রাজীব কুমার দেব:
বিজ্ঞ বিচারকদের একটি সামাজিক মাধ্যমে বিশেষ একটি আইনের জামিনযোগ্য অপরাধে জামিন প্রদান না করা বিষয়ে আইন আলোচনায় মন্তব্য করতে গিয়ে একটি অপ্রত্যাশিত প্রচলিত আইনি চর্চার প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হল। সাথে চিন্তায় আসল জামিনযোগ্য অপরাধে জামিন না হওয়ার রীতিকে তো বিচার সংস্কৃতিতে অপ্রত্যাশিত মনে করা হয়। এই প্রসঙ্গে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের বিচারিক পর্যবেক্ষণ তথা সহজাত ক্ষমতা, দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্লেষণধর্মী পর্যবেক্ষণের নীতি প্রাসঙ্গিক বিষয় হতে পারে কিনা চিন্তায় ঘোরপাক খেতে লাগল।
তাই কোন রকম আইনি বই বা মহামান্য উচ্চাদালতের রেফারেন্সের আশ্রয় না নিয়ে নেমে পড়লাম। বিশেষভাবে উল্লেখ্য এই লেখায় আদালত বলতে ফৌজদারি মামলায় জামিন শুনানীতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতকেই বুঝাবে এবং বিচারিক পর্যবেক্ষণ তারই জামিন ক্ষমতার অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। এই আলোচনা কোনভাবেই কোন অবস্থায়ই ভিন্ন আদালত কে বুঝাবে না এবং ভিন্ন আদালতের জামিন ক্ষমতাকে অন্তর্ভূক্ত করবে না।
জামিনযোগ্য অপরাধে ‘জামিন পাওয়া’ যেমন একটি আইনি অধিকার তেমনি ‘জামিন দেওয়া’ একটি প্রতিষ্ঠিত রীতি। এই রীতির ব্যত্যয় আইন অনুশীলনের সংস্কৃতিতে শুধু বৈপরিত্যই নয় একটি স্বীকৃত অধিকারকে অস্বীকারের সামিল মনে করা হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে এই ব্যত্যয় আইনাংগনে বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বাধা হিসেবেও বিবেচিত হয়ে থাকে। অন্যদিকে জামিনযোগ্য অপরাধে জামিন প্রদানের বিষয়টি বিবেচনা করতে গিয়ে বিচারিক পর্যবেক্ষণ তথা সহজাত ক্ষমতা, দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্লেষণধর্মী পর্যবেক্ষণের নীতি প্রয়োগ করা কেন যাবে না তাও চুলছেড়া বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
তবে এই লেখার উদ্দেশ্য জামিনযোগ্য মামলায় জামিন নিষ্পত্তিতে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের সহজাত ক্ষমতা, দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্লেষণধর্মী পর্যবেক্ষণের নীতি প্রয়োগের সুযোগ আছে কিনা তা পরোখ করে দেখা।
ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় জামিন সংক্রান্ত বিধানের মূল আইনে বিজ্ঞ আদালতকে Objective form এ রেখে passive voice আকারে ‘shall be released on bail” শব্দাবলী ব্যবহার করে ‘জামিনযোগ্য অপরাধে জামিন প্রদান’ অধিকারটি সন্নিবেশ করা হয়েছে। আর একটু বিস্তারিতভাবে বলা যায় কার্যবিধির ৪৯৬ ধারায় জামিনযোগ্য অপরাধে বিজ্ঞ আদালত অভিযুক্তকে মুক্তি প্রদান করবেন শব্দাবলী ব্যবহার না করে “shall be released on bail” শব্দাবলী ব্যবহার করার কারণে বিজ্ঞ আদালতের সহজাত ক্ষমতা, দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্লেষণধর্মী পর্যবেক্ষণ প্রয়োগ করার সুযোগ আছে কিনা বা স্পেস দেওয়া হয়েছে কিনা সেই প্রসঙ্গটি চলে আসে।
উল্লেখ্য এই প্রসঙ্গটি আরো আলোচনায় চলে আসে যখন দেখা যায় কার্যবিধি বা অন্যকোন সংশ্লিষ্ট আইনের Plain Language এ জামিনযোগ্য অপরাধে জামিন দিতে হবে এই বাধ্যবাধকতা উল্লেখ করা হয় নি। আবার কোন আইনেই জামিনযোগ্য ধারায় জামিন না দিলে কি হবে তার ফলাফলও উল্লেখ করা হয় নি। তাই প্রাথমিক বিবেচনায় ‘জামিনযোগ্য অপরাধে জামিন প্রদান’ একটি আইনি অধিকার যা বিজ্ঞ আদালতের সহজাত ক্ষমতা, দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্লেষণধর্মী পর্যবেক্ষণের বাইরে নয়।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে কার্যবিধির ৪৯৬ ধারার ক্ষমতা বা জামিনযোগ্য ধারার ক্ষমতা প্রয়োগে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট কি বিচারিক পর্যবেক্ষণ তথা সহজাত ক্ষমতা, দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্লেষণধর্মী পর্যবেক্ষণ প্রয়োগের নীতি বিবেচনায় নিতে পারেন? প্রাথমিক বিবেচনায় প্রশ্নটি আপেক্ষিক মনে হতে পারে।
