মো. জিয়াউর রহমান :
‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’ এর আর্টিকেল ৩৫(৩) এ বলা হয়েছে, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন আদালতে দ্রুত বিচার পাওয়ার অধিকার সব নাগরিক এর আছে। এটা সব নাগরিকের জন্য মৌলিক অধিকার। আরেকটা প্রতিষ্ঠিত নীতি হলো, দোষী প্রমানিত না হওয়া পর্যন্ত আসামীকে নির্দোষ মনে করতে হবে। আমাদের আইনে আসামীর অধিকার যতটা সুরক্ষিত, অপরাধের শিকার ক্ষতিগ্রস্থ ভিকটিমদের সুরক্ষা ততটাই অরক্ষিত। আমাদের আইন ব্যবস্থায় ভিকটিমদের বিষয়ে বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন আইনে বলা থাকলেও সামগ্রিক ভাবে ভিকটিমদের ক্ষতিপূরণ বিষয়ে পৃথক ও পূর্নাঙ্গ আইন নেই। এই লেখায় আমরা ভিকটিমদের ক্ষতিপূরণ বিষয়ে পৃথক আইনের প্রয়োজনীয়তা জানার চেষ্টা করবো।
আমরা একটা গল্প (Hypothesis) দিয়ে শুরু করি। না, অলীক নয়, এমন গল্প মাঝেমাঝে আমরা পত্রিকায় পড়িও। ধরুন গ্রামের সাধারণ ঘরের একজন মেয়ে ভার্সিটিতে পড়ে। বাবা কৃষক। মেয়েটার ছোট আরও ৩/৪ জন ভাইবোন আছে। কোন এক বখাটে সেই মেয়েটিকে প্রেম নিবেদন করলো এবং সাড়া না পেয়ে এসিড নিক্ষেপ করলো। মেয়েটির মুখমণ্ডল সহ একটা হাত চিরতরে নষ্ট হয়ে গেল। বিচারে সেই বখাটে ছেলেটার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলো। আপনিই বলুন, অপরাধীর এই শাস্তি কি মেয়েটার যে ক্ষতি হলো, তা কোন ভাবে পূরণ করতে পারবে? সহজ উত্তর হলো ‘না’। একটা ট্রমার মধ্য দিয়ে পার হয়ে মেয়েটি শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, সামাজিক অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়েছে। আমাদের পুরো সমাজ ও বিদ্যমান বাস্তবতা বিবেচনা করে বিষয়টি ভাবতে হবে। অপরাধীর শাস্তি হয়তো মেয়েটির মনকে কিছুটা সান্ত্বনা (Consolation) দিবে। মেয়েটা গুরুতর আহত হওয়ায় তার লেখাপড়া বাধাগ্রস্থ হবে, শারীরিক ভাবে বিকৃত ও কর্মক্ষমতা হারানোয় তার হয়তো কোন চাকরি হবে না, কেউ হতো তাকে বিয়েও করবে না। বাবার ঘরে নির্ভরশীল থাকতে হবে। তার ক্ষতির কথা চিন্তা করে কৃষক বাবা হয়তো ছোট অন্য বাচ্চাদের পড়াতে আগ্রহী হবে না। আর বাবা মা তো একসময় মারা যাবে। তখন মেয়েটাকে খাওয়াবে? কে দেখবে? মেয়েটার মোটামুটি সম্মানজনক বেঁচে থাকার নিশ্চিয়তার জন্য একটা উপায় তো করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মেয়েটা অপরাধ করেনি, সে অপরাধের শিকার মাত্র। বিচারের দাড়িপাল্লায় আসামী ও ফরিয়াদী- দু’পক্ষকেই সমান ভাবে বিবেচনা (Treat) করতে হবে। অপরাধীকে রাষ্ট্র শাস্তি দিয়েছে, কিন্তু অপরাধের শিকার যে ভিকটিম, তাকেও নিরাপত্তা দিতে হবে, তার ক্ষতি যতটা সম্ভব পুষিয়ে দিতে হবে। সে জন্যই রাষ্ট্রকে Victims Compensation Scheme নিতে হবে।
গত শতকের ৬০ এর দশকে রাষ্ট্র চিন্তায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। রাষ্ট্র নিজেকে কল্যাণকামী (welfare state) হিসেবে নাগরিকের জন্য নানা জনবান্ধন পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে, Restorative Justice এর প্রবর্তণ ঘটে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে আমরা দেখি, সর্বপ্রথম ১৯৬৪ সনে গ্রেট বৃটেন ও নিউজিল্যান্ড Victims Compensation Program গ্রহণ করে। ১৯৬৫ সনে USA এর ক্যালিফোর্নিয়াতে Victims Compensation Program নেওয়া হয়, পরে আমেরিকার সবগুলো স্টেটস এমন পদক্ষেপ নেয়। বর্তমানে UK, Switzerland, Canada, Australia, Japan সহ মানসম্পন্ন (Standard) বিচার ব্যবস্থা আছে- এমন সব দেশেই ভিকটিমদের ক্ষতিপূরণ বিষয়ে কর্মসূচী আছে। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী চায়না ও ভারতেও এমন ব্যবস্থা রয়েছে।
Universal Declaration of Human Rights (UDHR) এর আর্টিকেল ৮ এ বলা আছে, Everyone has the right to an effective remedy. আর International Covenant on Civil and Political Rights (ICCPR) এর আর্টিকেল ৯(৫) এ বলা আছে, Anyone who has been the victim of unlawful arrest or detention shall have an enforceable right to compensation. তবে সুনির্দিষ্ট ভাবে ভিকটিমদের ক্ষতিপূরণ বিষয়ে সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক দলিল হলো UN Declaration of Basic Principles of Justice for Victim of Crime and Abuse of Power-1985 যাতে বলা হয়েছে ভিকটিমদের ক্ষতিপূরণ ও সম্মান দিতে হবে এবং তা বাস্তবায়নে রাষ্ট্রকে judicial & administrative mechanism কে সক্ষম ও কার্যকর করতে হবে। এই আন্তর্জাতিক দলিলটির Binding Effect না থাকলেও বেশির ভাগ রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত হওয়ায় Persuasive Value আছে। আর আমাদের এপেক্স কোর্ট বলেছে, আন্তর্জাতিক আইনের যে সব নীতি (principles) ও উপকারী দফা (beneficial provisions) আমাদের জাতীয় আইনের সাথে বিরোধপূর্ণ নয়, সে সব গ্রহণ করা যাবে। [17 MLR (AD) 49, 21 BLD (AD) 69]. বাংলাদেশ Convention Against Torture-1984 তে অনুস্বাক্ষর করেছে তবে আর্টিকেল ১৪ Reservation রেখে। আর্টিকেল ১৪ তে ক্ষতিগ্রস্তের ক্ষতিপূরণের কথা বলা আছে।
এ পর্যায়ে আমাদের কাছে অবধারিত প্রশ্ন ভিকটিম কারা? ল্যাটিন Victima (ধর্মীয় উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা কোন প্রাণী) হতে ইংরেজি Victim শব্দের উৎপত্তি। আমাদের CrPC তে ভিকটিম এর সংজ্ঞা উল্লেখ নাই, ইন্ডিয়ান CrPC তে আছে। Basic Principles of Justice for Victim of Crime and Abuse of Power-1985 এর আর্টিকেল ১ ও ২ এর আলোকে বলা যায়, ভিকটিম হলো অপরাধের শিকার হওয়া কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যার শারীরিক, মানসিক, অার্থিক ক্ষতি হয়েছে অথবা এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীল কেউ যেমন বাবা- মা, ছেলে- মেয়ে, স্ত্রী, ভাই- বোন ইত্যাদি। সহজ কথায় যদি বলি, যারা অপরাধের শিকার বা ক্ষতিগ্রস্থ তারা ভিকটিম। ভিকটিমদের ২ ভাবে ভাগ করা যেতে পারে- ক. Direct/Primary ভিকটিম খ. Indirect/Secondary ভিকটিম। মনে করেন, কাউকে গুলি করে মারা হলো। এক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তি হলো Direct/Primary ভিকটিম। মৃত ব্যক্তির পরিবারের নির্ভরশীল সদস্যরা হলো Indirect/Secondary ভিকটিম। Basic Principles of Justice for Victim of Crime and Abuse of Power-1985 এর আর্টিকেল ১২ তে বলা হয়েছে, অপরাধের শিকার ক. যে শারীরিকভাবে আহত হয়েছে অথবা শারীরিক বা মানসিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খ. আহত বা মৃত ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল সদস্য- এমন ব্যক্তির জন্য আসামীর নিকট হতে ক্ষতিপূরণ না পাওয়া সম্ভব হলে রাষ্ট্র ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবে।
