অ্যাডভোকেট শাহ্ মঞ্জুরুল হক। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। পেশা জীবনের প্রথম দিকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুনামের সাথে আইন বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। এছাড়া যথোচিত কর্পোরেট ল’ইয়ার হিসেবেও সুপরিচিত। একান্ত সাক্ষাৎকারে সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে আইনজীবীদের ভূমিকা, কর্পোরেট সেক্টরে প্র্যাকটিসে আগ্রহী এবং শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে নানা পরামর্শ দিয়েছেন। ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমের সম্পাদক অ্যাডভোকেট বদরুল হাসান কচির নেওয়া তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ তৃতীয় এবং শেষ পর্ব পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল-
ল’ইয়ার্স ক্লাব: কর্পোরেট ল’ইয়ার হিসেবেও আপনার সুনাম রয়েছে, এক্ষেত্রে প্র্যাকটিসের সুযোগ-সুবিধা কেমন এবং এ বিষয়ে প্র্যাকটিসে আগ্রহীদের জন্য আপনার পরামর্শ কি?
শাহ্ মঞ্জুরুল হক: এখন সুযোগ সুবিধা আগের চেয়ে অনেক বেশি। কেননা এখন কোম্পানি বাড়ছে, বিনিয়োগ বাড়ছে। তবে শুধু কোম্পানি না কর্পোরেট সেক্টরটাই ডেভেলপ হয়েছে। কোম্পানি ল’, কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স, ইনকাম ট্যাক্স, ইনভেস্টমেন্ট ইত্যাদি নিয়েই কর্পোরেট সেক্টর। এজন্য শুধু কোম্পানি নয় বরং পুরো কর্পোরেট সেক্টর টার্গেট করেই দক্ষ আইনজীবী তৈরি করা জরুরী। এসব জায়গায় কাজের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে দক্ষ আইনজীবী পাওয়া না গেলে বিদেশিরা ঠিকঠাক আইনি সেবা পাবে না ফলে বিনিয়োগও করবে না। আরেকটা বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি কামনা করছি দেশে পারিবারিক আদালতের একটা মামলাও বছরের পর বছর ঝুলে থাকে, এসব যদি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মামলার ক্ষেত্রেও হয় তবে তারা ইনভেস্টমেন্টে আগ্রহ হারাবে। আমাদের দেশে দীর্ঘ রায় দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে বিদেশে কিন্তু এমন না। তারা হাজার কোটি টাকার মামলা ছয় মাস- একবছরে নিষ্পত্তি করে দেয়। যদি ইংল্যান্ডের কথাই বলি তারা কম সময়ে এবং সংক্ষিপ্ত আকারে রায় দেন। আইনের মূল বিষয়টি উল্লেখ করে দেন রায়ে।
আরও পড়তে ক্লিক করুন: ‘স্বতন্ত্র আইন বিশ্ববিদ্যালয় আইন শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে সহায়ক হবে’
ল’ইয়ার্স ক্লাব: শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন…
শাহ্ মঞ্জুরুল হক: নিজের অভিজ্ঞতাটাই বলি, হাইকোর্টে তালিকাভুক্ত হবার পর প্রথম পাঁচ বছর মুখ খোলার সাহসই পাইনি। উচ্চ আদালতে আইন পেশায় নিয়োজিত হওয়ার পর আপীল বিভাগের সাবেক একজন বিচারপতি আমাকে বলেছিলেন, আমরা তো প্রথম পাঁচ বছর ড্রেনের পানি খেয়ে থাকার প্রস্তুতি নিয়ে আইন পেশায় এসেছি, আর তোমরা তো নতুন নতুন এসেই অনেক বড় স্বপ্ন দেখো। আমিতো বলব শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের ড্রেনের পানি খাওয়ার স্বপ্ন দেখার প্রয়োজন নেই। তারা আরও ভালো স্বপ্ন দেখতে পারেন। কারণ এখন অবস্থা আগের চেয়ে বদলেছে। আগেই বলেছি এখন আইনের টেকনিক্যাল বিষয়ে কাজ করার ব্যাপক জায়গা তৈরি হয়েছে। সেসব বিষয়ে যদি তারা নিজেদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে তবে এ পেশায় ভবিষ্যৎ নিরাপদ।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে আইনজীবীদের ভূমিকা কি হওয়া উচিৎ?
শাহ্ মঞ্জুরুল হক: আমেরিকার বিখ্যাত এক আইন বিজ্ঞানী রস্কো পাউন্ড বলেছেন, আইনজীবীরা সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ার। আমি মনে করি কথাটি শতভাগ বাস্তবসম্মত। আসলে আইন পেশাটা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার পেশা। মানুষে মানুষে বিবাদের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে অধিকার। আর সেই অধিকার প্রতিষ্ঠার মূল লড়াইটা আইনজীবীরাই করেন। বিচারকেরা রায় দেন কিন্তু সে রায় আইনজীবী কর্তৃক উপস্থাপিত যুক্তিতর্ক, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও আইনের ব্যাখ্যার আলোকে। সুতরাং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় মূল সৈনিক আইনজীবী। অনেকেই আইন পেশাকে টাকা উপার্জনের পেশা হিসেবে দেখেন। টাকা তো আসবে কিন্তু উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা। সভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকেই আইনজীবীদের কাজই হচ্ছে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। বিচারকরা এখানে সহায়ক শক্তি, মূল ভূমিকা আইনজীবীরাই পালন করে থাকেন। এজন্য আইনজীবীরা যদি মনে করেন আমরা সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় লিপ্ত থাকব তাহলে ন্যায় ও সুশাসন ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। খুব পরিচিত একটা গল্প আছে সকলেই সম্ভবত জানেন তবু বলছি, ‘এক আইনজীবীর ছেলে বিলেত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে এসেছেন। আসার পর বাবা ছেলে একটি মামলার ফাইল দিয়েছেন মামলাটি লড়তে। তো ব্যারিস্টার ছেলে কোর্টে গিয়ে ভালো যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে মামলা জিতে গেলেন। বাসায় এসে খুশি মনে বাবাকে বললেন, আমি তো মামলা জিতে গেছি। শুনে বাবা খুশি হলেন না। তো প্রথম মামলা জিতেছে ছেলে, বাবা খুশি কেন নন সে বিষয়ে জানতে চাইলে বাবা বলেন, খুশি যে হব এই মামলা দিয়েই তো তোমাকে আমি ব্যারিস্টার বানিয়েছি আর তুমি এসেই মামলাটা শেষ করে দিয়েছে! সুতরাং এই রম্য গল্পের মতো বিচার প্রলম্বিত করার চিন্তা বাদ দিয়ে যদি ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার ভাবনটা যদি আইনজীবীরা মাথায় নেন তবে তাতেই সমজের বৃহত্তর স্বার্থ হাসিল হবে বলে বিশ্বাস করি।
আরও পড়তে ক্লিক করুন: ‘আইনজীবীদের পেশাগত ও বারের অবকাঠামোর গুণগত পরিবর্তনের স্বার্থেই নির্বাচনে আগ্রহী হয়েছি’
ল’ইয়ার্স ক্লাব: আপনার মূল্যবান সময় থেকে কিছু সময় ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
শাহ্ মঞ্জুরুল হক: আপনাকেও ধন্যবাদ, পাশাপাশি ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমের অগণিত পাঠকদের জন্য শুভ কামনা।