ফরিদুন্নাহার লাইলী:
‘জগতের যত বড় বড় জয়, বড় বড় অভিযান, মাতা ভগ্নি ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহিয়ান।’ কাজী নজরুল ইসলামের চরণদু’টিই প্রমাণ করে জগতের প্রত্যেকটি সাফল্য, প্রত্যেকটি বিজয়, প্রত্যেকটি সৃষ্টির পেছনে নারীর অবদান কোনো না কোনো ভাবে আছে। নারী মমতাময়ী আশ্রয়ে শিশুকে বড় করেছে, পুরুষের পাশে থেকে প্রেরণা যুগিয়েছে, ভ্রাতৃবন্ধনে সহোদরকে এগিয়ে যেতে পাথেয় যুগিয়েছে। নারীর সাহসে পুরুষ আকাশ জয় করেছে, হিমালয়ে উঠেছে, সমুদ্র পাড়ি দিয়েছে।
সময়ের চাহিদায় নারী যোগ্য হয়ে উঠছে নিজ প্রতিভায়। পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষিত হয়ে উঠছে নারী। ফলাফলেও বেশ ভালো করছে নারী। কর্মক্ষেত্রেও দৃঢ় প্রত্যয়ী নারী। যোগ্যতার প্রমাণ দিচ্ছেন সচ্চতার সাথে। বর্তমানে দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যেসব নারী অধিষ্ঠিত তারা কারও অনুকম্পায় নয় নিজ যোগ্যতা বলেই দায়িত্ব পালন করছেন। অবশ্য একটি সময় নারীদেরকে সব জায়গায় সব পদে দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন না আমাদের তথাকথিত পুরুষ শাসিত সমাজ। এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে উদ্যোগ নিয়েছেন আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। তাদের বাদ দিয়ে জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ কারণে শেখ হাসিনা ব্যক্তিগত উদ্যোগে নারীর অগ্রগতিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। দেশে মাধ্যমিক থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েট লেভেল নারী শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রকার মেধাবৃত্তি প্রদানের আওতায় আনা হয়েছে। দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে টিফিন প্রদান করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ফলে ঝরে পড়া কমেছে এবং মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু তাই নয়, শিশু শ্রেণীতে পড়ুয়া বাচ্চাদের মায়েদেরও উপবৃত্তি কর্মসূচী চালু করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এবং মোবাইলের মাধ্যমে সে টাকা উত্তোলনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাতে বাচ্চার মায়েরা আরও অধিক সময় বাচ্চার পেছনে দিতে পারে এবং সরকারের বিশ্বাস এতে নারী ক্ষমতায়ন আরও বাড়বে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৬০ ভাগ নারী শিক্ষক দ্বারা পূরণ করা হচ্ছে। শিক্ষার পাশাপাশি সরকার মাতৃস্বাস্থ্য এবং পুষ্টির দিকেও নজর দিচ্ছে।
নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নেও সরকার ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশই বিশ্বে সম্ভবত একমাত্র দেশ যেখানে সংসদ নেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের উপনেতা, বিরোধী দলীয় নেতা এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার একজন নারী। বর্তমান সংসদে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত প্রায় ২০ শতাংশ নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন। এই বাস্তবধর্মী পদক্ষেপের ফলে সমাজের প্রথাগত মন-মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানো সক্ষম হয়েছে। আগে যেখানে নারীদের সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণকে সামাজিকভাবে ভালো চোখে দেখা হতো না, শেখ হাসিনার সাহসী পদক্ষেপে এখন সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন পরিবারের অন্য সদস্যরাও নারীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করে। নারীর ক্ষমতায়নে বিশেষ অবদানের জন্য জাতিসংঘের ‘এজেন্ট অব চেইঞ্জ’ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অতি সম্প্রতি জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের নির্ধারিত ৬৪ দেশের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই প্রতি ঘণ্টায় পুরুষদের চেয়ে নারীরা বেশি আয় করেন। প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে- পুরো বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশেই লিঙ্গভিত্তিক পারিশ্রমিকের ব্যবধান সবচেয়ে কম। এটি নারীর ক্ষমতায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকার প্রভাব।
একথা ঠিক যে, বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন হলেও নারীমুক্তি পুরোপুরি এখনও আসেনি। নীরবে নারীরা এখনো নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। শুধু নারী ক্ষমতায়ন নারীর মুক্তি নিয়ে আসবে না। নারীর মুক্তির জন্য প্রয়োজন পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষের মানসিকতার পরিবর্তন। পুরুষ যতদিন না নারীকে তার সহযোগী ভাবতে শিখবে, যতদিন না নারীকে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ভাবতে শিখবে ততদিন এ সমস্যার সমাধান হবে না।
লেখক- কৃষি ও সমবায় সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং সাবেক সংসদ সদস্য।