সহকারী জজ একরামুল হক শামীম

সাকিবকে সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে আইসিসি নিজেই আইন মানেনি!

একরামুল হক শামীম:

ম্যাচ ফিক্সারের হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ পাওয়ার বিষয়টি আইসিসির দুর্নীতি বিরোধী ইউনিটের কাছে না জানানোর কারণে সাকিব আল হাসানকে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে ২ বছরের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আইসিসি। ICC Anti-Corruption Code অনুযায়ী এ সাজা প্রদান করা হয়েছে। তবে সাকিব অভিযোগ স্বীকার করে নেওয়ায় এবং তদন্তকাজে সহযোগিতা করায় শাস্তির মেয়াদের ১ বছর শর্তসাপেক্ষে স্থগিত রাখা হয়েছে। সাকিবের বিরুদ্ধে আদেশের সম্পূর্ণ অংশ আইসিসির ওয়েবসাইটে রয়েছে।

এই লিংক থেকে তা পাওয়া যাবে- Shakib Al Hasan banned after accepting three charges under ICC Anti-Corruption Code

যে ঘটনার প্রেক্ষিতে সাকিবকে সাজা প্রদান করা হয়েছে তা সিদ্ধান্তের ১১ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয়:

২০১৭ সালের নভেম্বরে সাকিব আল হাসান ঢাকা ডায়নামাইটসের হয়ে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগে অংশগ্রহণ করেন। তখন সাকিবের পরিচিত একজন ব্যক্তি ‘আগারওয়াল’ নামের একজনকে সাকিবের টেলিফোন নম্বর দেয়। ২০১৭ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি আগারওয়ালের সাথে সাকিবের বেশকিছু হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ চালাচালি হয়, যেখানে আগারওয়াল সাকিবের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে সাকিব বাংলাদেশ, শ্রীলংকা ও জিম্বাবুয়ের অংশগ্রহণে ত্রিদেশীয় সিরিজে অংশগ্রহণ করেন। সেই সিরিজ চলার সময়ে আগারওয়ালের সাথে সাকিবের হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা বিনিময় হয়। ২০১৮ সালের ১৯ জানুয়ারি আগারওয়াল সাকিবকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠায় “do we work in this or I wait til the IPL” । ২৩ জানুয়ারি আগারওয়াল আবার সাকিবকে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ পাঠায় যাতে উল্লেখ থাকে “Bro anything in this series?” । সাকিব এসব মেসেজ পাওয়ার কথা আইসিসির দূর্নীতি বিরোধী ইউনিট বা অন্য কোন দূর্নীতি বিরোধী প্রতিষ্ঠানকে জানায়নি। ২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিল সাকিব সানরাইজার হায়দরাবাদের হয়ে কিংস ইলিভেন পাঞ্জাবের বিরুদ্ধে আইপিএল ম্যাচ খেলেন। সেদিন আগারওয়াল হোয়াটসঅ্যাপে সাকিবকে মেসেজ করে নির্দিষ্ট একজন খেলোয়াড় খেলবে কিনা জানতে চায়। এসব মেসেজ পাওয়ার কথাও সাকিব আইসিসির দূর্নীতি বিরোধী ইউনিট বা অন্য কোন দূর্নীতি বিরোধী প্রতিষ্ঠানকে জানায়নি।

আইসিসি তাদের সিদ্ধান্তে এটি স্পষ্ট করেছে যে, সাকিব আল হাসান আগারওয়ালের কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করেননি এবং তার কথা অনুযায়ী কোনো ধরনের কাজ করেননি কিংবা কোনো ধরনের তথ্য সরবরাহ করেননি।

তবে আইসিসির ICC Anti-Corruption Code অনুযায়ী এসব হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা সম্পর্কে আইসিসির দূর্নীতি বিরোধী ইউনিট (ACU ) কে জানানোর বাধ্যবাধকতা ছিল। তাই সাকিবের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে আইসিসি। তদন্ত কমিটি ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি ও ২৭ আগস্ট সাকিবকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তদন্তকাজে সাকিব তদন্ত কমিটিকে পূর্ণ সহযোগিতা করে। হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ পাওয়ার পরেও তা আইসিসির দূর্নীতি বিরোধী ইউনিটকে না জানানোর বিষয়টিতে ভুল হয়ে হয়েছে মর্মে সাকিব তদন্ত কমিটির কাছে স্বীকার করে।

