আবদুল্লাহ আল মামুন:
একদিন আমলী আদালত করছি। একটা ইয়াবার মামলা। অভিযুক্ত ৭ দিন ধরে জেল হাজতে আছে। নথি পুট আপ দেওয়া হয়েছে জামিনের জন্য৷ আজ ঐ দিন জামিনের শুনানীর জন্য ধার্য্য তারিখ। আমি শুনানীর আগে অভিযুক্তকে দেখে নিই। কাঠগড়ায় হাতজোড় করে দাঁড়ানো অভিযুক্তকে দেখে বুকে ধাক্কার মতো লাগলো। একটা ১৯/২০ বছরের সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ উপজাতী ছেলে। এলোমেলো চুল। মুখটা প্রচন্ড ভার। লজ্জায়, অনুশোচনায় কিংবা অপমানে অবনমিত হয়ে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে আছে। নাকের নীচে তারুণ্যের চিহ্ন জানানো সদ্য গজিয়ে ওঠা গোঁফ। ছেলেটা বান্দরবান সরকারী কলেজে পড়ছে।
অভিযুক্তকে দেখা শেষ করলাম। আদালতের শেষে বেঞ্চিতে বসে থাকা ভদ্রস্থ কাপড় চোপড় পরা একজন উপজাতী ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রলোক হাতজোড় করে উঠে দাঁড়ালেন। তারা ছেলেটার বাবা মা। বাবা একটি সরকারী প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক। মা উন্নয়ন বোর্ডের চাকুরি করেন। একটি ছোট বোন আছে ক্লাস টেনে পড়ে। সেও আদালতে উপস্থিত। বিজ্ঞ কৌসুলি বিভিন্ন কারন বর্ণনা করে জামিন চাইলেন। রাষ্ট্র পক্ষ জামিনের বিরোধীতা করলেন।
আমি বাবা মা কে জিজ্ঞাসা করলাম তারা বাচ্চাটার খবর নিয়েছেন কিনা? বাবা অধঃমুখে জানালেন তিনি চাকুরি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। মাও একই উত্তর দিলেন। ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করলাম তুমি কয়টায় বাসায় ফেরো? কার কার সাথে মেশো? কারা তোমার বন্ধু? তোমার বন্ধুদের কি তোমার বাবা মা চেনে? আমি টের পাচ্ছিলাম কিছু লজ্জা, বোবা কান্না অনুতাপের জলে কাঠগড়ার নির্মম লোহাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। হাতকড়ার রুদ্রকঠিন বন্ধনকে শিথিল করে দিচ্ছে। আমি বাবা মা এর জিম্মায় জামিন মঞ্জুর করলাম।
এরও প্রায় ২/৩ মাস পরে আবার সেই ছেলে আমার আদালতে উপস্থিত। মামলার অভিযোগপত্র এসেছে। ২৯ সি এর ক্ষমতা থাকায় মাননীয় জেলা ও দায়রা জজ স্যার মামলাটা সি জে এম স্যারের কাছে পাঠিয়েছেন। স্যার বিচারের জন্য আমার আদালতে পাঠিয়েছেন। তার মা উপস্থিত। আমি অভিযোগ গঠন করলাম। সে দাবী করলো সে নির্দোষ।
আমার আদালতে সব মিলিয়ে মাত্র মামলা ২০০ এর কাছাকাছি। সুতরাং, আমি চেষ্টা করি দ্রুত সাক্ষী ডাকার। সম্ভবত এই মামলায় ১২ জনের মতো সাক্ষী ছিলো। আমি আই ও ছাড়া সব সাক্ষীকে সমন দিতে বললাম। ১ মাস পরে তারিখ দিলাম। ঐ দিন এজাহারকারীসহ জব্দতালিকার সাক্ষী মিলে প্রায় ৭ জনের মতো সাক্ষী নিলাম। সমন গ্রহন করেও যারা আসেনি তাদেরকে ৪৮৫ এ তে শোকজ করলাম। আই ওকে সমন দিতে বললাম। পরের তারিখে আই ও সহ সব সাক্ষী হাজির। সাক্ষ্য গ্রহন শেষ হলো।
