উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে সংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকলেও গত ৪১ বছরে কোনো আইন প্রণয়ন হয়নি। এ ব্যাপারে নীতিমালা করতে উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা এবং আইন কমিশনের সুপারিশ থাকলেও অদ্যাবধি সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে বিচারক নিয়োগে স্বচ্ছতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যে প্রশ্ন উঠছে, সে বিষয়টির সমাধান হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, যোগ্যতর ব্যক্তিকে বাছাই করার স্বার্থে বিচারপতি নিয়োগে আইন করা জরুরি হলেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার পর থেকে সব সরকারই তা উপেক্ষা করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৭৮ সালে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০১২ সালে প্রথম আইন তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে এখনও আইনটির খসড়া চূড়ান্ত হয়নি। এরই মধ্যে রোববার ৯ জনকে অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। সোমবার শপথ শেষে তারা কাজে যোগ দিয়েছেন।
জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির সঙ্গে রাষ্ট্রপতি পরামর্শক্রমে বিচারক নিয়োগ দিবেন। এখানে আইন মন্ত্রণালয়ের কিছুই করার নেই।
আইনমন্ত্রী বলেন, অত্যন্ত স্বচ্ছতার মধ্যেই বিচারক নিয়োগ হচ্ছে। তারপরও আইন বা নীতিমালা করা যায় কি না, এ নিয়ে মন্ত্রণালয় চিন্তাভাবনা করছে।’
২০০৯ সালের ২ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এক রায়ে জোট সরকারের সময়ে বাদ পড়া ১০ বিচারপতিকে স্থায়ী নিয়োগের ক্ষেত্রে পাঁচ দফা নির্দেশনা দেন। এতে বলা হয়, বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির পরামর্শ গ্রহণ সাংবিধানিক রেওয়াজ। এ রেওয়াজ সাংবিধানিক রীতিনীতিতে পরিণত হয়েছে। এটা আইনের শাসনের অংশ, বিচারক নিয়োগ ও বাছাইয়ের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির পরামর্শ বা মতামত প্রাধান্য পাবে। তবে তাদের পেশাগত যোগ্যতা ও উপযুক্ততা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের মতামত নেয়া হবে। এছাড়া বিচারক নিয়োগে একটি নীতিমালা করার জন্য উচ্চ আদালত থেকে বিভিন্ন সময় একাধিক মতামত আসে।
২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগ উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে সাত দফা নির্দেশনা প্রদান করেন। বিচারক নিয়োগে বাছাই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা আনতে হাইকোর্টের দেয়া রায়ে বলা হয়, সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে বিচারক নিয়োগের জন্য আবেদন আহ্বান করা যেতে পারে।
আবেদনকারী ব্যক্তিকে সম্পদের বিবরণ উল্লেখসহ সুপ্রিম কোর্টে সাক্ষাৎকার দিতে হবে। এটি বিচারক নিয়োগকে অধিকতর স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও কার্যকর করার একটি উৎকৃষ্ট পন্থা। পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সুপারিশ করা ব্যক্তির শিক্ষাজীবনে দারুণ ফলাফল, সমৃদ্ধ পেশাগত দক্ষতা, আইনগত বিচক্ষণতা ও একাগ্রতা থাকতে হবে।
হাইকোর্টের নির্দেশনার পর ২০১৭ সালের ২৪ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যকরী কমিটির সাধারণ সভায় হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী নীতিমালা প্রণয়ন করে বিচারপতি নিয়োগ করার দাবি জানানোর সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
এ বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়েগে আইন বা নীতিমালা করাটা জরুরি। এটা করলে ক্ষতি নেই বরং লাভ।’
তিনি বলেন, ‘আমি আইনমন্ত্রী থাকার সময়ে বিচারপতি নিয়োগে নীতিমালা চূড়ান্ত খসড়া করেছিলাম। এরপর কী হল, জানা নেই। বর্তমানে সংবিধান অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি বিচারক নিয়োগ দেন। এখানে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দিলে বিতর্কের কোনো সুযোগ থাকে না।’
সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘বিচার বিভাগের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি দূর করা এবং সংবিধান অনুসারে বিচারপতি নিয়োগে বিধিমালা প্রণয়ণ করা প্রয়োজন। আমরা চাই বিচার বিভাগ দুর্নীতিমুক্ত হোক। বিচারপতি নিয়োগে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করে নিয়োগ প্রদান করা হোক।’
অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘সংবিধানের তৃতীয় ভাগে উল্লেখ আছে উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে সুস্পষ্ট আইন করার। কিন্তু গত ৪১ বছরেও তা করা হয়নি।’
সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে বিচারক নিয়োগ বিষয়ে বলা আছে। ৯৫ (১)-এ বলা হয়েছে, ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারপতিকে নিয়োগদান করবেন।’
৯৫(২) অনুসারে কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক না হলে এবং (ক) সুপ্রিমকোর্টে অন্যূন ১০ বছর অ্যাডভোকেট না হয়ে থাকলে, বা বাংলাদেশের (খ) রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অন্যূন ১০ বছর কোনো বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান না করে থাকলে, অথবা (গ) সুপ্রিমকোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ লাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকলে, তিনি বিচারপতি পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না।
বর্তমানে সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগে (সোমবার পর্যন্ত) মোট বিচারপতি হচ্ছেন ১০৮ জন। এর মধ্যে আপিল বিভাগে ৭ জন এবং হাইকোর্ট বিভাগে ১০১ জন। এই ১০১ জনের মধ্যে অসদাচরণের অভিযোগে তিন বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে সাময়িকভাবে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত হয়। তারা হলেন- বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি একেএম জহিরুল হক এবং বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক। তাদের নাম সুপ্রিমকোর্টের তালিকায় থাকলেও বিচারকাজ থেকে এখনও বিরত রাখা হয়েছে। সূত্র- যুগান্তর