এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামানিক:
একজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে আদালতে বিচার চাইতে গেলেই বিরুদ্ধপক্ষ তার চরিত্র নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলে থাকে। ধর্ষিতাকে মানসিকভাবে হেনস্তা করতেই মূলত: প্রতিপক্ষ এমনটা করে থাকে। আমাদের দেশের প্রচলিত আইনও ওই নারীকে ‘দুশ্চরিত্রা’ আখ্যায়িত করতে নানা আইনী প্রক্রিয়াকে সমর্থন করেছেন। আদালতে এভাবে মান-ইজ্জত নিয়ে ‘টানাহেঁচড়া’ দেখে ধর্ষিতা বিচার চাইতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায়। সওয়াল-জবাবের নামে আইনজীবীর ‘আপত্তিকর জেরা’ এড়াতে অনেক ভূক্তভোগী আদালত বিমুখ হয়ে পড়েন।
আমাদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) ধারায় ধর্ষনের ব্যাখায় বলা হয়েছে যে, কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ছাড়া ষোল বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে অথবা ষোল বছরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষন করেছেন বলে গন্য হবেন। এবং এজন্য তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন।
আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হানিফ সেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলা, যা ৫১ ডিএলআরের ১২৯ পৃষ্ঠায় এবং অন্য একটি মামলায়, যা ১৭ বিএলটিএর ২৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, ১৬ বছরের অধিক কোনো মেয়েকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে যৌনকর্ম করে তা হলে তা ধর্ষণের নামান্তর হবে না।
আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট সোহেল রানা বনাম রাষ্ট্র মামলায় যা ৫৭ ডিএলআরের ৫৯১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, যৌনকর্মের সময় যদি ভিকটিম কোনরূপ বাঁধা না দেয় অথবা বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা না করে অথবা কোনো চিৎকার না দেয় তাহলে ধর্ষণ হয়েছে বলে মনে করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে যৌনকর্মে ভিকটিমের সম্মতি আছে বলে ধরে নিতে হবে।
এবার আসল কথায় আসি। আমার এ লেখাটি মূলতঃ ধর্ষণের শিকার একজন নারী বিচার চাইতে গিয়ে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যেই আবারও যে জনসমক্ষে ধর্ষণের শিকার হন, সে বিষয়টি তুলে ধরা। আমাদের সাক্ষ্য আইনে ১৫৫ ধারার ৪ উপ-ধারার সুযোগে ধর্ষক সাধারণতঃ ধর্ষিতাকে ‘কুচরিত্রা’ প্রমাণের চেষ্টা করে থাকেন। এর কারণ হচ্ছে ঐরূপ প্রমাণ করতে পারলেই ধর্ষক ধর্ষণের অভিযোগ থেকে বেঁচে যেতে পারেন। এ ধারায় বলা আছে যে, কোনো ব্যক্তি যখন ধর্ষণ বা বলৎকার চেষ্টার অভিযোগে ফৌজদারীতে সোপর্দ হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে অভিযোগকারিণী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা। এ সুযোগে ধর্ষণের মামলায় জেরা করার সময় ধর্ষণের শিকার নারীকে অনেক সময় অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্খিত, অপ্রাসঙ্গিক, রুচিহীন ও আপত্তিকর প্রশ্নের মাধ্যমে চরিত্র হনন করা হয়। এ কারণে ধর্ষণের শিকার নারী ও তাঁর পরিবার মামলা করতে নিরুৎসাহিত হন ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন। এ দিকটির নেতিবাচক বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে ভারতের মহামান্য সুপ্রীমকোর্ট একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। State of Punjab v. Gurmit Singh; (1996) 2 SCC 384 মামলায় অভিযুক্তপক্ষ কর্তৃক ধর্ষিতাকে জেরা করার সময় আদালতের দায়িত্ব সম্পর্কে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন তা নিম্নরুপঃ-