অভিযুক্ত তার মা সহ আদালতে হাজির। সব সাক্ষী আমি নিয়েছি। মামলা স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো পরিষ্কার। সদ্য তরুন ছেলেটা বাবা মায়ের কর্মব্যস্ততার সুযোগে কুবন্ধুদের পাল্লায় পড়ে বিপথে পা বাড়িয়েছে। মামলার নথি বন্ধ করে ছেলেটার সাথে কথা বললাম। তাকে মামলার সম্ভাব্য পরিণতির বিষয় বললাম। বললাম সাজা এবং খালাস এই দুটোর মাঝখানে আমার কোন ক্ষমতা নেই। তুমি সব সাক্ষীদের বক্তব্য শুনেছো। কি করেছো তুমি বলো। তোমার সত্য বলার সাহস থাকা উচিত। আজ যদি তুমি আমাকে সত্য বলতে না পারো হয়তো ভবিষ্যৎ জীবনে তুমি আফসোস করবে। তোমার মা আদালতে আছেন। তারও সব জানা উচিত। ছেলেটা ভেংগে পড়লো। প্রায় ২০/২৫ মিনিট ধরে অকপটে সব কথা বললো। আমি মাকে বললাম আপনার ছেলে সত্য বলেছে। বলুন আমাদের কি করা উচিত? মা হাতজোড় করে বললেন আদালত যে সিদ্ধান্ত দেবেন তা মেনে নেবেন। আমি হাত নামাতে বললাম।
৩৪২ ধারার ফর্মটাতে প্রশ্ন লিখলাম। সাথে ছেলেটার উত্তর। এরপর পৃথক আরেকটা কাগজে ছেলেটার সম্পুর্ন বক্তব্য লিখলাম। তারপর প্রায় ঝাড়া ১০/১৫ মিনিট সাক্ষ্য, সাজাসহ বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যা করলাম। আমি খুব কম মাদকের মামলায় এই ধরনের সাক্ষ্য পেয়েছি।
সামাজিক দূরত্বের এই সময়ে Sentencing policy পড়ছিলাম। একজন বিচারক সাজা আরোপ করার সময় প্রথমে দেখবেন -আরোপিত সাজা অপরাধের সমানুপাতিক হচ্ছে কিনা? এরপর দেখবেন আরোপিত সাজা অপরাধীর প্রতি সুবিচার করছে কিনা? এরপর দেখবেন আরোপিত সাজা ভিক্টিমের প্রতি ন্যায়বিচার হলো কিনা? এরপর দেখবেন অপরাধী অপরাধের মাধ্যমে সমাজ এবং রাষ্ট্র এর যে ক্ষতি করেছে সেটার দায়ভার মেটাতে পারছে কিনা? সবশেষে দেখবেন মামলার সামগ্রিক পরিস্থিতি অনুযায়ী অপরাধীকে কি শাস্তি দিলে সমাজ,রাষ্ট্র আবার তাকে গ্রহন করবে বা কি শাস্তি দিয়ে তাকে সমাজ, রাষ্ট্রে ফিরিয়ে দেয়া যায়।কিংবা সে আদৌ সমাজে ফিরে আসার উপযুক্ত কিনা? ( যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং মৃত্যুদন্ডের বিষয় স্মরন রাখুন)
এই মামলায় আমি অপরাধীর বয়স, মাদকের পরিমান, তার পিতামাতার পরিচয়, তার শিক্ষা অবস্থা, ৭/৮ দিন তার জেলে থাকার অনুভূতি এবং শাস্তি আরোপ করে জেলে পাঠালে তার আরো বড় অপরাধী হয়ে উঠার সম্ভাবনা, তার অনুতপ্ত অবস্থা এবং সবশেষে তার ভবিষ্যৎ চিন্তা করেছি। অনায়াসে এই ছেলেটাকে ১/২ বছরের বা আরো বেশি সময়ের জেল দেয়া যেতো। যে সাক্ষ্য এসেছে তাতে এই সাক্ষ্য discard করা অসম্ভব।
আমি ঐদিনই তাকে দোষী সার্ব্যস্ত করি এবং ছেলেটাকে প্রবেশনে দেওয়ার জন্য প্রবেশন কর্মকর্তা( অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা) থেকে pre sentence রিপোর্ট তলব করি। আমি যখন এসব শুনছি বা বলছি প্রায় পুরো একঘন্টা সময় আদালতের একটা প্রানীও নড়েনি। বরং আশেপাশের কোর্টগুলো থেকে আইনজীবী, মুহুরি এসেছেন। বেশ কিছু বিচারপ্রার্থী ভিড় জমিয়েছেন। আদালত হিসেবে আমার দায়িত্ব এই মানুষগুলোর বিশ্বাস রক্ষা করা। আদালতের প্রতি তাদের আস্থা আরো বহুগুণে বৃদ্ধি করা। আমি বা আমরা চলে যাবো। কিন্তু এই গল্পগুলো থেকে যাবে। একটা গল্পও যদি কোন নবীন প্রাণকে স্পর্শ করে, আদালতের প্রতি আস্থা আরো বাড়ায়,ভালোবাসতে শেখায় তবে ক্ষতি কি? সেটাই কি আমাদের বড় পাওনা নয়!!!
