মোঃ ফরিদুজ্জামান; সহকারী জজ, ঝিনাইদহ।

দে: কা: ৮৯ক ধারার সংশোধনী দেওয়ানী আদালতে দ্রুত মোকদ্দমা নিষ্পত্তির নব হাতিয়ার

ফরিদুজ্জামান: 

বাংলাদেশ সরকার দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আমাদের আইন সংস্কৃতির সাথে মানানসই বিভিন্ন রকমের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিচারাদালতসমূহ সাজিয়েছেন। সব কিছু করার একটাই লক্ষ্য । তা হলো দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করা। বাংলাদেশে ফৌজদারী মামলাসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তির অনেক তরিকা সরকার ভেবেছেন। বেরও হয়েছে। এর ফলে ফৌজদারী মামলাসমূহের বিচার এবং নিষ্পত্তি বেশ তাড়াতাড়ি হয়। তারপরেও ফৌজদারী অপরাধ বেড়েই চলেছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশে বিচারাধীন মোট মামলার সংখ্যা ৩৬ লাখ ৪০ হাজার ৬৩৯ টি। ( দৈনিক যুগান্তর, ৫ই ফেব্রুয়ারি,২০২০)। আবার, মাননীয় আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী জনাব আনিসুল হক ২০১৯ সালে জাতীয় সংসদে জানিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৬ লাখ ৮২ হাজার ৩৪৭ টি। এর মধ্যে দেশের নিন্ম আদালতসমূহে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩০ লাখ ৫৩ হাজার ৮৭০ টি। যার মধ্যে ১৭ লাখ ২৫ হাজার ২৭০ টি ফৌজদারী মামলা এবং বাকী ১৩ লাখ ২৮ হাজার ৬০০ টি দেওয়ানী প্রকৃতির মোকদ্দমা (দৈনিক বাংলা ট্রিবিউন, ১৮ই জুন,২০১৯)।

দেখা যায় দেওয়ানী মোকদ্দমার চেয়ে ফৌজদারী মামলার সংখ্যা বেশী। কিন্তু একটা দেওয়ানী মোকদ্দমা ও একটা ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তির গড় সময়ের মধ্যে অনেক ফারাক। বাংলাদেশের এমন অনেক দেওয়ানী আদালত আছে যেসব আদালতে ১৯৭০/১৯৮০ দশকের মোকদ্দমা বিচারাধীন। ফৌজদারী আদালতে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হলেও নতুন মামলা তাড়াতাড়ি দায়ের হচ্ছে বলে অনেকেই ধারণা করেন যে, প্রচলিত ধারায় আর মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল মেডিয়েশন সোসাইটির ইং ১১/০২/২০২০ তারিখের ‘বিরোধ নিষ্পত্তিতে মেডিয়েশনের ভুমিকা’ শীর্ষক সেমিনারে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের মাননীয় বিচারপতি মুহাম্মদ ইমান আলী বলেন, ‘মেডিয়েশন বা মধ্যস্থতায় কোন বিরোধ নিষ্পত্তি হলে সেখানেই বিরোধের সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু আদালতকেন্দ্রিক বিচার ব্যবস্থায় নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আপীল বিষয়ক পর্যায় থাকে। যার ফলে বিরোধ নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরী হয়।’ মাননীয় বিচারপতিগণের এই আইনি মনস্তত্ব পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বিচার ব্যবস্থার সাথেও মিলে যায়। যেমন- ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বিচার বিভাগ যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডন জানিয়েছেন যে, বিবাহ সম্পর্কিত কিংবা ব্যবসায়িক সমস্যা এখন থেকে মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হবে। সেখানে বলা হয় যে, কোন মামলা হওয়ার পর আদালত পক্ষগণকে ডাকবেন। আদালত তাদের মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেবেন। পক্ষগণ সম্মতি দিলে আদালত সমাধানের পথ তৈরী করে দেবেন। এভাবে সমাধান করতে পারলে বিরোধীয় পক্ষগণকে আর নিন্ম আদালতের সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর উচ্চ আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না।

