আফজাল হোসেন:
আমার কাছে পেশাজীবী সংগঠনের মধ্যে সর্বোত্তম সংগঠন হলো সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি। দলাদলি আছে। তবে একজন আরেকজনের প্রতি বন্ধুত্ব আছে। যে দলেরই হোক সিনিয়রদের প্রতি জুনিয়রদের সম্মান আছে। জুনিয়রদের প্রতি সিনিয়রদের স্নেহ আছে। একটা গল্পবলি। বেগম জিয়ার জামিন খারিজের দিন বিএনপি-আওয়মী লীগের দু’পক্ষই পাল্টাপাল্টি মিছিল করলো। দু’পক্ষের মুখোমুখি অবস্থান। আপাতদৃষ্টিতে মনে হলো কোন অপ্রীতিকর ঘটনার দিকে যাচ্ছে পরিস্থিতি। দু’পক্ষের আইনজীবীরা পাল্টাপাল্টি ব্রিফিং করলো, জুনিয়র আইনজীবীদের বোঝালো, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলো।
একবার হলো কি কোন একটা ইস্যুতে দুপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হলো। অনেকটা বন্ধুত্বসুলভ। কর্মসূচি শেষে দেখি দুপক্ষের জুনিয়র আইনজীবীরা বার ভবনের তিনতলায় একসঙ্গে বসে কফি খাচ্ছে আর গল্প করছে। আইনজীবীদের এই মনোভাবটা আমার কাছে খুবই ভালো লাগে। যেকোন পরিস্থিতিতে এমন হৃদ্যতা বজায় থাকুক এমনটা কামনা করি।
বিভিন্ন ইস্যুতে বারের কমিটি যখন ব্রিফিং করে তখনো তাদের পারস্পারিক সম্পর্ক ও সম্মানের জায়গাটা বজায় থাকে। অনেক সময় দেখি একই জায়গায় একপক্ষের ব্রিফিং শেষ হলে আরেকপক্ষ এসে ব্রিফ করে। ভিন্ন মতপার্থক্য থাকলেও মতামত প্রকাশে শ্রদ্ধাবোধ থাকে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে দুই দলের সিনিয়র আইনজীবীরা।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কমিটির মেয়াদ শেষে তারা বার্ষিক ভোজের আয়োজন করে যেটাকে তারা বলে ব্রেকআপ পার্টি। যে পার্টিতে আইনজীবীরা দলমত নির্বিশেষে অংশ নেয়। উপস্থিত থাকেন বিচারপতিরাও। যদিও এবার বার্ষিক ভোজ হয়েছে তিনটা। একটি বারের পক্ষ থেকে আরেকটি সভাপতি ও সম্পাদকের পক্ষ থেকে। সভাপতি আওয়ামীলীগের হলেও তার দেয়া এ ভোজের বিরোধীপক্ষের আইনজীবীরাও অংশ নেয়। কখনো কাউকে বলতে শুনিনি উনি অমুক দল করে তমুকদল করে তার দাওয়াতে যাবনা। সম্পাদকের ভোজের চিত্রও এমন। ভোজ শেষে দুপক্ষের আইনজীবীরা একই মাঠে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় অংশ নেয়। নেচে গেয়ে আনন্দ উদযাপন করে। এমন চিত্র দেশের অন্য পেশাজীবী সংগঠনে খুঁজে পাওয়া বিরল।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির যে বিষয়টি সবেচেয়ে বেশি ভালো লাগে তা হলো কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচন। দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা যখন প্রশ্নের মুখে তখন বারের নির্বাচন নিয়ে কখনো প্রশ্ন উঠেনি। জাল ভোট নেই। কেন্দ্র দখল বা ব্যালট বাক্স ছিনতাই নেই। এক্ষেত্রে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কঠোর মনোভাব রয়েছে। বারের নির্বাচন মানে হচ্ছে একটা উৎসব। দুইদিন ব্যাপী নির্বাচন হয়। নির্বাচনে যারা প্রার্থী হন তাদেরকে ভোটাররা যেদিক দিয়ে ভোট দিতে যান সেখানে সারিবদ্ধভাবে চেয়ার দেয়া হয়। সেখানেই প্রার্থীরা বসে শেষ বারের মত ভোটারদের ভোট চান। সত্যিই অসাধারন দৃশ্য।
সর্বোচ্চ আদালতে পেশাগত দায়িত্বপালন করতে গিয়ে এসব বিষয় আমার মনে দাগ কেটেছে। তবে আইনজীবীরা আইনের শাসনে বিশ্বাস করেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। এই দুটি বিষয় থেকে তারা সরে এসেছেন বলে আমার মনে হয়। হয়ত জাতীয় রাজনীতির প্রভাবের কারণে এমনটা হয়েছে। তারপরও গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে, দেশের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তাদের জোরালো ভূমিকা প্রত্যাশা করে সাধারণ মানুষ। আমি মনে করি সুপ্রিম কোর্ট বার এ বিষয়ে দলীয় মনোভাবের বাইরে আসতে পারলে দেশের জন্য মঙ্গল, বিচার বিভাগের জন্য মঙ্গল। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কাছে এই প্রত্যাশাই করি।
লেখক: লিগ্যাল করেসপন্ডেন্ট, সময় টিভি।