ব্লাসফেমির ধারনা আহরিত হয়েছে ইউরোপের মধ্যযুগীয় ক্যাথলিক চার্চ থেকে, সম্রাট জাস্টিনিয়ান (৫২৭-৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে)-এর আমলে। ব্লাসফেমি বলতে বোঝান হত, কথায় কিংবা কাজে ধর্ম নিন্দা বা ঈশ্বরনিন্দা করা। রোমান সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ান ব্লাসফেমির শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করেন। এই বিধান করার পিছনে প্রবল ধর্মানুরাগ সক্রিয় ছিল না, ছিল রাজতান্ত্রিক কায়েমি স্বার্থ রক্ষার প্রয়াস। ব্লাসফেমির বিকাশ খ্রিস্ট ধর্মের এক অন্ধকার সময়ে এ কথা অনস্বীকার্য। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ব্লাসফেমির যে সংজ্ঞা বিভিন্ন পুস্তকে এবং অভিধানে পাওয়া যায় তা হতে খ্রিস্ট ধর্মের ক্ষেত্রে এর ব্যবহারের প্রমাণ মেলে। Osborn’s concise Law Dictionary তে ব্লাসফেমি শব্দটিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এই ভাবে– The public or criminal libel of speaking matter relating God, Jesus Christ,the Bible or the book of common prayer , intending to wound the feelings of mankind or to excite contempt and hatred against the church by law established or to promote immorality. অর্থাৎ খ্রিস্ট ধর্ম এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোন ধরনের কটূক্তি করাই হচ্ছে ব্লাসফেমির মূল বক্তব্য ।
মধ্যযুগের আইন ব্লাসফেমি
বর্বর মধ্যযুগে ইউরোপের শাসন ব্যবস্থা ছিল সামন্ততান্ত্রিক কূপমণ্ডূক শাসন তথা শোষণের এক অভূতপূর্ব প্লাটফর্ম। রাজতন্ত্র ব্যবস্থায় রাজার বিরুদ্ধে বা রাজশাসনের বিরুদ্ধে কোন ধরনের প্রশ্ন করা অথবা মতামত প্রদানই ছিল ‘ঐশী এখতিয়ারের বিরুদ্ধে ধর্মীয় পাপাচারে লিপ্ত হওয়া। রাজতন্ত্রে প্রচলিত আরোপিত বিশ্বাস রাজা ঈশ্বরের প্রতিনিধি, তাই তার কর্তৃত্ব প্রশ্নাতীত। খ্রিষ্টীয় গির্জা আরও একধাপ এগিয়ে এর ব্যাখ্যা প্রদান করল- যেহেতু রাজকর্তা ঈশ্বরের প্রতিনিধি, তাই তার বিরোধিতা করা ঈশ্বরের বিরোধিতার নামান্তর, ফলে তা চরমতম শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পরবর্তীতে ধর্মীয় অপব্যাখ্যায় রাজার কার্যক্রমের বৈধতা প্রদানে ব্লাসফেমি আইনের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। এ সকল স্বৈরতান্ত্রিক ধারনার দৃষ্টিকোণ হতে বৈধতা প্রদানে পরবর্তী সময়ে আর্চ বিশপ লড (land) এক ধরনের নেগেটিভ ভূমিকা পালন করেন। আর্চ বিশপ প্রচার করেন-‘রাজার আদেশ- নির্দেশ নিয়ে তর্ক করা পাপতুল্য। সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিসরে ধর্ম একীভূত করে স্বৈরেচারী বাবস্থার পাকা গোড়াপত্তন করেন।
একই ধরনের বাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল ফরাসী দেশজুড়ে। যার সমর্থন যুগিয়েছিল রোমান ক্যাথলিক চার্চ। পরবর্তীতে রোমান ক্যাথলিক চার্চের কূপমণ্ডূকতা এবং প্রতিক্রিয়াশীল কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে সংস্কারবাদী প্রটেস্টান্ট আন্দোলনের ক্রমবিকাশে ধর্মীয় আবরনে রাজতন্ত্রে ধর্মের বিরুদ্ধে অপরাধ দমনে ব্লাসফেমি আইনের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। ঈশ্বরদ্রোহিতার অভিযোগকে সামনে এনেই প্রটেস্টান্টবাদী ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনকে দমন করার জন্য জঘন্য প্রয়াস চালানো হয়। ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল রাজতন্ত্রে এমন প্রথাও চালু ছিল যে, যে যত জন ব্লাসফেমিতে অভিযুক্ত প্রটেস্টান্টানকে হত্যা করবে, তাকে তত নারী প্রদান করা হবে। উল্লেখ্য যে, খ্রিস্ট ধর্ম নয়, চার্চের আধিপত্য অটুট রাখার জন্য ব্লাসফেমি আইন প্রচলন করা হয়।
মধ্যযুগে প্রতিষ্ঠিত সকল বর্বর নৈতিকতা ও শোষণমূলক সামাজিক শ্রম বিভাজনের প্রতি রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রবল আসক্তির প্রমাণ পাওয়া যায় পোপের উক্তিতে। ক্রমান্বয়ে ইউরোপীয় চার্চ ও পোপের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পোপের ক্ষমতা এক পর্যায়ে রাজার ক্ষমতার থেকেও বেশি হয়ে যায়। রাষ্ট্রীয় ধর্মীয় সংঘ প্রধান পোপের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। রোমান চার্চের ক্ষমতা সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছে পোপ Innocent-III এর সময় । এ সময় রোমান সম্রাজ্যের পতনের পর যাজক ছাড়া কারো লেখাপড়ার কোন অধিকার ছিল না। চার্চের মতবাদ ও শিক্ষার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুললে শাস্তি হতো মৃত্যুদণ্ড । ক্ষমতা রক্ষা ও আধিপত্য বিস্তারই ছিল এই চার্চের শাসন ব্যবস্থার মূল । মানব কল্যাণ সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত ছিল।
পরবর্তীতে খ্রিস্টান জগতে চার্চে রাজনৈতিক প্রভাব বিলুপ্ত হওয়ার সাথে সাথে ব্লাসফেমি আইনের ব্যবহার কমতে শুরু করে। ধর্ম হয় মানুষের অনুসরণের ব্যাপার। কেউ চার্চের কথা কেউ না মানলে ব্লাসফেমি বা ধর্মদ্রোহিতায় তাকে হত্যা করার প্রথা বিলুপ্ত হয়। চার্চের আধুনিক ব্যাখ্যায় ধর্মের খেলাফ কাজ হলো পাপ। পাপের শাস্তি মানুষে দেবার অধিকার নেই। পাপের শাস্তি দেন ঈশ্বর । ১৯২১ সালের পর থেকে ইংল্যান্ডে এই আইনের ব্যবহার দেখা যায় না ।
বর্তমান সময়ে ব্লাসফেমি আইনের ব্যবহার
ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের দেশসমূহের ব্লাসফেমি আইনের মত অগণতান্ত্রিক এবং সামন্তবাদি আইন ব্যবস্থার ক্রম বিলুপ্তি ঘটলেও বর্তমান এশীয় কিছু মৌলবাদীপুষ্ট দেশের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। পাকিস্তান, ইরান, ইসরাইল প্রভৃতি দেশে এই আইনের প্রচলন আছে। পাকিস্তানে এই আইনের প্রচলন হয় জেনারেল জিয়াউল হকের স্বৈরশাসন আমলে। লক্ষ্যণীয় যে, পাকিস্তানের স্বৈরশাসকও এই ধরনেই আইন প্রচলন করে ক্ষমতাযন্ত্রের সাথে ধর্ম মিলিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। এই আইন প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকেই সে দেশেও আইনি ব্যাপক ভাবে সমালোচিত হচ্ছে ও এর অপব্যবহার ব্যাপক ভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যার উদাহরণ পাকিস্তানের আখতার হামিদ খান মাম্লা, সালামত মাসিহর মামলা সমূহে লক্ষ্য করা গেছে। সম্প্রতি পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনে এক খ্রিস্টান নির্দোষ মহিলাকে আদালত দণ্ড প্রদান করে যা দেশে –বিদেশে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে। ব্লাসফেমি আইন নিয়ে উম্মাদনা কোন পর্যায়ে গেছে তার একটি দুঃখজনক উদাহরন হচ্ছে- নাইমাত আহমার এর ঘটনাটি। নাইমাত ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। তার হত্যাকারী ফারুক আহমেদ জানায় যে, সে অপরের কাছে শুনেছে এবং হাতে লেখা পোস্টারের দেখেছে যে, জৈনক খ্রিষ্টান স্কুল শিক্ষক নাকি নবীর অবমাননা করেছে। পুলিশ কেন অতিসত্বর নাইমাত এর ব্যাপারে কিছু করলো না, তা ভেবে ফারুক নিজেই হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় ও তা কার্যকর করে। পাকিস্তানে এ সংক্রান্ত যে সমস্ত মামলা বিচারাধীন আছে সেগুলো অধিকাংশই সংখ্যালঘু, যেমন আহম্মদিয়া ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে।
ব্লাসফেমি আইন ও ইসলামি আইন বিজ্ঞান
ইসলাম ধর্মে সুস্পষ্টভাবে পবিত্র কুরআনে বারবার সহনশীলতা এবং ধর্ম পালনের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে এ ধরনের কোন বিধান নেই। বস্তুত যারা ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ কিংবা আল্লাহ তায়ালার নিন্দা করে তাদেরকে পরকালে আল্লাহ শাস্তি প্রদান করবেন । ইহজগতে এই অপরাধের শাস্তি প্রদান করার ক্ষমতা আল্লাহ তায়ালা কোন মানুষকে দেননি। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরানে পরিষ্কার বলা হয়েছে- ‘যখন তোমরা শুনবে আল্লাহর কোন আয়াতকে অস্বীকার করা হচ্ছে এবং তা নিয়ে বিদ্রূপ করা হচ্ছে তখন তোমরা এদের সঙ্গ পরিত্যাগ কর, ততক্ষণ না তারা এই প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে ফিরে আসে। অন্যথায় তোমরাও তাদের দলে গণ্য হবে। কপট এবং সত্য প্রত্যাখ্যানকারী সবাইকে আল্লাহ জাহান্নামে একত্র করবেন।(সূরা নিসাঃ ১৪৪)
ইসলাম মানুষের চিন্তা ও মতপ্রকাশে স্বাধীনতার ওপর কখনও হস্তক্ষেপ করে না। কারণ ঈমান বা বিশ্বাস হচ্ছে মানুষের অন্তরের ব্যাপার। কোন মতাদর্শ জোর করে কারও ওপর চাপিয়ে দেয়া যায় না। গায়ের জোরে চাপিয়ে দিলে সেটা আর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিকট সত্য বলে বিবেচিত হয় না। এ জন্যই আল্লাহ ধর্মীয় ব্যাপারে মানবজাতিকে পুরো স্বাধীনতা দিয়েছেন। পবিত্র কোরানে ঘোষণা করা হয়েছে- ধর্ম বা জিবনপদ্ধতি গ্রহনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই (২ঃ২৫)। ‘বল, সত্য তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে প্রেরিত, সুতরাং যার ইচ্ছা হয় বিশ্বাস করুক এবং যার ইচ্ছা হয় সত্য প্রত্যাখ্যান করুক’ (১৮ঃ২৯)। এমনি করে পবিত্র কোরআনের বহু স্থানে মানুষকে ধর্ম গ্রহনের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে ।
এই আইনের লক্ষ্য কোন অবস্থাতেই ধর্ম রক্ষা নয়- ধর্মের প্রশ্ন এখানে বাহুল্যমাত্র; উদ্দেশ্য প্রগতিশীল মুক্তবুদ্ধির চর্চাকে স্থায়ীভাবে নির্মূল করা।