দেশের প্রতি চারজন বিবাহিত নারীর একজন স্বামীর হাতে মার খান। এই নারীদের বয়স ১৫ থেকে ৪৯ বছরের মধ্যে। স্বামীর অনুমতি না নিয়ে বাইরে যাওয়া; বাচ্চাদের প্রতি যত্নশীল না হওয়া; স্বামীর সঙ্গে তর্ক করা; যৌন সম্পর্ক করতে অস্বীকৃতি জানানো এবং খাবার পুড়িয়ে ফেলা—এই পাঁচটি কারণের অন্তত একটির জন্য ওই নারীরা মার খান।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯-এ নারীর গৃহ নির্যাতনের চিত্র উঠে এসেছে। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া নারীরা এই তথ্য দিয়েছেন। গতকাল সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) এই সমীক্ষার প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ৫-৬ বছর পরপর এ ধরনের সমীক্ষা করে থাকে বিবিএস। সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশ উপলক্ষে আগারগাঁওয়ের বিবিএস মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে সমীক্ষার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন বিবিএসের পরিচালক মাসুদ আলম।
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর সহিংস আচরণ সম্পর্কে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘বিবিএসের সমীক্ষা অনুযায়ী, যেসব কারণে স্ত্রীকে মারধর করেন স্বামীরা, সেই কারণগুলো গুরুতর অপরাধ নয়। লঘু ভুল করার জন্য এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হন বিবাহিত নারীরা। পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদী সমাজের মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে পারছি না।’ তাঁর মতে, নারীরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী না হওয়ার কারণেই স্বামীরা এই সুযোগ পান। এভাবে নির্যাতন করা একটি সভ্য সমাজে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী বিবাহিত নারীদের ২৫ দশমিক ৪ শতাংশ ওপরের পাঁচটি কারণের একটির জন্য স্বামীর হাতে মার খান। শিশু নির্যাতনের কথাও উঠে এসেছে ওই সমীক্ষায়। ১ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের প্রায় ৮৯ শতাংশ সমীক্ষা চলাকালীন আগের এক মাসে অন্তত একবার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ছয় বছর আগে ৮২ দশমিক ৩ শতাংশ শিশু এই ধরনের নির্যাতনের শিকার হতো। বিবিএস বলছে, আশঙ্কাজনকভাবে শিশুদের প্রতি সহিংস শাসন বেড়েছে।
বিবিএসের পরিচালক মাসুদ আলম জানান, শিশুদের পিতামাতা ও লালনপালনকারীদের হাতেই তাঁরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে শিকার হন। শিশুদের শৃঙ্খলাজনিত কারণে মারধর, বকাঝকা, ধমক—এসব বিষয় আমলে আনা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘শিশুর ওপর নির্যাতন দিন দিন বাড়ছে। এটি ভয়ানক আকার ধারণ করছে। এটি কোনোভাবেই সভ্য সমাজ বলতে পারি না। এই চিত্র মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার অর্জনকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়।’
সারা দেশের ৬১ হাজার ২৪২টি পরিবারের কাছে ৩৩ ধরনের তথ্য নিয়ে এই জরিপ করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারি থেকে ১ জুনের মধ্যে এই সমীক্ষা হয়। সমীক্ষায় শিশুমৃত্যু, জন্মহার, শিক্ষার হার, বাল্যবিবাহ, রেডিও-টেলিভিশন-মোবাইল ফোন ব্যবহার, বিবাহ, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে।
৯৬% পরিবারে মোবাইল ফোন
সমীক্ষায় অংশ নেওয়া পরিবারগুলোর মধ্যে ৯৫ দশমিক ৯ শতাংশ পরিবারে অন্তত একটি মোবাইল ফোন বা ল্যান্ড ফোন আছে। ২০১২-১৩ সালের সমীক্ষায় এই হার ছিল ৮৭ দশমিক ২ শতাংশ। ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ৭১ শতাংশের বেশি নারীর নিজস্ব মোবাইল ফোন আছে। তবে প্রায় ৯৮ শতাংশ নারী গত তিন মাসে একবার অন্তত মোবাইল ফোনে কথা বলেছেন। ৩৭ শতাংশ পরিবারে ইন্টারনেট ব্যবহার করার জন্য ডিভাইস আছে। কম্পিউটার আছে সাড়ে ৫ শতাংশের বেশি পরিবারে।
তবে নারীদের সংবাদপত্র ও সাময়িকী পড়া, রেডিও শোনা ও টেলিভিশন দেখার প্রবণতা কমেছে। ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী আধা শতাংশ নারী সপ্তাহে অন্তত একবার সংবাদপত্র, সাময়িকী পড়েছেন কিংবা রেডিও শুনেছেন বা টেলিভিশন দেখেছেন। ২০১২-১৩ সালে এই হার ছিল ১ দশমিক ৬ শতাংশ। সাত বছর আগে ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ পরিবারে টেলিভিশন ছিল। এখন ৫০ শতাংশের বেশি পরিবারে টেলিভিশন আছে। তবে রেডিওর দিন শেষ হচ্ছে। সাত বছর আগে প্রায় ৪ শতাংশ পরিবারে রেডিও ছিল। এখন দশমিক ৬ শতাংশ পরিবারে রেডিও আছে।
বাল্যবিবাহ পরিস্থিতি
১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী নারীদের এক-তৃতীয়াংশই এখন বিবাহিত। সাত বছর আগে এই হার ছিল ছিল ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ। বর্তমানে যেসব নারীর বয়স ২০ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে, তাঁদের সাড়ে ১৫ শতাংশের বিয়ে হয়েছে বয়স ১৫ বছর হওয়ার আগে। এ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ২০১২-১৩ সালে ১৮ শতাংশের বেশি ওই বয়সী নারীদের বিয়ে হয়েছিল।
বর্তমানে ২০-২৪ বয়সীদের মধ্যে ১৮ বছর হওয়ার আগে বিয়ে হয়েছে ওই শ্রেণির ৫১ শতাংশের বেশি নারীর। সাত বছর আগে ছিল এই হার ছিল ৫২ শতাংশের বেশি।
তবে ১৮ বছর হওয়ার আগে সন্তান জন্মদান পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি। ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী প্রতি চারজন নারীর একজনই ১৮ বছর হওয়ার আগেই সন্তান জন্ম দিয়েছেন।
শিশুমৃত্যু পরিস্থিতির উন্নতি
সমীক্ষা অনুযায়ী, জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে নবজাতক মৃত্যুর হার বাংলাদেশে এখন প্রতি হাজারে ২৬ জন। আর পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৪০ শিশু। সাত বছর আগে ছিল প্রতি হাজারে ৫৮ জন। তবে বয়ঃসন্ধিকালে মা হওয়ার পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে। ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে প্রতি হাজারে ৮৩ জন মা হন।
পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি ১০০ শিশুর মধ্যে ২৮ জনের উচ্চতা বয়স অনুযায়ী কম। ২০১২-১৩ সালে এই হার ছিল ৪২ শতাংশ।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিস্থিতি
একটি সাধারণ বাক্য পড়তে পারেন কিংবা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা করেছেন—এমন বৈশিষ্ট্য ধরে বিবিএসের সমীক্ষায় শিক্ষার হার ঠিক করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের ৮৮ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষিত। ৯২ শতাংশের পরিবারে বিদ্যুৎ-সংযোগ আছে। আর ৮৪ শতাংশের বেশি পরিবারে উন্নত স্যানিটেশন সুবিধা আছে।
বিবিএসের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব সৌরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী বলেন, ‘মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে শিশুদের উন্নতির জন্য যেসব তথ্য-উপাত্ত দরকার, সেই ধরনের তথ্য-উপাত্ত দিচ্ছে বিবিএস, যা নীতি প্রণয়নে সহায়তা করবে।’
ইউনিসেফ বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অ্যালেন ব্যালান্ডি ডোমস্যাম বলেন, জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সুবিধা কাজে লাগাতে শিশু ও তরুণদের জন্য বিনিয়োগ বিলম্ব করার সুযোগ নেই। এই সুযোগ শেষ হতে আর মাত্র ১১ বছর বাকি আছে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। সূত্র- প্রথম আলো