সে কারণে বাংলাদেশের আদালতসমূহ যাতে দ্রুত মামলা মোকদ্দমা নিষ্পত্তি করতে পারে সে জন্য কিছু বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহারের চেষ্টা শুরু হয়েছে। যাকে বলা হয় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি। ইংরেজিতে বলা হয় এডিআর। এডিআর এর বেশ কিছু পদ্ধতির মাঝে মধ্যস্থতা বেশ জনপ্রিয় এবং প্রচলিত। দেওয়ানী আদালতে বিকল্প পদ্ধতিতে মোকদ্দমা নিষ্পত্তির একমাত্র হাতিয়ার মধ্যস্থতা ও আর্বিট্রেশন। সেকারণে দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ এর ধারা ৮৯ ধারার আর্বিট্রেশন বিষয়ক বিধান বিলুপ্ত করে নতুন ৮৯ক (মধ্যস্থতা) ও ৮৯খ (আর্বিট্রেশন) ধারা সন্নিবেশ করা হয়। প্রাথমিকভাবে আপীল আদালতে উপরে বর্ণিত পদ্ধতি ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়নি। পরে ২০০৬ সালে আইন সংশোধন করে আপীলেও মধ্যস্থতা ও আর্বিট্রেশনের বিধান আনা হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ২০০৬ সালের আইন দ্বারা দেওয়ানী মোকদ্দমা নিষ্পত্তির অগ্রগতি নেই। সে কারণে বাংলাদেশ আইন কমিশন ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকারকে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দেয়। সেখানে বলা হয় দেওয়ানী মোকদ্দমা নিষ্পত্তিতে শুধুমাত্র এডিআর এর উপর নির্ভর করলেই বাংলাদেশে মোকদ্দমা জট কমবে। আর সে কারণে বাংলাদেশ সরকার আইন কমিশনের প্রতিবেদন আমলে নিয়ে দেওয়ানী কার্যবিধিতে ২০১২ সালে সংশোধনী আনেন। সেখানে বলা হয় ৮৯ক ধারায় মধ্যস্থতার পর্যায় আবশ্যিকভাবে অতিক্রম করেই মোকদ্দমার পরবর্তি পর্যায়ে যেতে হবে। যদি তা করতে পক্ষদ্বয় শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন কেবল তখনই মোকদ্দমার পরের পর্যায়ে যেতে হবে। উল্লেখ্য, ২০০৬-২০১৭ সাল পর্যন্ত ১২ বছর দেওয়ানী আদালতসমূহ এই নিয়মে প্রচলিত বিচার প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে দেওয়ানী মোকদ্দমা নিষ্পত্তি করেছেন। বিধান করা হয়েছিল যখনই কোন দেওয়ানী মোকদ্দমায় বিবাদী লিখিত জবাব দাখিল করবেন তখন আদালত নিজে বা পক্ষগণের আবেদনের প্রেক্ষিতে মোকদ্দমার পরবর্তি কার্যক্রম স্থগিত করে মোকদ্দমাটি বিকল্প পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি করবেন।

এই মধ্যস্থতা পদ্ধতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আদালত অনেক সময় বিশাল সংখ্যার দেওয়ানী মোকদ্দমার ভিড়ে সময় দিতে ব্যর্থ হন। এই বিষয়টা আইন বিভাগের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। সে কারণে জাতীয় সংসদ দেওয়ানী কার্যবিধি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দেওয়ানী কার্যবিধি ১৯০৮ এর ৮৯ক ও ৮৯খ ধারা দুটিতে লিগ্যাল এইড অফিসারকে মধ্যস্থতার মাধ্যমে দেওয়ানী মোকদ্দমা নিষ্পত্তির ক্ষমতা দেয়া হয়। ৮৯ক ধারায় লিগ্যাল এইড অফিসার দেওয়ানী আদালতের নিকট হতে মোকদ্দমা মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট আদালত থেকে নথী পাবেন। আদালতের নিকট একটি দেওয়ানী মোকদ্দমা বিকল্প উপায়ে নিষ্পত্তি করার ভিন্ন ভিন্ন ক্ষমতা প্রদান করলেও এতদিন সেসব উপায় সফল হয় নি বলেই হয়তো জাতীয় সংসদ লিগ্যাল এইড অফিসারকে এই দায়িত্ব দিয়ে মধ্যস্থতার মাধ্যমে মোকদ্দমা নিষ্পত্তির নতুন দ্বার উন্মোচন করার উদ্যোগ নিয়েছে। অথবা সরকার উপরের দুটি ধারায় অন্যান্য উপায়ের বাইরে নতুন উপায় বাতলে মোকদ্দমা নিষ্পত্তির কী ধরণের পরিবর্তন হয় তা দেখার চেষ্টা করছেন। ৮৯খ ধারাতেও ৮৯ক ধারার বিধান মেনে চলার সুযোগ রাখা হয়েছে।

আইনগত সহায়তা আইন, ২০০০ এর ২১ক ধারা২০১৩ সালে সন্নিবেশিত হলেও বাংলাদেশ সরকার দেওয়ানী আদালতের মোকদ্দমা নিষ্পত্তির জন্য লিগ্যাল এইড অফিসারকে ক্ষমতা দিতে চার বছরেরও বেশি সময় নিয়েছে। কারণ ২০১৩ সালের ঐ আইনেই লিগ্যাল এইড অফিসার যে কোন আদালত হতে প্রেরিত যে কোন বিরোধের বিকল্প উপায়ে নিষ্পত্তির ক্ষমতা পেয়েছেন। যাহোক দেরিতে হলেও দুটি আইনের মধ্যে সমন্বয় হয়েছে। এবং বাংলাদেশের বিচারপ্রার্থী জনগন ইতোমধ্যে এই বিধানের সুফল পেতে শুরু করেছেন।

দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার ইং ৮ই নভেম্বর, ২০১৯ তারিখের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত তিন মাসে বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় এডিআর এর মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে ৬০ হাজার ৬১৬ টি মামলা। এর মধ্যে দেওয়ানী মোকদ্দমা আছে ২ হাজার ১০ টি। সেখানে আরও বলা হয়েছে যে, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা এডিআর এর মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে ঢাকা জেলায়। সেখানে মোট ৬ হাজার ৯৩৫ টি নিষ্পত্তি হয়েছে। সবচেয়ে কম নিষ্পত্তি হয়েছে লালমনিরহাট জেলায়।

সুতরাং উপরের আলোচনা হতে একটি বিষয় পরিষ্কার। নতনু বিধানের ফলে বাংলাদেশে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির হার বেড়েছে। কিন্তু এই উর্দ্ধমুখী হার কি ক্রমবর্ধমান মামলা দায়েরের হারের সাথে সমাঞ্জস্যপূর্ণ? বাংলাদেশ কি বৈশ্যিক আগ্রগতির সাথে এক্ষেত্রে তাল মিলিয়ে বিচারপ্রার্থী জনগণকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারছে? বাংলাদেশের দেওয়ানী আদালতগুলো একইসাথে জমি জায়গা নিয়ে জটিল থেকে জটিলতর বিষয়ের বিচার করে থাকেন। জমি জায়গার বিষয় নিয়ে বিচার করা বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে জটিল বিষয় হলো বাটোয়ারা মোকদ্দমা পরিচালনা করা। এ ধরণের মোকদ্দমা পরিচালনা করতে আদালতের দীর্ঘ সময় ও অধ্যবসায় প্রয়োজন হয়। অন্যান্য দেওয়ানী প্রকৃতির মোকদ্দমার কথা না হয় বাদই দেয়া হলো। সেই সাথে আছে দেওয়ানী আদালতের কিছু বিশেষ পরিচয়। দেওয়ানী আদালতসমূহ একইসাথে পারিবারিক আদালত। পারিবারিক আদালত আবার বিশেষ আদালত। সে কারণে পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আদালতকে একই দিনে অন্যান্য মোকদ্দমার চাপ সরিয়ে পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সময় দিতে হয়। এই বিষয়টি অনুধাবন করে ঢাকা, খুলনাসহ আরও কয়েকটি জেলায় পারিবারিক আদালত পৃথকভাবে প্রতিষ্ঠা করে আলাদা বিচারক দিয়ে বিচার কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। অন্যদিকে, আছে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালসহ অর্পিত সম্পত্তি বিষয়ক ট্রাইব্যুনাল এবং স্মল কজেজ কোর্টসমুহ। প্রত্যেকটি ট্রাইব্যুনাল বিশেষায়িত বিচার করে থাকেন। ফলে প্রচলিত দেওয়ানী আদালতসমুহকে সাধারণ দেওয়ানী মোকদ্দমার বিচারের বাইরে ট্রাইব্যুনালসমুহে দ্রুত বিচার নিশ্চিতে কাজ করতে গিয়ে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে পক্ষগণের মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ কম রাখা হয়েছে। এর বাইরে দেওয়ানী আদালতের রায় প্রস্তুতের কাজ তো রয়েছেই!

