সিরাজ প্রামাণিক:
একটি সংগৃহিত আইনী কৌতুক দিয়েই লেখাটি শুরু করি। জাতিসংঘের একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে বাংলাদেশের একজন পুলিশ কর্মকর্তা যোগ দেন। তার সঙ্গে সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স আর বৃটেনের একজন করে পুলিশ কর্মকর্তাও যোগ দেন। তাদের প্রশিক্ষণের একটি অংশ ছিল আমাজান বনে। এ বনের মধ্যে কয়েকটি হরিণের বাচ্চা ছেড়ে দেয়া হয়। কর্মকর্তাদের বলা হয় যে, এ বাচ্চাগুলোকে খুঁজে বের করে আনতে হবে। সময় দেয়া হবে একদিন। তবে এর বেশী সময় লাগলেও হরিণের বাচ্চা ছাড়া খালি হাতে ফেরা যাবেনা। সুইজারল্যান্ডের পুলিশ কর্মকর্তা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই হরিণের বাচ্চা উদ্ধার করে ফিরলেন। ফ্রান্সের পুলিশ হরিণের বাচ্চা নিয়ে হাজির হন তিন দিন পর। বৃটেনের কর্মকর্তা সাত দিন পর। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তা ১৫ দিন পর। কিন্তু বাংলাদেশের পুলিশের কর্মকর্তার কোন খোঁজ নেই। প্রশিক্ষকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। একমাস পর ব্রজিলের বিভিন্ন শহর থেকে ঘুরে ফিরে একটি ছাগলের বাচ্চা নিয়ে হাজির হলেন বাংলাদেশী পুলিশ কর্মকর্তা। প্রশিক্ষকরা প্রশ্ন করলেন, ছাগলের বাচ্চা নিয়ে আসলেন কেন? জবাবে পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কে বলেছে এটা ছাগলের বাচ্চা। একে রিমান্ডে দেন। দেখবেন পরদিন এটা নিজেই স্বীকার করবে যে সে একটা হরিণের বাচ্চা।
কাজেই রিমান্ডে পুলিশ গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে কিভাবে হেফাজত করে তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কারো বোঝা কঠিন। শুনলেই গা শিউরে উঠার মতো সেই হেফাজতের বর্ণনা। রাজনীতির পজিশন-অপজিশনের অনেকেই সেই হেফাজতের ভুক্তভোগী। স্বাধীনতার পর রিমান্ডের নানা বীভৎস ও ভয়ংকর পর্বের স্বাদ নিতে হয়েছে রাজনীতিকদের অনেককেই। ১৮৯৮ সালের মান্ধাতা আমলের ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪, ১৬৪ ও ১৬৭-এর বহুবিধ ও যত্রতত্র ব্যবহার জনমনে বিতৃষ্ণার জন্ম দিয়েছে। এমনকি অনেকে বলেও ফেলেন যে, দৈত্যতন্ত্র ক্রমান্বয়ে গণতন্ত্রকে রাহুগ্রাসে নিপতিত করছে।
মূলা চুরির অভিযোগে গ্রেফতারকৃতকেও রিমান্ডে নেয়ার ক্ষমতা আছে পুলিশের। এক্ষেত্রে পুলিশের ক্ষমতা অবারিত। ৫৪ ধারায় গ্রেফতারকৃত এমনকি আদালতে আত্মসমর্পণকারীকে রিমান্ডে নেয়ার ক্ষমতাও চর্চা করছে পুলিশ। আদালতে ডিমান্ড করলেই ম্যাজিস্ট্রেট রিমান্ড দিতে অনেকটা বাধ্য। পুলিশের ডিমান্ডে মঞ্জুরকৃত রিমান্ডের কমান্ডিংও থাকে পুলিশেরই হাতে। যদিও ম্যাজিস্ট্রেটের কোনো আসামিকে পুলিশ রিমান্ডে দেওয়া না দেওয়ায় ক্ষমতা দু’টোই আছে। তবে রিমান্ডে দেওয়ার ক্ষমতা যতো বেশি, না দেওয়ার ক্ষমতা ততো নয়। এক্ষেত্রে পুলিশের ডিমান্ডই বেশি কার্যকর। বলা যায়, এ কাজে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পুলিশের।
বরাবরই পুলিশের এ নিরঙ্কুশ ক্ষমতার বেনিফিট নেয় ক্ষমতাসীনরা, প্রভাবশালীরা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাউকে প্লেট চুরি, ঘড়ি চুরি, মোবাইল ফোন চুরির মতো মামলা দিয়ে গ্রেফতারের পর পরই নেয়া হয় রিমান্ডে। মামলা আসল উদ্দেশ্য নয়। আসল উদ্দেশ্য রিমান্ডে নিয়ে নাস্তানাবুদ করা। সোজা কথায় ধোলাই দেওয়া। এর প্রক্রিয়া হচ্ছে প্রথমে মামলা সাজানো। এরপর বিদ্যুৎগতিতে গ্রেফতার-নাজেহাল, ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চালান। সেখান থেকে পুলিশ রিমান্ডে। আসামিপক্ষ নামজাদা উকিল-ব্যারিস্টার দিয়েও এ রিমান্ড ঠেকাতে পারে না। কারণ রিমান্ড ঠেকানোর আইনি কোনো শক্ত বিধান নেই বললেই চলে। রিমান্ডে নেয়ার জন্য পুলিশের স্বপক্ষে যতো সহজতর আইনি বিধান আছে; রিমান্ডে না নেয়ার জন্য আসামি পক্ষে তা নেই। স্মরণ করতে পারেন না রিমান্ডে তার ওপর কী নিপীড়ন চলেছিল। এমনিতেই পুলিশ অত্যন্ত ক্ষমতাধর। প্রকাশ্যে, গোপন স্থানে বা থানার লকআপে যেকোনো স্থানে যে কোনো সময় কাউকে আচ্ছা মতো ধোলাই দেয়ার ক্ষমতা পুলিশের আছে। এ ক্ষমতা পুলিশ অহরহরই চর্চা করছে। আর রিমান্ড হচ্ছে অনেকটা আইনগতভাবে নির্যাতনের পর্ব। প্রচলিত কোনো আইনেই রিমান্ডে নির্যাতন অপরাধ হিসেবে গণ্য নয়। কম্বল থেরাপি (কম্বল প্যাঁচিয়ে পেটানো), বস্তা থেরাপি (বস্তায় পুরে পেটানো-আছড়ানো), বাদুর ধোলাই (উল্টো করে ঝুলিয়ে পেটানো), ড্যান্সিং টর্চার (বৈদ্যুতিক শক), পায়ুপথে লাঠি বা গরম ডিম ঠুকানো, পেনিস থেরাপি ইত্যাদি ধরনের লোমহর্ষক নিপীড়নে হেফাজত করা হয় সেখানে। আর রিমান্ডের আসামীটি নারী হলে হেফাজতের নমুনা হয় আরো জঘন্য-অকথ্য। সুস্থ-স্বাভাবিক কোনো নারীর পক্ষে রিমান্ডের সেই বর্ণনা বাইরের কারো কাছে বলার মতো নয়। অবশ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা পুলিশ রিমান্ডে নির্যাতনের কিঞ্চিত বর্ণনা প্রকাশ করেছিলেন।
পাঠক এবার আসল কথায় আসি। পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি আইনে কতটুকু, কখন গ্রহনযোগ্য তা নিয়েই মূলতঃ আমার এ লেখা। সাক্ষ্য আইন ১৮৭২-এর ২৪ ধারা মোতাবেক ‘কোনো প্রলোভন, ভীতি প্রদর্শন বা সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায় করা হলে তা অপ্রাসঙ্গিক বলে বিবেচিত হবে। দোষ স্বীকার অবশ্যই স্বেচ্ছাকৃত ও বিনা ভয়ভীতিতে হতে হবে।’ সাক্ষ্য আইন ১৮৭২-এর ২৫ ও ২৬ ধারা মোতাবেক ‘কোনো অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি পুলিশ কর্মকর্তার কাছে বা পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন অবস্থায় দোষ স্বীকার করলে এটি তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে না।’ এই ধারার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে যে, অসহায় অভিযুক্তকে পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করা। পুলিশ যাতে বে-আইনিভাবে কাউকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দিতে না পারে সে জন্য এই ধারা রক্ষা কবচ হিসাবে কাজ করে। যে কোন পদবীরই পুলিশ অফিসার হন না কেন তার সামনে স্বীকারোক্তি আইনে অপ্রাসঙ্গিক।
