সিরাজ প্রামাণিক:
সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন একজন নারী, নাম সুমি (ছদ্মনাম)। যৌতুকের একটি মামলার সাক্ষ্যপর্ব চলছে। মেয়েটি তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে মামলাটি করেছেন। মেয়েটির অভিযোগ, স্বামী তার কাছে দুই লক্ষ টাকা যৌতুক চেয়ে না পেয়ে নানা অত্যাচার করে বাবার বাড়িতে তাড়িয়ে দিয়েছে। স্বামী অদ্যবধি দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করেনি, খোরপোশ দেয়না, কোনরুপ খোঁজ খবরও রাখেনা। অবশেষে সুমি নিরুপায় হয়ে স্বামীর বিরুদ্ধে যৌতুক নিরোধ আইনে ও দেনমোহর, খোরপোষ চেয়ে দুটি মামলা করেছে।
মধ্যবিত্ত পরিবারের মাঝারি গড়ন, চিকন ও ফরসা মেয়েটির দুটি চোখ জুড়ে যেন সরলতার প্রতিচ্ছবি। ওই দুটি চোখই বলে দেয়, তার হৃদয়ের গহীনে জমে থাকা যন্ত্রণার ঢেউ। কিন্তু আসামী পক্ষের বক্তব্য যে, মেয়েটির কাছে কোনরুপ যৌতুক চাওয়া হয়নি, যৌতুক চেয়ে মারধর করা হয়নি, মেয়েটির সাথে সংসার করতে রাজি আছি ইত্যাদি।
যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ এর ৩ ধারা মতে, যদি বিবাহের কোনো এক পক্ষ, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, বিবাহের অন্য কোনো পক্ষের নিকট কোনো যৌতুক দাবি করেন, তাহলে সেটা হবে এ আইনের অধীন একটি অপরাধ এবং সেজন্য তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কিন্তু অন্যূন ১ (এক) বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
দেনমোহর ও ভরণপোষণের দাবি করে পারিবারিক আদালতে দায়েরকৃত মামলাটিতে দেনমোহরের টাকা অবশ্যই স্ত্রীকে দিতে হবে। আইনানুযায়ী তালাক কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত এবং ইদ্দতকাল পর্যন্ত অবশ্যই স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে হবে।
উপরোক্ত মামলাটি অবশেষে পক্ষগণ কর্তৃক আদালতের বাইরে নিষ্পত্তি হয়। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআন শরীফের সুরা নিসার ১২৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “কোন স্ত্রী যদি তার স্বামীর কাছ থেকে থেকে দুর্ব্যবহার ও উপেক্ষিত হওয়ার আশংকা করে, তবে তারা আপোষ নিষ্পত্তি করতে চাইলে তাতে কোন দোষ নেই। আপোষ করা তো ভাল।”
বিচার ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য নিরূপণ করে আইনি প্রতিকার দেয়া। কিন্তু আদালতে প্রতিকার পাওয়া একটা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল ব্যাপার। তাই সমাজে ঘটে যাওয়া ছোটখাটো অনেক অপরাধের প্রতিকার পেতে অনেক সময় আদালতে যাওয়া বাস্তবসম্মত হয় না। যেমন কারো একটা ছাগল হারিয়ে গেলে তার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হওয়া কোনো যুক্তিসঙ্গত কাজ হবে না। কারণ আদালতের ফি ও আইনজীবীর খরচ গুনতে গুনতে তার দশটা ছাগলের পয়সা ফুরাবে। কিন্তু এসব অপরাধকে আবার বিনা বিচারে যেতে দেয়াও ঠিক হবে না। পৃথিবীর বয়স যতদিন, মানুষে মানুষে বিরোধের বয়সও ততদিন। মানব সভ্যতার শুরু থেকেই বিরোধ নিষ্পত্তির বিভিন্ন পন্থা মানুষ আবিষ্কার করেছে। এর মধ্যে পক্ষগণ কর্তৃক আদালতের বাইরে বা আদালতের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির একটি প্রক্রিয়া রয়েছে, এ প্রক্রিয়াকে এডিআর (ADR ev Alternative Dispute Resolution) বলা হয়।
বাংলাদেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা প্রধানতঃ ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত বিচার ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। সেসময়ের প্রবর্তিত আইনসমূহু হুবুহু বা কতিপয় পরিবর্তন সাপেক্ষে এখনও আমাদের দেশে প্রচলিত আছে। আমাদের আইন ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসনের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হতে পারেনি। সে কারন প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা আমাদের বিচার ব্যবস্থাকে অনেক পিছিয়ে রেখেছে।
বিরোধী বিষয় বলতে এমন একটি ঘটনাকে বুঝায় যা এক পক্ষ কর্তৃক দাবী করা হয় এবং অপর পক্ষ তা অস্বীকার করে ও উভয় পক্ষই তাদের দাবীর সমর্থনে কতিপয় যুক্তি উপস্থাপন করে। অন্যভাবে বলা যায়, A dispute is a problem to be solved, together, rather than a combat to be won.