“অভিযোগকারীর সত্যনিষ্ঠা এবং তার সাক্ষ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা জেরা করার মাধ্যমে যাচাই করার জন্য অভিযুক্তকে যেমন স্বাধীনতা দেয়া উচিত, তেমনিভাবে আদালতকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে ধর্ষিতাকে হয়রানি বা অবমানিত করার জন্য জেরা করা হচ্ছে কি-না। স্মরণ রাখতে হবে, ধর্ষণের শিকার নারী ইতোমধ্যে দুঃখজনক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন এবং তাকে যদি ঐ অপরিচিত ঘটনার শিকার হওয়া নিয়ে পুনরাবৃত্তি করতে হয় তাহলে সে লজ্জায় নির্বাক হয়ে থাকতে পারেন এবং তার নিরবতাকে ভুল করে সাক্ষ্যের ‘অমিল এবং স্ববিরোধ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকতে পারে।”
সাক্ষ্য আইনে ইন্ডিয়া যেরুপ সংশোধন এনেছে, সেরুপ আমাদের দেশের সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ এর উপধারা ৪ বাদ দেয়া যুক্তিযুক্ত। এই ধারাটি আদালতের কাজে এলেও বর্তমানে ধর্ষিতার ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনাকীর্ণ আদালতে ধর্ষিতাকে হেনস্তা করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে এই আইনকে। একজন ধর্ষিতা আদালতে বিচার চাইতে এসে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আবারও ধর্ষণের শিকার হন। কারণ এ ধারা প্রয়োগ করলে ধর্ষিতার অতীত যৌনজীবন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। যা অত্যন্ত ব্যক্তিগত এবং গোপনীয় একটি বিষয়। প্রতিপক্ষের আইনজীবী বার বার প্রমাণের চেষ্টা করেন আসলে ধর্ষিতা এ রকমের যৌনসম্পর্কে অভ্যস্ত। খোদ একটি আইনের ধারাই যেখানে ধর্ষিতাকে দুশ্চরিত্রা হিসেবে উপস্থাপনের লাগামহীন সনদ দিয়ে দিচ্ছে সেখানে ওই ধর্ষিতাকে অপমানিত হওয়া থেকে আদালত কোনভাবেই রক্ষা করতে পারবে না। এই ধারাটি ব্যাপকভাবে ধর্ষণের মামলাগুলোকে প্রভাবিত করে চলেছে। এমনকি অপরাধী তার অপরাধ স্বীকার করার পর এই ধারাটির কাঁধে ভর করে বেকসুর খালাস পাওয়ার উদাহরণও এই দেশে আছে।
বাংলাদেশের উচ্চ আদালতগুলোতে ‘চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ প্রমাণ হিসেবে কতটা ব্যবহৃত হয়েছে এবং এর ফলাফলগুলো কী ছিল তা একটি উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আবদুল মজিদ বনাম রাষ্ট্র মামলা, যা ১৩ বিএলসি ২০০৮ মামলায় একজন তালাকপ্রাপ্ত মা, যিনি তার শিশুসহ তার কুঁড়েঘরে ঘুমন্ত থাকা অবস্থায় ধর্ষিত হওয়ার অভিযোগ করেছিলেন। পালিয়ে যাওয়ার সময় অভিযুক্ত ধর্ষক গ্রামবাসীর কাছে ধরা পড়েন এবং অপরাধ স্বীকার করেন। আদালতে অভিযোগকারিণীর বৈবাহিক অবস্থা এবং যৌনসম্পর্কের ইতিহাসকে তার ‘চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ বিবেচনায় তাকে ‘যৌন কার্যকলাপে অভ্যস্ত’ বলে উল্লেখ করা হয় এবং বলা হয় ‘ধর্ষিতা একজন হালকা নৈতিক চরিত্রের অধিকারিণী এবং তিনি অসামাজিক ও অনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত রয়েছেন।’