বাংলাদেশের দেওয়ানী আদালত পরিচালনার বাইবেল খ্যাত Civil Rules and Orders এ বিধান করা হয়েছে নিন্ম আদালতের বিচারকগণ সকাল ৯ঃ৩০ থেকে বিকাল ৪ঃ৩০ পর্যন্ত এজলাশে থাকবেন এবং বিচারিক কাজ করবেন। এই বিধান নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগ এই বিধান অনুসারেই দেওয়ানী আদালতগুলোর নিকট হতে কার্যাবলীর বিবরণ চেয়ে থাকেন। বিভিন্ন সময় সার্কুলার দিয়ে নিন্ম আদালতকে সতর্ক করেন এই বিধান যথাযথভাবে মানতে। এমনকি পরিদর্শনের কথা বলেন এই বিধান অনুসারে! ফলে বাংলাদেশের অধঃস্তন আদালতের বিচারকগণের হাতে আইনত বিচারিক কাজের বাইরে গিয়ে বিকল্প বিরোধ বিশেষ করে মধ্যস্থতা করানোর সময় বের করা সাধারণত দুরূহ ব্যাপার।
আবার বাংলাদেশের আইনজীবীগণের মধ্যে দেওয়ানী আদালতের নতুন বিধান মেনে দ্রুত বিরোধ নিষ্পত্তিতে আগ্রহ এখনও সন্তোষজনক পর্যায়ে আসেনি বলে প্রতীয়মান হয়।

