বদরুল হাসান কচি:
বাংলার অনেক সূর্যসন্তানই হয়তো বাঙালি জাতির শৃঙ্খল মোচনের স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু সেই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করেছেন বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর দূরদর্শী ভাবনা, অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, অন্যান্য সাংগঠনিক দক্ষতা ও অসীম সাহস এই পরাধীন জাতিকে আত্মসচেতনতায় দীপ্ত করে এক ঐক্যে, এক অভিপ্রায়ে মিলিত করেছিল এবং দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধের পর ৭১’র ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নামক নতুন দেশ পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় হয়।
তারপর, একটি শোষনমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা, উদার ও সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, মেহনতি মানুষের মুক্তি, জনগণের মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লবের বিকাশ, সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ সহ ন্যায়ভিত্তিক আদর্শে ১৯৭২ সালে বিজয়ী দেশের বহুল প্রত্যাশিত সংবিধান রচিত হয়।
প্রজাতন্ত্রের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের গণপরিষদ আদেশ, ১৯৭২ এর অধীনে ১৯৭২ সালের ২২ মার্চ একটি নতুন গণপরিষদ গঠিত হয়। সংবিধান প্রস্তুত ও খসড়া তৈরির উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল এই পরিষদ একটি ‘খসড়া প্রণয়ন কমিটি’ গঠন করে। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের জনগণ সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করে সমবেতভাবে গ্রহণ করে, যার প্রস্তাবনায় স্পষ্ট ভাষায় অঙ্গীকার করা হয়- ‘… আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে।’
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ব্যাকুল। ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আইনের শাসনে আমরা বিশ্বাস করি এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই আমরা সংগ্রাম করেছি এবং এই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই অনেক মানুষের রক্ত দিতে হয়েছে। বাংলাদেশে আইনের শাসনই প্রতিষ্ঠিত হবে। সেজন্যই শাসনতন্ত্র এত তাড়াতাড়ি দিয়েছিলাম। যদি ক্ষমতায় থাকার ইচ্ছা, যদি রাজনীতি করতাম আপনারা নিশ্চয়ই আমার পাশে যারা বসে আছেন জানেন যে, তালে তাল মিলিয়ে গালে গাল মিলিয়ে বহুকাল ক্ষমতায় থাকতে পারতাম। কিন্তু ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করি নাই, রাজনীতি করেছিলাম মানুষের মুক্তির জন্য। সে মানুষের মুক্তি মিথ্যা হয়ে যাবে, যদি মানুষ তার শাসনতন্ত্র না পায়। আইনের শাসন না পায়।’
১৯৭২ সালে বাংলার জনগণের সেই কাংখিত সংবিধানের প্রস্তাবনায় রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ৪ টি আদর্শকে গ্রহণ করা হয়েছে; যেমন- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। সুপ্রিম কোর্টের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ভাষণে খুব দৃঢ়ভাবে বলেন, ‘আমাদের শাসনতন্ত্রে আমাদের আদর্শ আছে। যে আদর্শের উপর ভিত্তি করে এই রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। চারটা রাষ্ট্রীয় আদর্শের উপর ভিত্তি করে এই দেশ চলবে। এইটাই হইল মূল কথা।’
কিন্তু এই জাতির দুর্ভাগ্য। একাত্তরের পরাজিত শক্তি যারা এই দেশকে টেনে ধরতে চেয়েছিল তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে এবং রাষ্ট্রের যে আদর্শ সেখান থেকে বিচ্যুতি করতে বারবার চেষ্টা করেছে। তাদের সে ষড়যন্ত্রকে নানান ভাবে মোকাবেলা করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পিতার আদর্শে দেশকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন।
বঙ্গবন্ধু কেমন বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলেন, সেই স্বপ্নের সোনার বাংলার প্রধানতম দলিল হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ নেই কিন্তু তার সেই শ্রেষ্ঠ উপহার ‘সংবিধান’কে হৃদয়ে ধারণ করে এই রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে। যদি সেভাবেও চিন্তা করা হয়, তাহলে বলা যায়, বঙ্গবন্ধু এই দেশের জন্য, বাংলার জনগণের সাথে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তের জন্যে আছেন, থাকবেন। আজ এই মহা মানবের জন্মশত বার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।
লেখক- অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং সম্পাদক, ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম।