সিরাজ প্রামাণিক:
হিজড়াদের সরকার তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রথমেই জেনে নেয়া যাক হিজড়া কে? বাংলা অভিধান ও গবেষকদের গবেষণা মতে হিজড়া হচ্ছে এমন ব্যক্তি যিনি প্রকৃত অর্থে পুরুষ হলেও নারীর মতো আচার-আচরণ ও পোশাক-পরিচ্ছদ পছন্দ করেন অথবা যিনি মেডিকেল অপারেশনের মাধ্যমে তার লিঙ্গ পরিবর্তন করেছেন। শারীরিক গঠন অনুযায়ী পৃথিবীতে মোট চার ধরনের হিজড়া দেখা যায়। ক. পুরুষ (তবে নারীর বেশে চলে) তাদের আকুয়া বলা হয়। এরা মেয়েদের বিয়ে করতে পারে। খ. নারী (নারীর বেশে চলে, তবে দাড়ি-মোঁচ আছে)। তাদের জেনানা বলা হয়। তারা ইচ্ছা করলে পুরুষের কাছে বিয়ে বসতে পারে। গ. লিঙ্গহীন (বেশে যাই হোক)। আরবিতে তাদের ‘খুনসায়ে মুশকিলা’ বলা হয়। এই শ্রেণির হিজড়া আসলে কারা, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন অভিজ্ঞ চিকিৎসক। ঘ. কৃত্তিমভাবে যৌন ক্ষমতা নষ্ট করে বানানো হিজড়া। তাদের খোঁজা বলা হয়। যৌন অক্ষমতার দরুণ তারা বিয়ে করতে পারে না বা বিয়ের পিঁড়িতে বসতেও পারে না। উল্লেখিত চার ধরনের হিজড়ার মাঝে আকুয়া এবং জেনানাদের লিঙ্গ নির্ধারণ দৃশ্যতঃ সম্ভব হলেও এদের অনেকের লিঙ্গ কাজের বেলায় অক্ষম কিংবা জননে ব্যর্থ। সেক্ষেত্রে তাদের জন্য বিয়ে হারাম।
হিজড়া কীভাবে নির্ধারিত হবে কিংবা তাদের সম্পত্তির শ্রেণীবিন্যাস প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে। হজরত আলী (রা.) হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে প্রসূত বাচ্চা পুরুষ-নারী নির্ধারণ করতে না পারলে তার বিধান কি- জিজ্ঞাসা করলেন। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) জবাব দিলেন, সে মিরাস পাবে যেভাবে প্রস্রাব করে। (সুনানে বায়হাকি কুবরা, হাদিস: ১২৯৪, কানজুল উম্মাল, হাদিস: ৩০৪০৩, মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক, হাদিস: ১৯২০৪)
এবার আসল কথায় আসি। মুসলিম আইনে উত্তরাধিকারীত্বের ক্ষেত্রে দুইটি দিক নির্দেশনা লক্ষ্য করা যায় যেমন: ১। প্রতিবন্ধকতা ২। অ-প্রতিবন্ধকতা। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা বা বঞ্চিত ব্যক্তিগণ হচ্ছে, ক) ক্রীতদাস খ) হত্যাকারী গ) ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ঘ) আঞ্চলিকভাবে বঞ্চিত ব্যক্তি বা সমাজ। এ সকল ক্ষেত্রে পুং লিঙ্গ বা স্ত্রী লিঙ্গের কোন বর্ণনা নাই। পুরুষ এবং স্ত্রীলোক ক্রীতদাস, হত্যাকারী, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হতে পারে। অন্যদিকে অ-প্রতিবন্ধকতা শ্রেণীর উত্তরাধিকারী হচ্ছে, ক। অংশীদার খ। অবশিষ্ট ভোগী গ। দূরবর্তী জ্ঞাতি ঘ। অসম্পর্কিত উত্তরাধিকারী এবং ঙ। বিবিধ প্রকার উত্তরাধিকারী। তাছাড়া মুসলিম আইনে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সকল সুস্বাস্থের অধিকারী সহ শারীরিক অক্ষমতা বিকলঙ্গতা, অঙ্গহানী, প্রতিবন্ধি এবং তৃতীয় লিঙ্গকে উত্তরাধিকারত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়নি। কেবলমাত্র মুসলিম বিবাহের ক্ষেত্রে যৌন-অক্ষম ব্যক্তিকে বিবাহ করা হতে নিষেধ বা নিবৃত্ত করা হয়েছে।
যেসব হিজড়ার মাঝে পুরুষালি স্বভাবের প্রাধান্য থাকে তাদেরকে পুরুষ আর যাদের মাঝে নারী স্বভাবের প্রাধান্য তাদেরকে নারী হিসেবে বিবেচনা করে সম্পত্তি বণ্টনের বিধান দিয়েছে ইসলাম। আর যেসব হিজড়ার মাঝে নারী-পুরুষ উভয় বৈশিষ্ট্যই সমভাবে বিদ্যমান, তাদেরকে নারী হিসেবে সম্পত্তি প্রদানের বিধান দিয়েছে ইসলাম।
এখন দেখা যাক হিজড়াদের বিবাহের অধিকার। হিজড়াদের বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা নেই বলে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের সঙ্গে তাদের বিবাহ স্বীকৃত নয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের মতো এদেরও রয়েছে যৌন চাহিদা। সারা পৃথিবীতে সমকামী নিয়ে আন্দোলন চলছে, পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক চলছে, চলতে থাকবে। বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি স্বেচ্ছাকৃতভাবে কোন পুরুষ, নারী বা জন্তুর সহিত প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে যৌন সহবাস করে সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা যেকোন বর্ণনার কারাদণ্ডে যার মেয়াদ দশ বছর পর্যন্ত হতে পারে-দন্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবে।
২০০৯ সালে দিল্লি হাইকোর্টের দেয়া এক রায়ে বলা হয়েছে, ৩৭৭ ধারা তার বর্তমান রূপে নাগরিকের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। সেই রায়ে আরো বলা হয়, অসাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত এই আইন ব্যক্তির পূর্ণতার পথে অন্তরায়। এই রায়ের বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতে বেশ কিছু সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনের তরফ থেকে আবেদন করা হয়। দীর্ঘ শুনানির পর দিল্লি হাইকোটের সেই রায় খারিজ করে দেন সুপ্রিম কোর্ট। বিচারপতি জি এস সিংভি এবং বিচারপতি এস জে মুখোপাধ্যায়ের বেঞ্চ জানান, ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী ‘প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ’ যে কোনো রকম যৌন সংসর্গই অপরাধ। আইনে আলাদা করে সমকামিতাকে বেআইনি বলা হয়নি। কিন্তু সংজ্ঞা অনুযায়ী সমকামীরা তার আওতায় পড়েন।
২০০৯ সালের ২ জুলাই দিল্লি হাইকোর্টে বিচারপতি এ পি শাহ এবং বিচারপতি এস মুরলীধরের বেঞ্চ ঘোষণা করেছেন, ‘যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি স্বেচ্ছায় যে যৌন সম্পর্কে অংশ নেবেন, তাকে অপরাধ বলে চিহ্নিত করা মানে ব্যক্তির মৌলিক অধিকার হরণ করা।’ দিল্লি হাইকোর্ট স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন সমকামিতা কোনো মানসিক রোগ নয়। ওই রায়ের ৩৭৭ ধারায় ‘প্রকৃতি বিরুদ্ধ’ যৌনাচার অপরাধ হলেও সেই তালিকা থেকে সমকামিতাকে বাদ দেয়া হয়।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email: seraj.pramanik@gmail.com