ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ অনুযায়ী সিনেমা, নাটক বা প্রামাণ্য চিত্রে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের দৃশ্য টেলিভিশন, রেডিও, ইন্টারনেট, মঞ্চ অনুষ্ঠান বা অন্য কোন গণমাধ্যমে প্রচার, প্রদর্শন বা বর্ণনা করা যাবে না মর্মে বিধানটি লঙ্ঘন করায় সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত একটি সিনেমার কিছু দৃশ্য হাইকোর্টের নজরে আনা হয়েছে। আদালত বিষয়টি নিয়ে নিয়মিত আবেদন করতে বলেছেন।
আজ রোববার (৮ মার্চ) সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জমান লিংকন বিষয়টি হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চের নজরে আনলে আদালত এ আদেশ দেন।
বিষয়টি ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে নিশ্চিত করে অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জমান লিংকন বলেন, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের অবাধ ব্যবহার ও আইন লঙ্ঘনের মহোৎসব বন্ধে আদালতের নির্দেশনা চেয়েছিলাম। আদালত স্বপ্রণোদিত আদেশ না দিয়ে নিয়মিত রিট ফাইল করতে বলেছেন।
চলতি সপ্তাহেই প্রতিকার চেয়ে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট করা হবে বলেও জানান আইনজীবী মনিরুজ্জমান।
ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা। রীতিমত এ জাতীয় পণ্যের প্যাকেটের গায়েই ক্ষতির বিষয়গুলো উল্লেখ রয়েছে। যদিও চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনীর মতো ধূমপায়ীরা এসব ক্ষতি সম্পর্কিত বার্তা থোড়াই কেয়ার করেন। এজন্য ধূমপান ও তামাক জাতীয় পণ্যের উৎপাদন উত্তরোত্তর বেড়েই চলছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এসব পণ্যের প্রচার-প্রচারণাও। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে প্রায় প্রতি বছর বাজেটে সরকার কর বৃদ্ধি করে থাকে। কিন্তু অতিরিক্ত করারোপ ও ক্রমশ দাম বৃদ্ধি পেলেও ব্যবহার সেই অর্থে কমানো যায়নি। পাশাপাশি ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে করা আইনও অনেক ক্ষেত্রে অকার্যকর বলা চলে।
২০০৩ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ৫৬তম সম্মেলনে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার জন্য ‘ফ্রেমঅয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)’ নামের কনভেনশনে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। ওই কনভেশনের বিধানাবলী বাংলাদেশে কার্যকর করা লক্ষ্যে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন, ব্যবহার, ক্রয়-বিক্রয় ও বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ করতে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ প্রণয়ন করে সরকার।
আইনানুযায়ী প্রকাশ্যে ধূমপান দণ্ডনীয় অপরাধ। আইনে পাবলিক প্লেস কিংবা গণপরিবহনে ধূমপান করলে তিনশত টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। কোন ব্যক্তি একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ বার করলে পর্যায়ক্রমে দ্বিগুণ দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে আইনের বাস্তবায়ন দৃশ্যমান নয়।
আইনে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা নিষিদ্ধ এবং পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত ধারা ৫(ক) তে বলা হয়েছে, ‘প্রিন্ট বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়, বাংলাদেশে প্রকাশিত কোন বই, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, পোস্টার, ছাপানো কাগজ, বিলবোর্ড বা সাইনবোর্ডে বা অন্য কোন ভাবে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করিবেন না বা করাইবেন না।’ একই আইনের ধারা ৫(ঙ) তে বলা আছে, ‘বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত বা লভ্য ও প্রচারিত, বিদেশে প্রস্তুতকৃত কোন সিনেমা, নাটক বা প্রামাণ্য চিত্রে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের দৃশ্য টেলিভিশন, রেডিও, ইন্টারনেট, মঞ্চ অনুষ্ঠান বা অন্য কোন গণমাধ্যমে প্রচার, প্রদর্শন বা বর্ণনা করিবেন না বা করাইবেন না।’
অর্থাৎ আইনে প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধের পাশাপাশি বিজ্ঞাপন ও প্রচারণার ক্ষেত্রেও বিশেষ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। তবে বিশেষ প্রয়োজনে ধূমপান কিংবা তামাজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিতান্তই করতে হলে সতর্কবার্তা সমূহ ব্যবহারের নির্দেশনা রয়েছে। অথচ দেশের সিনেমা-নাটকে তামাকজাত দ্রব্যের অবাধ ব্যবহার লক্ষণীয়। নাটক-সিনেমায় নায়ক কিংবা ভিলেনের (খলনায়ক) সিগারেট খাওয়ার দৃশ্য আরও আকর্ষনীয় করে দেখানো তো হচ্ছেই, অনেক ক্ষেত্রে আবার সতর্কবানী ব্যবহারেরও বালাই নেই। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত সাকিব খান অভিনীত ‘শাহেনশাহ’ চলচ্চিত্রের কথাই যদি উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, তবে এই সিনেমার একাধিক দৃশ্যে সিগারেটের ব্যবহার করা হলেও কোন সতর্কবার্তা ব্যবহার করা হয়নি। বরং নানা রঙে-ঢঙে সিগারেট খাওয়ার দৃশ্য আকর্ষনীয় করার চেষ্টা করা হয়েছে। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার সম্পর্কিত এমন ভুরিভুরি দৃশ্য অন্যান্য নাটক-সিনেমায়ও পাওয়া যাবে খুঁজলে। ফলে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার জন্য প্রণীত আইনটি গ্রন্থগত ‘কালো অক্ষর’ হয়েই আছে শুধু।
প্রকাশ্যে ধূমপান ও তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার বন্ধে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনিরুজ্জামান লিংকন বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হলে এই আইন বাস্তবায়ন সম্ভব। পাশাপাশি তামাক বিরোধী সংগঠনগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে এবং প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ জাতীয় পণ্য ব্যবহারের ক্ষতিকর বিষয়গুলো তুলে ধরে জন সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
তবে সিনেমা-নাটকে সতর্কবার্তা ব্যতীত ধূমপানের দৃশ্য প্রচার দুঃখজনক উল্লেখ করে অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জমান বলেন, আইনে প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধের পাশাপাশি বিজ্ঞাপন ও প্রচারণার ক্ষেত্রেও বিশেষ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই আইনের ব্যত্যয় ঘটছে। সিনেমা-নাটকের দৃশ্যে সতর্কবানী ব্যবহার ব্যতীত সেন্সরবোর্ড সিনেমার ছাড়পত্র দেওয়াটা হতাশ করে।
এই আইনজীবী আরও বলেন, সতর্কবার্তা না থাকায় এসব দৃশ্য তরুণ সমাজকে নায়ক কিংবা খলনায়কের মতো বিভিন্ন স্টাইলে ধূমপান করতে উৎসাহিত করতে পারে। যা মোটেও সমীচীন নয়। এজন্য প্রতিকার চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি।
উল্লেখ্য, টোব্যাকো এটলাস ২০১৮ অনুযায়ী, তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রতি বছর এক লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ধূমপানের কারণে বাংলাদেশে ১২ লক্ষাধিক মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে ৩ লাখ ৮২ হাজার মানুষ অকাল পঙ্গুত্বের শিকার হন। চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের মমতা হেনা লাভলীর তারকা চিহ্নিত প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক এসব তথ্য দেন।
কাজি ফয়জুর রহমান: বার্তা সম্পাদক, ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম