৪ হাজার ৭৭১টি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এতে ৫ হাজার ৪৯৮ জন অভিযোগকারীকে ৯৫ লাখ ৯৩ হাজার ২৭ টাকা দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগের সংখ্যার তুলনায় জরিমানার টাকা পাওয়া অভিযোগকারীর সংখ্যা কম হওয়া সম্পর্কে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, ২৬ হাজার ১৩২টি অভিযোগের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার অভিযোগই এমন, যার প্রতিকার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে নেই। আবার কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগ দায়েরের পর দুই পক্ষ আপস করে অভিযোগ তুলে নেয়। কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় না। আবার কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগকারীর কাছে প্রমাণ না থাকায় কিছু করা যায় না। এ ছাড়া আইন অনুযায়ী সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে অভিযোগ করতে হবে। অনেকেই এরপর অভিযোগ করেন। তখন অভিযোগটি আর আমলে নেওয়ার সুযোগ থাকে না। এসব কারণে অভিযোগের সংখ্যা বেশি হলেও জরিমানার টাকা পাওয়া ব্যক্তির সংখ্যা কম।
অভিযোগের প্রক্রিয়া
ডাকযোগে, ফোন-ফ্যাক্স, ই–মেইল বা সরাসরি অধিদপ্তরের কার্যালয়ে এসে অভিযোগ করা যায়। তবে অভিযোগটি লিখিত হতে হবে। অভিযোগের সঙ্গে পণ্য বা সেবা ক্রয়ের রসিদ যুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া অভিযোগকারী পূর্ণাঙ্গ নাম, পিতা ও মাতার নাম, ঠিকানা, ফোন, ফ্যাক্স ও ই-মেইল নম্বর (যদি থাকে) এবং পেশা উল্লেখ করতে হবে। ০১৭৭৭ ৭৫৩৬৬৮ নম্বরে ফোন করে এবং https://dncrp.portal.gov.bd এই ওয়েবসাইটে গিয়ে এ–সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে।
অভিযোগ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া
অভিযোগ আমলে নেওয়ার পর অভিযোগকরী এবং যার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, উভয় পক্ষকে শুনানির জন্য ডাকবেন অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। এরপর তথ্যপ্রমাণ সাপেক্ষে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অভিযোগের নিষ্পত্তি করবেন। নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে ওই কর্মকর্তা সরেজমিনে তদন্ত বা পরীক্ষাগারে পণ্য পরীক্ষার জন্য যেতে পারেন। এভাবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অভিযোগের নিষ্পত্তি করা হয়।
অভিযোগ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিকার পাওয়া এক নারী বলেন, অভিযোগ করা থেকে নিষ্পত্তি হওয়ার পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটিই তাঁর কাছে স্বচ্ছ মনে হয়েছে। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও তাঁর প্রতি আন্তরিক আচরণ করেছেন। তিনি অধিদপ্তরের কার্যক্রমে নিজের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। প্রথম আলো