আইসিসি সাকিবের বিরুদ্ধে ICC Anti-Corruption Code এর অনুচ্ছেদ ২.৪.৪ অনুযায়ী ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর ৩টি ঘটনায় চার্জ আনে। আইসিসির সিদ্ধান্তের ১৮ দফায় উল্লেখ রয়েছে-

On the basis of the admissions made by Mr Al Hasan to the ACU and set out in paragraph 11 above, on 29 October 2019, the ICC charged Mr Al Hasan with three separate breaches of Code Article 2.4.4, on the basis of his failure to disclose to the ACU, without unnecessary delay, the three approaches made to him by Mr Aggarwal to provide him with Inside Information for betting purposes (namely on 19 January 2018, on 23 January 2018 and on 26 April 2018).

২৯ অক্টোবরের লেটার এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে সাকিব আল হাসান আইসিসির দূর্নীতি বিরোধী কোড এর অনুচ্ছেদ ২.৪.৪ তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ঘটনায় লঙ্ঘনের অভিযোগ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নেয়। এ বিষয়ে ১৯ দফায় উল্লেখ রয়েছে-

By way of a letter agreement dated 29 October 2019, Mr Al Hasan formally admitted that he had breached Code Article 2.4.4 on three separate occasions by failing to report the approaches and/or invitations made to him by Mr Aggarwal, and waived his right to a hearing before the Anti-Corruption Tribunal.

সাকিব নিজে ভুল স্বীকার করায় দূর্নীতি বিরোধী কোডের অনুচ্ছেদ ৫.১.১২ এর বিধান বিবেচনায় নিয়ে একই কোডের অনুচ্ছেদ ৬.২ অনুযায়ী সাকিবকে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়।

এই হলো ঘটনাক্রমের সংক্ষেপিত রূপ। আইসিসির এই সিদ্ধান্তের কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা প্রয়োজন।

প্রথমত, আইসিসি যে ICC Anti-Corruption Code এর অনুচ্ছেদ ২.৪.৪ লঙ্ঘনের জন্য সাকিবকে সাজা দিয়েছে তা কার্যকর হয়েছে ২০১৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে। ICC Anti-Corruption Code এর ১১.৩ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে:

The Anti-Corruption Code shall come into full force and effect on 9 February 2018 (the “Effective Date”). It shall not operate to disturb any decisions and/or sanctions previously made under predecessor versions of the Anti-Corruption Code (including the Code of Conduct) or anti-corruption rules of National Cricket Federations. Nor shall its substantive provisions apply retrospectively to matters pending before the Effective Date. Instead, any case pending prior to the Effective Date, or brought after the Effective Date but based on acts or omissions that occurred before the Effective Date, shall be governed (a) as to substance, by the predecessor to the Anti-Corruption Code that was in force at the time of the alleged offence, subject to any application of the principle of lex mitior by the hearing panel determining the case; and (b) as to procedure, by this Anti-Corruption Code.

অর্থাৎ এই কোডের কোনো substantive provisions কার্যকরের তারিখের পূর্বের ঘটনার ক্ষেত্রে retrospectively প্রয়োগ করা যাবে না। পদ্ধতিগত বিষয়ে (তদন্ত, জিজ্ঞাসাবাদ ইত্যাদি) বর্তমান কোড ব্যবহার করা যায় বটে, কিন্তু পূর্বের ঘটনার জন্য বর্তমান কোডের অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সাজা প্রদান যৌক্তিক বিবেচিত হয় না।

সাকিবের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের ঘটনার তারিখগুলো হলো, ১৯ জানুয়ারি ২০১৮, ২৩ জানুয়ারি ২০১৮ এবং ২৬ এপ্রিল ২০১৮। দুটি ঘটনা ICC Anti-Corruption Code এর কার্যকরের অর্থাৎ ২০১৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারির আগের। ফলে উক্ত দুটি ঘটনার ক্ষেত্রে ২০১৮ সালের কোড অনুযায়ী অভিযোগ গঠনপূর্বক একই কোড অনুযায়ী শাস্তি প্রদান আইনের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কারণ, ১৯ জানুয়ারি ও ২৩ জানুয়ারির ঘটনার সময় ২০১৮ সালের ICC Anti-Corruption Code এর অনুচ্ছেদ ২.৪.৪ এবং ৬.২ এর অস্তিত্ব ছিল না। ফলে উক্ত দুটি ঘটনার ক্ষেত্রে সাকিব ২০১৮ সালের ICC Anti-Corruption Code এর অনুচ্ছেদ ২.৪.৪ লঙ্ঘণ করেছেন মর্মে আইসিসির সিদ্ধান্ত এবং ৬.২ অনুযায়ী সাজা প্রদান বেআইনী। উল্লেখ্য আইসিসির ২০১৪ সালের একটি ICC Anti-Corruption Code ছিল। তবে উক্ত কোড অনুযায়ী সাকিবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তবে ২৬ এপ্রিলের ঘটনার ক্ষেত্রে অভিযোগ গঠন ঠিক আছে।

দ্বিতীয়ত, আইসিসির সিদ্ধান্তের ১৭ দফায় উল্লেখ করা হয়েছে

In accordance with Code Article 1.7.3.3, the ICC and the BCCI (being the National Cricket Federation under whose jurisdiction the IPL is played) agreed that the ICC would take action in respect of all of Mr Al Hasan’s admissions.

অর্থাৎ আইসিসি এবং ভারতের ক্রিকেট বোর্ড এ ব্যাপারে একমত হয়েছে যে সাকিবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এ ব্যাপারে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সাথে আলোচনা করে কিছু করতে পারত কিনা।

ICC Anti-Corruption Code এর অনুচ্ছেদ ১.৭.৩.৩ এ উল্লেখ রয়েছে:

if the alleged Corrupt Conduct relates to one or more International Matches and one or more Domestic Matches, the ICC and the relevant National Cricket Federation(s) shall agree between them which of them shall take action (and, where applicable, in which order) against any relevant Participant for such Corrupt Conduct and, in the absence of agreement, the ICC shall take action solely with respect to Corrupt Conduct relating to the relevant International Matches and the National Cricket Federation(s) shall take action solely with respect to Corrupt Conduct relating to the relevant Domestic Matches;

সাকিবের বিরুদ্ধে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সাথে আইসিসির এগ্রিমেন্ট না হলে আইপিএল এর ঘটনার জন্য আইসিসি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারত না। অন্যদিকে যেহেতু বর্তমান ICC Anti-Corruption Code অনুযাযী কেবল ২৬ এপ্রিল অর্থাৎ আইপিএল সংক্রান্ত ঘটনার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, তাই এক্ষেত্রে ICC Anti-Corruption Code এর অনুচ্ছেদ ১.৭.৩.৪ প্রযোজ্য হয়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল। আইসিসির উচিত ছিল অনুচ্ছেদ ১.৭.৩.৪ অনুসরণ করা।

তৃতীয়ত, আইসিসি সিদ্ধান্তে উল্লেখ করেছে-
* Mr Al Hasan’s voluntary admission and cooperation during his interviews with the ACU;
* Mr Al Hasan’s prompt admission of his breaches following receipt of the Notice of Charge;
* Mr Al Hasan’s remorse and contrition as expressed to the ACU;
* Mr Al Hasan’s previous good disciplinary record;
* The fact that the offences did not substantially damage the commercial value and/or public interest in the relevant matches; and
* The fact that the offences did not affect the outcome of the relevant matches.

এতোগুলো মিটিগেটিং ফ্যাক্টর উল্লেখ করার পরও আইসিসি ২ বছরের নিষেধাজ্ঞা হতাশাজনক। যেহেতু বর্তমান কোড অনুযায়ী কেবল ২৬ এপ্রিলের ঘটনা প্রযোজ্য তাই এই কোডের ৬.২ অনুযায়ী ৬ মাসের নিষেধাজ্ঞার সাজাই যৌক্তিক হতে পারত।

চতুর্থত, আইসিসির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সাকিব আপিল করতে পারবেন না। সিদ্ধান্তের ৩২ দফায় উল্লেখ রয়েছে:

In accordance with Code Article 7.2 neither Mr Al Hasan nor the ICC shall have any right of appeal against this decision.

সেক্ষেত্রে সাকিব আল হাসানকে কমপক্ষে ১ বছর ক্রিকেট থেকে বাইরেই থাকতে হচ্ছে। দেশের ক্রিকেটের জন্য এটি মারাত্বক দুঃসংবাদ।

লেখক: সংযুক্ত কর্মকর্তা (সহকারী জজ), আইন ও বিচার বিভাগ, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম -এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।