তবে বিরোধ নিষ্পত্তি বলতে এমন একটি বিষয় বুঝানো হয় যা পক্ষগণ একত্রে সমাধা করে এবং যা আদালতে মোকদ্দমা দায়েরের মাধ্যমে জয় লাভের প্রত্যাশায় করা হয় না। এটা শান্তিপূর্ণভাবে পক্ষগণ কর্তৃক মীমাংসিত হয়ে থাকে। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি একটি লাভভিত্তিক, ভবিষ্যৎ দৃষ্টি, পারষ্পরিক সম্পর্ক পুণঃপ্রতিষ্ঠা, শত্রুতার অবসান, ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগা সহ উভয় পক্ষের মধ্যে সৌহার্দ ও সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়।
আপোষ নিস্পত্তির বিষয়ে পবিত্র কোরআন শরীফে বলা হয়েছে, “মন্দের প্রতিফলন মন্দ, আর যে ক্ষমা করে দেয় ও আপোষ নিষ্পত্তি করে তার পুরুস্কার আল্লাহর কাছে। আল্লাহ সীমা লংঘনকারীদের পছন্দ করে না। (সুরা আশ-শুরা, আয়াত: ৪০)
বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বিষয়ে দেওয়ানি কার্যবিধির ৮৯এ, ৮৯বি, ৮৯সি ধারায়, অর্থঋণ আদালত আইনের পঞ্চম অধ্যায়, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশসহ কিছু আইনে বর্ণিত হয়েছে।
আবার দেওয়ানি মামলায় একটি পর্যায়ই হলো বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি, যা প্রতিটি পক্ষের জন্য বাধ্যতামূলক। কিন্তু ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় এখন পর্যন্ত অনুরূপ বিধান চালু হয়নি। তবে ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪৫ ধারায় সীমিত আকারে অনুরূপ আপস-মীমাংসার বিধান রাখা হয়েছে। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪৫ ধারায় কিছু অপরাধের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলোর কিছু অংশকে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে এবং কিছু অংশ আদালতের অনুমতি ছাড়াই আপস নিষ্পত্তির কথা বলা হয়েছে। ওই অপরাধগুলো খুব ছোটখাটো প্রকৃতির যেমন- মারামারি, বাসগৃহে চুরি, মানহানি ইত্যাদি।
ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪৫ ধারায় বর্ণিত বিধান ছাড়া অন্য কোথাও আপস-মীমাংসার বিধান খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না। তবে কিছু বিশেষ আইনে (Special Law) আপস-মীমাংসার সুযোগ আছে। যেমন-যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮। এ আইনের ৭ ধারায় বলা আছে, এই আইনের অধীন প্রতিটি অপরাধ আমল অযোগ্য, জামিন অযোগ্য এবং মীমাংসাযোগ্য হইবে।
বাংলাদেশে সমাজ ব্যবস্থায়ও সমাজিক মধ্যস্থতার বিধান আদিকাল থেকে প্রচলিত ছিল। শালিস, গ্রাম আদালত ব্যবস্থা ও মুসলিম পরিবারিক আইনে অনেক আগে থেকে মধ্যস্ততার বিধান প্রচলন ছিল। তবে আদালত সংযুক্ত এডিআর প্রচলন খুব বেশি আগের নয়। বাংলাদেশে ১৯৪০ সালে আরবিট্রেশন অ্যাক্ট, ১৯৬৯ সালে ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল রিল্যাসন অরডিন্যান্স ও মুসলিম ফ্যামেলি ল’ অরডিন্যান্স এবং ১৯৮৫ সালে ফ্যামেলি কোর্ট অরডিন্যান্সের মাধ্যমে এডিআরের যাত্রা শুরু হয়। সর্বশেষ ২০০৩ সালে দেওয়ানী কার্যবিধিতে এডিআরের বিধান রেখে সংশোধনী আনা হয়।
ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হলো অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া। আর এর মাধ্যমে রাষ্ট্র দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন করতে চায়। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় ভুয়া মামলা, মিথ্যা মামলা, গায়েবী মামলা ও হয়রানিমূলক মামলা করার অনেক নজির আছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য বাদী অনুরূপ মামলা করে থাকে। পুলিশ কর্তৃক দায়েরকৃত মামলায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনুরূপ দৃষ্টান্ত লক্ষ করা যায়। তা ছাড়া পুলিশ প্রতিবেদনও সব সময় সঠিকভাবে দাখিল করা হয় না। পুলিশ বিভাগে আলাদা তদন্ত সেল না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ অফিসারকে তাড়াহুড়া করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে হয়। এতে ক্রুটি থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়।
সব দেওয়ানি মামলায় যেমন এডিআর সম্ভব নয়, তেমনি সব ফৌজদারি মামলায় আপস-মীমাংসার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যাবে না। কারণ এতে অপরাধীদের মনে ভয়ভীতি থাকবে না, বরং অপরাধ করে মীমাংসার সুযোগ থাকায় অপরাধ প্রবণতা আরো বেড়ে যেতে পারে। তবে এমন কিছু মামলা আছে, যা আসলেই মীমাংসা হওয়া দরকার। যেমন যৌতুক মামলা, পারিবারিক মামলা ইত্যাদি। তাহলে আদালতে মামলার চাপ কমবে।
লক্ষ্য করা যায়, আদালতের বিজ্ঞ আইনজীবীরাও অনেক ক্ষেত্রে মামলা মীমাংসার পক্ষপাতী থাকেন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, সাক্ষীর কাঠগড়ায় স্বামী, আসামির কাঠগড়ায় স্ত্রী বা সাক্ষীর কাঠগড়ায় বাবা, আসামির কাঠগড়ায় ছেলে। এরূপ ক্ষেত্রে পক্ষদ্বয় যদি আসলেই সমঝোতা চায়, আদালত অনেক বিষয় চিন্তা ও বিবেচনা করে বিকল্পভাবে বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ দিয়ে থাকেন। যৌতুক মামলার ক্ষেত্রে ফরিয়াদির অনেক সময় এ রকম উদ্দেশ্য থাকতে পারে আসামিকে জেলের ভাত খাওয়াব। আবার কিছুদিন পরে সেই মামলাটিতেই পক্ষদ্বয় আপস করতে চায়। আসল কথা হলো, কোন কোন মামলায় আপস নিষ্পত্তি হওয়া দরকার, এর একটা স্পষ্ট নীতিমালা থাকলে বিচারকাজ সহজ হয়। এডিআর বিষয়ে ভবিষ্যতে আইন প্রণয়নের সময় এ বিষয়টি চিন্তা করা উচিত। সবশেষে সবশেষে মামলার পক্ষদ্বয়কে তালগাছটি আমার এই মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’।
Email:seraj.pramanik@gmail.com