পারিবারিক আদালতের বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে যে বিশাল সুযোগ দেয়া আছে পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এর ১০ ও ১৩ ধারায় তা প্রতিপালনে আইনজীবীগণ আদালতকে কম সহযোগিতা করেন। এই অধ্যাদেশের ১০ ও ১৩ ধারায় যথাক্রমে প্রিট্রায়াল ও পোস্ট ট্রায়ালের বিধান রাখা আছে। এই দুটি ধারাসহ পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশের মুখ্য উদ্দেশ্য বিকল্প উপায়ে যে কোন ভাবে পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তি করা। কিন্তু পারিবারিক আদালতে এই বিধান মেনে নিষ্পত্তির হার অনেক কম। ফলে, বাংলাদেশের আইন মনস্তত্বে এখনোও বিরোধাত্বক বিচার প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে দ্রæত বিকল্প উপায়ে বিচার করার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের প্রবণতা অনেক কম।
অন্যদিকে, বিচারকসহ লোকবল সংকটের বিষয়টি তো আছেই। মাননীয় আইনমন্ত্রী সংসদে ১৭ই ফেব্রæয়ারি,২০২০ জানিয়েছেন, বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য একজন বিচারক আছেন। যেখানে ভারতে ৫০ হাজার জনে একজন, ইংল্যান্ডে প্রতি ২০ হাজারে একজন, আমেরিকা, ফ্রান্স ও ইতালিতে প্রতি ১০ হাজার জনে ০১ জন বিচারক আছেন। ফলে, স্বল্প বিচারক সংখ্যা নতুন বিধানের বাস্তবায়নে বড় বাধা না হলেও প্রতিবন্ধক বটে!
আরও কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। বাংলাদেশের লিগ্যাল এইড অফিসারগণের যে সব অফিস দেয়া হয়েছে তার সবই ধার করা এবং অস্থায়ী। বর্তমানে দেশের প্রায় ২৫-৩০ টি জেলায় চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন নির্মিত হয়ে পুরোদমে বিচারকার্য চলমান। এসব বিল্ডিং এ লিগ্যাল এইড অফিসগুলো স্থানান্তরিত করা হয়েছে।এর বাইরে বেশিরভাগ অফিসগুলোতে স্থান সংকট প্রচুর। সেই সাথে আছে প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাব। বাংলাদেশে লিগ্যাল এইড কার্যক্রম শুরু হয়েছে সেই ২০০০ সালের দিকে। কিন্তু এখনোও এই কার্যক্রমকে বিচার বিভাগের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা কমই দেখা যায়। মাঝে মাঝে তো অনেকে লিগ্যাল এইড অফিসার আসলে বিচারক কিনা সে প্রশ্নই করে বসেন। আবার সংশ্লিষ্ট দেওয়ানী আদালতের যে নথী নতুন আইন অনুসারে লিগ্যাল এইড অফিসে পাঠানো হবে সে নথী পাঠানোর জন্য যে রেজিস্টার মেইনটেন করা আবশ্যক তা এখনোও হাইকোর্ট বিভাগ বা জাতীয় লিগ্যাল এইড অফিস তৈরী করেন নি বা তৈরী করলেও আদালতসমূহে প্রেরণের ব্যবস্থা করেন নি। অন্যদিকে, যেহেতু প্রক্রিয়াটা একেবারেই নতুন সেহেতু সংশ্লিষ্ট আদালতের পেশকার ও সেরেস্তাদারগণদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া আবশ্যক। কিন্তু তা দেয়ার ব্যবস্থা এখনোও করা হয় নি।

২০২০ সাল মুজিববর্ষ। মুজিববর্ষে বাংলাদেশ সরকার দেশের বিভিন্ন সেক্টরে দ্বিগুন সাফল্যের ক্ষেত্রে নানামুখী কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। দেশের বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন বিভাগের মত বিচার বিভাগও মুজিববর্ষে দ্বিগুন মামলা নিষ্পত্তির প্রত্যয় নিয়ে ২০২০ সালশুরু করেছেন। আর এই ইশতেহার বাস্তবায়নে মধ্যস্থতার মাধ্যমে সামাজিক পরিমণ্ডলের নানাবিধ বিরোধ দ্রুত, স্বল্প ব্যয়ে নিষ্পত্তির ক্ষেত্র প্রসারিত করার ক্ষেত্রে দেওয়ানী কার্যবিধির ৮৯ক ধারা সংশোধন অবশ্যই যুগান্তকারী।

সর্বজনস্বীকৃত যে, বর্তমান সরকার বিচার বিভাগের উন্নতির জন্য অতীতের যে কোন সরকারের চেয়ে বেশি বাহবা পাবেন। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বাংলাদেশ বের হতে পেরেছে। ন্যয়বিচার প্রতিষ্ঠা এখন সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়। সাম্প্রতিক বেশ কিছু উদাহরন আমাদের সামনে আছে। এখন দরকার বিরোধাত্মক বিচার ব্যবস্থার বাইরে যাওয়া। সেটা সম্ভব হবে যদি দেওয়ানী কার্যবিধি এবং আইনগত সহায়তা আইনের মধ্যে সমন্বয় করে মধ্যস্থার মাধ্যমে ন্যয়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায়। সে কারণে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের দৃঢ় সহাবস্থান এখনই প্রয়োজন।

লেখক- সহকারী জজ, জিনাইদহ।