রাষ্ট্র বনাম শাহীন এবং অন্যান্য যা ২৮ বিএলডি (হাইকোর্ট ডিভিশন) ২০০৮ মামলায় ধর্ষণের অভিযোগকারীর দুবার বিয়ে হয়েছিল। তাকে তার নানির কাছ থেকে ছিনিয়ে একটি হোটেলের কক্ষে সদলবলে ধর্ষণ করা হয়। এ ক্ষেত্রেও আদালতের রায়ে বলা হয় যে ‘এটি এমন একজন নারীর ধর্ষণের মামলা, যার আগে দুবার বিয়ে হয়েছিল এবং এই মামলাটি এমন একটি উদাহরণ, যেখানে উল্লিখিত কারণে বাদিনীর একার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না।’
শ্রী দিনটা পাল বনাম রাষ্ট্রের মামলায় যা ৩০ বিএলডি (এডি) ২০১০ দেখা যায় যে, আদালত অভিযোগকারিণীর গাছ বেয়ে ওঠাকেই তার ‘খারাপ চরিত্র বা দুশ্চরিত্র’ হিসেবে প্রমাণ করেন এবং তার সাক্ষ্যকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরে নেন। অভিযোগকারিণী ছিলেন একজন অল্পবয়সী গৃহপরিচারিকা, যিনি তার নিয়োগকর্তার হাতে ধর্ষিত হন। আদালত এ ক্ষেত্রে মন্তব্য করেন যে, যেহেতু অভিযোগকারিণী অভিযুক্তের বাড়ির সদর দরজা বন্ধ থাকার সময় একটি পেঁপেগাছ বেয়ে উঠে প্রবেশ করেছিলেন, এতে প্রমাণ হয় যে বাদিনী একজন হালকা সম্ভ্রমের নারী। তাই তার দেয়া প্রমাণ বিশ্বাসযোগ্য হবে না, যতক্ষণ না আরো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পেশ করা হবে।
ধর্ষণ মামলায় ধর্ষিতার অতীত যৌন ইতিবৃত্ত সম্পর্কে অভিযুক্তের পক্ষ থেকে দেয়া সাক্ষ্য কতটুকু গ্রহণ করা যাবে, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইন্ডিয়ান ল’ কমিশনের ৮৪ তম রিপোর্টে (১৯৮০) বলা হয়েছে, ধর্ষিতার অতীত যৌন ইতিবৃত্ত সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়ার বিষয়টি লিগ্যাল সিস্টেম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অসন্তোষ এবং আইনি-কার্যধারা হতে অনীহা অনুভব করার অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
অবশ্য আদালতের এমন রায়ও রয়েছে যেখানে একজন ধর্ষিতার সৎ চরিত্রের প্রমাণকেও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। ফাতেমা বেগম বনাম আমিনুর রহমান যা ২৫ বিএলডি (এডি) ২০০৫) মামলায় আদালত সিদ্ধান্ত দেয় যে, ‘বিজ্ঞ উকিল উপস্থাপন করেছেন যে মামলার বাদিনী একটি সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারের একজন অবিবাহিতা কলেজপড়ুয়া ছাত্রী। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নই ওঠে না যে বাদিনীর চরিত্র সন্দেহজনক হতে পারে।’
পৃথিবীতে এমন কোন সভ্যতা খুঁজে পাওয়া যাবেনা যেখানে আইনের বিকাশ হয়নি। সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে ‘আইন’ ধারনাটিরও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তিত সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে আইন তার কার্যকারীতা হারায়। প্রয়োজন হয় সে আইনকে সময় উপযোগী করে তোলা। গঠনমূলক সমালোচনার মধ্যেই আইন তার অস্তিত্বের সন্ধান পায়। কাজেই আমাদের সাক্ষ্য আইনের ১৮৭২ এর ধারা ১৫৫ এর উপধারা ৪ এর বিধান বাদ দেয়া যুক্তিযুক্ত নয় কি?
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email: seraj.pramanik@gmail.com