সাক্ষ্য আইনের ২৪ ধারা অনুযায়ী, স্বীকারোক্তি সবসময় নিজে জড়িত করে প্রদান করতে হবে। নিজেকে জড়িত না করে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিলে তা স্বীকারোক্তি হিসাবে গণ্য হবে না। এখন এই স্বীকারোক্তি ২৪ ধারা অনুসারে অপ্রাসঙ্গিক প্রমান করতে হলে আদালত যুক্তিসঙ্গত বিষয়ের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। যেমন কার নিকট দোষ স্বীকার করা হয়েছে, কোন সময় ও কোন স্থানে দোষ স্বীকার করা হয়েছে, কি পরিস্থিতির উপর দোষ স্বীকার করা হয়েছে, এইসব বিষয়গুলো আদালত ভালভাবে খুঁটিয়ে দেখবেন। এটা স¤পূর্ণ আদালতের এখতিয়ার।
কিন্তু সাক্ষ্য আইন ১৮৭২-এর ২৭ ধারায় বলা হয়েছে যে, পুলিশের কাছে আসামির দোষ স্বীকার অনুযায়ী কোনো অপরাধমূলক জিনিস যদি উদ্ধার করা হয় বা পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে আসামী কর্তৃক দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মামলার বিচার্য বিষয়ের সাথে প্রাসঙ্গিক কোন বস্তু বা আলামত যদি উদ্ধার করা হয় তাহলে ওই উদ্ধারকৃত অংশের বিবৃতি তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে। আসামী পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে পুলিশ অফিসার যদি আসামীর স্বীকারোক্তি ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে আদায় করেন তাহলে সেই স্বীকারোক্তি আদালতে গ্রহণযোগ্য বা প্রাসঙ্গিক। সাক্ষ্য আইনের ২৯ ধারা মতে, আসামী পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে পুলিশ অফিসার যদি আসামীকে শুধু গোপনীয়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করেন তাহলে সেই স্বীকারোক্তি আদালতে গ্রহণযোগ্য বা প্রাসঙ্গিক।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ‘আসামি পুলিশকে বলল, ‘আমি চাকু দিয়ে আঘাত করে তাকে হত্যা করেছি এবং ওই চাকু পুকুরে ফেলে এসেছি।’ পুলিশ ওই চাকু পুকুর থেকে উদ্ধার করল, তখন আদালতে ওই বিবৃতির অংশ তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হবে। মোটকথা, পুলিশের কাছে দোষ স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে আসামিকে শাস্তি দেওয়া যায় না, শাস্তি দিতে হলে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে স্বীকার করতে হবে। তাহলে রিমান্ডে নেয়ার যৌক্তিকতা কি?
যে আইন মানবাধিকার রক্ষা করতে পারে না, যে আইন ন্যায়পর নীতিমালা রক্ষা করতে পারে না, যে আইন সংবিধান সমুন্নত রাখতে পারে না, যে আইন সব স্বচ্ছতা, যৌক্তিকতা এবং পদ্ধতিগত সংহতি রক্ষা করতে পারে না, সেই আইন আর যাই হোক জনস্বার্থ রক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে সক্ষম এ কথা বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিক অবকাশ নেই। প্রিয় পাঠক! আসুন আমরা একটি ইতিবাচক সংবাদের অপেক্ষায় থাকি। যেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকার পাতায় দেখতে পাবো ‘ সকল কালো আইন প্রতিরোাধ হয়েছে।’ সেদিন আমাদের সংবিধানের শ্বাসত বাণী চিরন্তন রুপ পাবে। শুরু হবে নতুন এক যুগের।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা, গবেষক, সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email: seraj.pramanik@gmail.com
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম -এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।