ঐ মামলার আইও সম্ভবত ভিন্ন জেলা থেকে এসেছিলেন। তারও বয়স কম। ২৮/২৯ বছর হবে বোধ করি। তার বাস ধরার তাড়া ছিলো। আমি পরে শুনেছিলাম তিনি বাস পিছিয়েছিলেন ঘন্টা দুয়েকের জন্য। আমি যখন থেকে কথা বলেছি তখন থেকে তিমি মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। আদালত শেষ করে নামার পরে আমার বেঞ্চ সহকারী জানিয়েছিলেন এই ছেলেটার জন্য আইও এর মায়া ছিলো। কিন্তু আইনগত ভাবে তার কিছুই করার ছিলো না। ছেলেটা ভুল করেছে। কিন্তু খালাস না হয়েও যে জীবনের পথে ফেরা যায় এটা সে আজ কোর্ট থেকে জেনে গেলো। এইজন্যই সে বসেছিলো। আইও নাকি খুব খুশি হয়েছে এই আদেশে। আমি মুচকি হাসলাম।
১ মাস পরে ঐ ছেলে তার বাবা মা সহ হাজির। pre sentence রিপোর্ট এসেছে। তার পারিবারিক, সামাজিক, আর্থিক অবস্থা সব বিষয় উল্লেখ করে তাকে প্রবেশনের সুপারিশ করা হয়েছে। আমি স্মিত মুখে ছেলেটা, তার বাবা মা এর সাথে কথা বললাম। বললাম তোমার ঘাড়ের পেছনে আমি ২ বছরের জন্য একটা তলোয়ার দিচ্ছি। এই সময়ের মধ্যে তুমি যদি উল্টাপাল্টা কর তাহলে ঘাড় আলাদা হয়ে যাবে। প্রবেশনের শর্ত ভংগ করলে কয় বছর সাজা হতে পারে সেটাও বললাম। বললাম আমি তোমাকে প্রথম জামিন দিয়েছিলাম। তোমার বিচারও আমি করছি। এটা হয়তো তোমার সৌভাগ্য। তোমার কপালে ভিন্ন কিছুও থাকতে পারতো। তুমি জেল দেখেছো। আমি মনে করিনা সেটা তোমার জন্য ভালো জায়গা। তুমি তোমার বাবা মা এর সাথে থাকবে। তুমি একজন শিক্ষকের সন্তান। তোমার বাবা যদি তোমাকে মানুষ করতে ব্যর্থ হন,তাহলে তিনি তার ছাত্রদের কি করে মানুষ করবেন? আমার পিতাও শিক্ষক। আমার কাজের জন্য আমি কি চাইবো আমার পিতা লজ্জিত হন!! হাতজোড় করে আদালতে দাঁড়াবেন? একমাত্র ছেলে হিসেবে তোমার দায়িত্ব পড়ালেখা ভালো করে শেষ করবে। বাজে আড্ডা, বাজে বন্ধুদের থেকে দূরে থাকবে।
Probation of Offender Act,1960 অনুযায়ী আমরা তাকে ২ বছরের জন্য তাকে তার পরিবার,সমাজে ফেরত দিলাম। অনেকগুলো শর্ত দিলাম। এই সময় পরে তাকে যে আমরা দোষী সার্ব্যস্ত করলাম সেটার আর কোন প্রভাব থাকবে না। আর যদি সে শর্ত ভংগ করে আবার অপরাধে জড়ায় তবে ইয়াবার জন্য তার যে শাস্তি হতে পারতো সে শাস্তি তাকে আদালত দেবেন।
এই মামলায় আমি বিবেচনা করেছি তার অপরাধ এবং তাকে সমাজে ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়। আমরা পাপকে ঘৃণা করবো, পাপীকে নয়। একজন অপরাধীকে যদি আমরা সংশোধনের মাধ্যমে সমাজে ফিরিয়ে দিতে পারি তবে সেটার চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে? প্রবেশন আইন ঠিক সেই ব্যবস্থাই রেখেছে। আমরা তা প্রয়োগ করতে পারি। এভাবেই বিচার, বিচার ব্যবস্থা, বিচারক আরো মহিমান্বিত হতে পারেন। মানুষের আস্থা আরো বাড়বে।
লেখক- আবদুল্লাহ আল মামুন; অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, বান্দরবান।