যাহোক প্রথমেই বিচারিক পর্যবেক্ষণ নীতির সুনির্দিষ্টকরণ প্রয়োজন।
‘সহজাত ক্ষমতা’ হচ্ছে এমন কিছু বিষয় যা আইনে বর্ণিত নয় কিন্তু আইনের আঙ্গিক থেকে উসৃত কিছু নীতি যা আইনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন, আইনের প্রয়োগ নিশ্চিয়করণ, আইন কে frustration থেকে রক্ষাকরণকে অন্তর্ভূক্ত করে। জামিনে গেলে অভিযুক্ত পলাতক কিংবা তদন্তে ব্যাঘাত ঘটা কিংবা গৃহীত সাক্ষ্য প্রমাণ ক্ষতিগ্রস্ত করার সম্ভাবনা আছে কিনা তাও সহজাত বিবেচনার অংশ।
‘দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি’ প্রকৃত অপরাধ সনাক্তকরণ না হওয়া পর্যন্ত সহজাত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে বিচারিক মনে জামিন আবেদনকারী অভিযুক্তের উপস্থিতির সম্ভাব্যতা বিবেচনায় নেওয়া।
‘বিশ্লেষণধর্মী পর্যবেক্ষণ’ উপস্থাপিত রেকর্ড পর্যালোচনায় অপরাধের গভীরতা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নিয়ে অভিযোগ ও দাখিলীয় কাগজাদি পর্যালোচনায় অভিযুক্তের জামিনে গেলে কি ধরণের পরিস্থিতি ও পরিবেশ অদ্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা আছে তা বিবেচনায় নেওয়া।
উদাহরণ সহ কয়েকটি ক্ষেত্র উল্লেখ করলে বিষয়টি পরিস্কার হতে পারে। যেমন –
প্রথমত, দণ্ডবিধির ২৭৯, ৩০৪(খ) ধারায় তদন্তাধীন একটি জি আর মামলায় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে রেকর্ডকৃত অপরাধ জামিনযোগ্য হলেও অপরাধ সংগঠনের সময় আইনি শর্ত না মানার মত ভিন্ন প্রেক্ষাপট থাকার কারণে তদন্তে যদি অ-জামিনযোগ্য ধারার অপরাধের সত্যতা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে ‘এফ আই আর কনক্লুসিভ নয়’ বিবেচনায় জামিন নিষ্পত্তিতে বিচারিক পর্যবেক্ষণের নীতি প্রয়োগ করলে আইনি ব্যত্যয় হবে না। যেমন – জামিন আবেদনের সময় আবেদনকারী গাড়ি চালক ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখাতে না পারলে তদন্তে ৩০৪ (খ) ধারা ৩০২ ধারায় রুপান্তর অর্থাৎ জামিনযোগ্য অ-জামিনযোগ্য ধারার অপরাধে রুপান্তর হতে পারে – এটি একটি বিচারিক পর্যবেক্ষণ এবং এই পর্যবেক্ষণের আলোকে জামিন প্রদানকারী আদালত জামিন দরখাস্ত নিষ্পত্তি করতে আইনানুগ বাধা দেখা যায় না।
দ্বিতীয়ত, The Control of Entry Act, 1952 এর অপরাধ সমূহ জামিনযোগ্য কিন্তু অভিযুক্ত ভারতীয় হওয়ার কারণে তার জামিন প্রদান এবং উপস্থিতির অনিশ্চয়তা বিচার প্রক্রিয়া তথা মূল আইনকে frustrate করতে পারে এই পর্যবেক্ষণের আলোকে জামিন প্রদানকারী আদালত জামিন দরখাস্ত নিষ্পত্তি করতে আইনানুগ বাধা দেখা যায় না৷
তৃতীয়ত, জামিনযোগ্য মামলায় অভিযুক্তের রেকর্ডপত্র বিবেচনায় তাকে Habitual Offender, ঠিকানার অসংগতি, উপযুক্ত জিম্মাদারের অভাব, মামলায় উপস্থিতির অনিশ্চয়তা, জামিনে গেলে ২য় অপরাধ সংগঠনের সম্ভাবনা, দীর্ঘদিন ধরে পলাতক, মিস ইউস ছিল, অতি শিঘ্রই দেশ হতে পলায়নের সম্ভাবনার কারণগুলো জামিন দরখাস্ত নিষ্পত্তিতে বিবেচনায়ও আনা যেতে পারে। তবে বলে রাখা ভাল এই বিবেচনাগুলো সবসময় উপযুক্ত কারণ নাও হতে পারে কিংবা বিচারিক অস্থিরতার কারণও হতে পারে। তাই বিষয়গুলো বিচারিক বিবেচনায় নিতে সর্ব্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
