সুসময় ঘোষ:
আইন মন্ত্রী বললেন- ‘এই ব্যক্তি (জেলা জজ আব্দুল মান্নান) বারের সাথে যেভাবে ব্যবহার করেছেন সেটা যদি না করতেন তাহলে আজকের এই পরিস্থিতি হতনা’। উক্ত জেলা ও দায়রা জজ আব্দুল মান্নান কি এমন ব্যবহার করলেন- তা কি কেউ খতিয়ে দেখেছেন। একপেশে দোষারোপ কেন? আইন মন্ত্রীর ব্রিফিং দেখলেই বুঝা যায় যে তিনি- প্রকাশ্যে ইনিয়ে বিনিয়ে বার (আইনজীবী সমিতি) কে সমর্থন করছেন, আর উক্ত জেলা জজ কে দায়ী করছেন সব কিছুর জন্য। কিন্তু তিনি আবার একই সাথে বলেন – যে তিনি নিরপেক্ষ থাকতে চান। বারের রেজ্যুলেশনকে তিনি অকাট্য দলিল হিসেবে উপস্থাপন করলেন।
তিনি যেখানে ইতমধ্যে উক্ত জেলা জজ কে ‘ব্যবহার’ খারাপ এবং পরিস্থিতি ঘটানোর জন্য দায়ী করছেন সেখানে কীভাবে তিনি নিরপক্ষে থাকেন! তিনি তো ইতোমধ্যে রায় দিয়ে দিলেন। উনি পুরো দেশকে কি বার্তা দিলেন! পুরো বিচার বিভাগ কে কি বার্তা দিলেন! বারের উপর সম্মান প্রদর্শন রেখে বলতে চাই – বারের আইনজীবীরা করেন আইন ব্যবসা আর বিচারক করেন বিচার। ব্যবসায় মক্কেলের স্বার্থের জন্য অনেক কিছু করতে হয় অনেক কিছু বলতে হয়। এটি আইনজীবী মাত্রই স্বীকার করবেন। কিন্তু বিচারক এর জন্য কেউ মক্কেল নন। বিচারক আইনের মক্কেল। তাকে আইন মেনে কাজ করতে হয়। দুর্নীতির মামলায় এর আগে আমরা অহরহ জেলে যেতে দেখেছি। জামিন নামঞ্জুর করে জেল হাজতে প্রেরণ করতে দেখেছি। কিছু দিন আগে নোয়াখালীর কোর্টের নাজিরকে এবং তার স্ত্রীকে ও জেলে প্রেরণ করতে দেখেছি জামিন নামঞ্জুর করে। তিনি মহিলা বলে কিন্তু রক্ষা পাননি। আইন সবার জন্য সমান ভাবে প্রয়োগ হবে। এটাই আইনের শাসন।
এমন পরিস্থিতি আইনজীবীরা তৈরি করেছেন কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন- তিনি তথ্যাদি সংগ্রহ করছেন। তো সঠিক তথ্যাদি সংগ্রহ না করে তিনি কীভাবে বলেন যে উক্ত বিচারক অশালীন ব্যবহার করলেন! আঊয়াল আগেরবার এম. পি ছিলেন। তার পরিবার স্থানীয় রাজনীতিতে অনেক প্রভাবশালী। তিনি পুরো বার কেই কিনতে পারেন। বারের সবাই তার জামিনের জন্য দাঁড়াতে পারে। তার অর্থ কী এই- তাকে জামিন দিতে হবে! খালেদা জিয়ার জন্য তার লোকজন সব তারিখেই জড় হন মিছিল করেন, জ্বালাও-পোড়াও করেন। তার কী জামিন হয়? পরিস্থিতি তৈরি করলেই জামিন দিতে হবে! তাহলে এখন থেকে জাতি এটি শিখল যে – কারো জামিন লাগলে কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে বারের প্রভাবশালী আইনজীবীদের নিয়ে আদালতে যেতে হবে, জোর গলায় জামিন চাইতে হবে, আদালতের বাহিরে ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে দাঁড়াতে হবে, একটু জ্বালাও পোড়াও করতে হবে। রাস্তা ঘাট, যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিতে হবে। এবং এসবের জন্য ঐ জজ কে দায়ী করতে হবে। ব্যস জামিন হয়ে যাবে।
বেচারা জজ এর ত্রিশঙ্কু অবস্থা। আউয়ালকে জামিন দিলে পড়তেন জনগনের রোষে, আইন ব্যতয়ের রোষে, জামিন না দিয়ে হলেন ও. এস. ডি। তাকে এখন বিএনপি-জামাত বানানো হচ্ছে । বিচার বিভাগে উনার ভবিষ্যৎ যে খুব ভাল আর হচ্ছেনা তা অনুমান করাই যায়।
বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের একটি অঙ্গ। সবাই মাইকের সামনে আসে, কথা বলে। শুধু আসতে পারেনা এই বিচারকেরা যতদিন না তিনি চাকুরী ছেড়ে দেন বা হারান বা অবসরে যান। তাদের পক্ষে বলার কেউ নাই। আইন বিজ্ঞানে একটি কথা আছে। কাউকে না শুনে দোষারোপ করতে নেই। আমরা কি জেলা জজ আব্দুল মান্নান কে শুনেছি? কী ঘটেছিল সেদিন – সঠিক তথ্য বের করেছি? তারপরও যে আমাদের সাহসী সহকর্মীরা আইনমন্ত্রীকে কয়েকটি তির্যক প্রশ্ন করতে পেরেছেন এবং উত্তর বের করেছেন তার জন্য তাদের স্যালুট জানাই।
আউয়ালের জামিন যদি এতই ‘বার্নিং ইস্যু’ হত তাহলে আইন মন্ত্রণালয় তাকে ঐদিন জামিনের আগে সরালেও পারতেন। কেন ৪ ঘণ্টার ব্যবধানে এমন একটি নজির দাঁড় করালেন যার ক্ষতি এই জাতি পূরণ করতে অনেক অনেক সময় লেগে যাবে। আইনমন্ত্রী বার এবং বেঞ্চের সম্প্রীতির কথা বলেন। এবং এর ব্যতয় ঘটলে বিচারকদের অভিভাবকদের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেন। আইনমন্ত্রী কি বার নাকি বেঞ্চ এর অভিভাবক! তাহলে উনি একটি আচরণ বিধিমালা প্রণয়ন করতে পারেন বার এর জন্য, যে তারা কীভাবে বেঞ্চের সাথে সম্প্রীতি বজায় রাখবে। এ নিয়ে একটি কোড থাকলে ভাল হয়। তাহলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা সহজ হবে এবং জাতিও বুঝবে। আউয়াল অভিযোগ করে বলেন- প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিমের কথায় তার জামিন বাতিল হয়। এখানে এই দুই মন্ত্রীর ব্যক্তিগত রেষারেষির কারনে এই জেলা জজ বলি হলেন কিনা তাও খতিয়ে দেখা উচিত।
সাবেক বিচারপতি এস কে সিনহা তালেবানি স্টাইলে বিচার বিভাগ চালাতে গিয়ে এই বিভাগের যে ক্ষতি করেছেন সেই ক্ষতির ক্ষততে আউয়ালের ঘটনা একটি ইনকিউরেবল ইফেকসন হয়ে থাকবে।
লেখক: গবেষক; সিডনি, অস্ট্রেলিয়া