বর্ণিত ক্ষেত্রগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় একটি বিচারিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের জামিনযোগ্য অপরাধের জামিন নিষ্পত্তি করতে গিয়ে সহজাত ক্ষমতা, দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্লেষণধর্মী পর্যবেক্ষণের নীতি প্রয়োগ করার অধিকার রয়েছে। কেননা নিজ বিচারিক আদেশের ফলে নিজ এখতিয়ারাধীন এলাকায় আইন শৃংখলার পরিস্থিতি সমূহ বিঘ্ন ঘটার সম্ভাবনা বিবেচনায় নেওয়াও বিচারিক কাজের অন্তর্ভূক্ত। তদক্ষেত্রে জামিনযোগ্য অপরাধে বিচারিক পর্যবেক্ষণের আলোকে জামিনের ক্ষমতা প্রয়োগ বারিত করা আইনে বাধা আছে বলে মনে হয় না।
সার্বিক পর্যালোচনায় জামিনযোগ্য ধারায় জামিন প্রদানে মূল ক্ষমতা বা জামিন ক্ষমতার প্রয়োগ বিজ্ঞ আদালতের কিছু সহজাত ক্ষমতা, দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্লেষণধর্মী পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভর করে। যেমন –
১। জামিনযোগ্য অপরাধে জামিন পাওয়া অভিযুক্তের আইনি অধিকার আর জিম্মানামার উপযুক্ততা নির্ধারণের ক্ষমতা বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের বিচারিক পর্যবেক্ষণের নীতি হিসেবে বিবেচিত হতে হবে।
২। অভিযুক্তের অধিকার মানে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের আইনি দায়িত্ব এবং এই দায়িত্ব পালন বা ক্ষমতার প্রয়োগ অবশ্যই সংশ্লিষ্ট আইনের বাস্তবতা বা Pre and Post action, pre and post circumstances বিবেচনায় প্রয়োগ করতে হবে।
৩। বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের জামিন প্রদানের ক্ষমতা অবশ্যই তার সন্তুষ্টির উপর নির্ভর করে এবং সন্তুষ্টি আবার সংশ্লিষ্ট আইনের বাস্তবতা বা Pre and Post action, pre and post circumstances এর উপর নির্ভর করে।
৪। শর্ত পালনে অসম্ভাব্যতা বা মামলায় উপস্থিতির নিশ্চয়তায় বিন্দুমাত্র সন্দেহ জামিন প্রদানের ক্ষমতাকে বারিত করতে পারে।
৫। যে ক্ষেত্রে অভিযুক্তের অধিকার শর্তের উপর নির্ভর করে এবং সেই শর্ত পালনে অনিশ্চয়তা দেখা দেয় বা সন্দেহ থেকে যায় সেই অধিকার প্রদানে আইনি বাধা দেওয়ার যথেষ্ট কারণ হতে পারে।
৬। অভিযুক্তের উপস্থিতির অনিশ্চয়তা সংশ্লিষ্ট মামলা তথা সংশ্লিষ্ট আইনের মূল উদ্দেশ্য কে Frustrate করছে কিনা তাও বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।
তবে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের বিচারিক পর্যবেক্ষণের নীতি সমূহ প্রয়োগে সর্ব্বোচ্চ সতর্কতা জরুরী। এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গিয়ে বে-ইনসাফের যাতে কারণ না হয় এবং মূল ধারার স্রোত থেকে যাতে বিচ্যুতি না ঘটে সেদিকে কঠোর নজর দিতে হবে।
বিচারিক পর্যবেক্ষণের নীতি প্রয়োগের স্পেস দেওয়ার জন্যই বা ইংগিত করার উদ্দেশ্যেই হয়তো মূল আইনে বিজ্ঞ আদালতকে Objective form এ রেখে passive voice আকারে “shall be released on bail” শব্দাবলী ব্যবহার করা হয়েছে। সর্বোপরি বিচারিক পর্যবেক্ষণ করার দায়িত্ব কিন্তু বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট কেই নিতে হবে এবং জামিনযোগ্য অপরাধে জামিনের ক্ষমতা প্রয়োগ বারিত করা হবে কিনা তা বিচারিক পর্যবেক্ষণের নীতির আলোকেই সিদ্ধান্ত নিলে আইনের কোন ব্যত্যয় হতে পারে কিনা জানা নেই।
পরিশেষে বলা যায় বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের জামিনযোগ্য ধারায় জামিন না দেওয়া আইনের ব্যত্যয় নয় বরং রীতির ব্যত্যয়। পরিবেশ, পরিস্থিতি, আইনের সুপ্ত উদ্দেশ্যের স্বার্থে ও বিচারিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং সর্বোপরি বর্ণিত আইনি উপলব্ধিতে বিচারিক পর্যবেক্ষণের নীতি প্রয়োগ করে রীতির ব্যত্যয় ঘটে থাকলে তা যে আইনি ব্যত্যয় হবে নিশ্চিত করে বলা যায় না।
লেখক- সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কক্সবাজার।