ইন্ডিয়ার প্রচলিত আইন ও আইনগত ব্যবস্থা প্রায় আমাদের মতই। তবে ওরা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আইন ও পদ্ধতিতে সংযোজন, বিয়োজন, পরিমার্জন করে যথাসাধ্য আপডেট থাকছে। ৪ জন গৃহপরিচারিকা ধর্ষণের শিকার হওয়ায় ইন্ডিয়ান সুপ্রীম কোর্ট একটি PIL মামলায় প্রথম Compensation Board স্থাপনের নির্দেশনা দেয়। ক্ষতিপূরণকে সমর্থন করে সেই Dhelhi Domestic Women’s Forum Case Vs Union of India মামলায় ভারতের এপেক্স কোর্ট বলেন, “It is necessary, having regards to the Directives Principles contained under Article 38(1) of the Constitution of India to set up Criminal Compensation Board. Rape victims frequently incur substantial financial loss. Some, for example, are too traumatized to continue in employment. Compensation for the victim shall be awarded by the court on conviction of the offender and by the Criminal Injuries Compensation Board whether or not a conviction has taken place. The Board will take into account pain, suffering and shock as well as loss of earnings due to pregnancy and the expenses of child birth if this occurred as a result of rape.” [(1995) 1 SCC14]. এই রায়ের পর ইন্ডিয়াতে কেন ভিকটিমকে ক্ষতিপূরন দিবে না, তা কোর্টকে বাধ্যতামূলক উল্লেখ করতে হয়। পরে ২০০৮ সনে ইন্ডিয়া তাদের CrPC তে 357A ধারা সংযোজন করে কোর্ট কে ক্ষতিপূরন দেওয়ার বিষয়ে ব্যাপক ক্ষমতা অর্পণ করে।
আরেকটা বিখ্যাত মামলা Chairman Railway Board & others Vs Chandrima Das & others [(2000) 2 SCC 465]. কলকাতার হাওড়া স্টেসনে রেলওয়ে কর্মী একজন বাংলাদেশী নারীকে ভুল বুঝিয়ে যাত্রী নিবাসে নিয়ে ধর্ষণ করে। চন্দ্রীমা দাস নামে একজন লয়ার কলকাতা হাইকোর্টে রীট করলে হাইকোর্ট রেলওয়ে বোর্ডকে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে আদেশ দেন। সুপ্রীম কোর্টে আপীল হলে সুপ্রীম কোর্ট বলে, Right to life শুধু ভারতীয় নাগরিকদের জন্য নয়, অন্য দেশের নাগরিকদের জন্য সমান ভাবে প্রযোজ্য। S. Nambi Narayanan Vs Siby Mathews & others ETC [(2018)10 SCC 804] মামলাটি তুলনামূলক সাম্প্রতিক। একজন নাম করা বিজ্ঞানীকে গোয়েন্দাগিরির অভিযোগে আটক করা হয়। কোর্ট তার আরেস্ট Unlawful ঘোষণা করে বলে, একজন জাতীয় খ্যাতি সম্পন্ন বিজ্ঞানী যে গভীর অপবাদের শিকার হয়েছে, তা ভীষন মনঃপীড়াদায়ক, তাকে মনোচিকিৎসা নিতে হয়েছে। এ জন্য তার পৃথক ক্ষতিপূরণের মামলা বিচারাধীন থাকা সত্বেও সে ক্ষতিপূরণ পেতে হকদার। তারপর বলেছে, “The court cannot lose sight of the wrongful imprisonment, malicious prosecution, the humiliation and the defamation faced by the appellant.”
এবার দেখি আমাদের আইনে ভিকটিমদের জন্য কি ব্যবস্থা আছে। আগেই বলেছি, আমাদের এখানে আসামীর অধিকার যতটা সুরক্ষিত, ভিকটিমদের অধিকার ততটাই অরক্ষিত। আশার কথা হলো, উঁচু স্বরে না হলেও আমাদের দেশেও ভিকটিমের ক্ষতিপূরণ বিষয়ে কথা হচ্ছে। মাননীয় হাইকোর্ট একটি রায়ে বলছেন, “In a democratic country governed by rule of law, the government is responsible for ensuring free and fair trial not only to the accused but also to the victim of crime. It is also emphasised that the court is not only to see the right of the accused persons, but also to see that the victim of crime can have a trial free from all fear and insecurity.” (21 BLD 503). আমাদের আইন কমিশন অবশ্য ২০০৭ সনে Crime Victim Compensation Act এর ড্রাফ্ট ল প্রস্তাব করেছে। কয়েক বছর পার হলেও এ বিষয়ে দৃশ্যমান কাজ হয়নি। আমাদের CrPC বৃটিশদের প্রবর্তিত। সেই CrPC এর ৫৪৫(১) ধারাতে বলা আছে, কোর্ট যে fine করবে, তার আংশিক বা পূর্ণ অংশ মামলার খরচ ও ক্ষতিপূরণ হিসেবে ভিকটিম কে দেওয়ার আদেশ দিতে পারবে। এটা আদালতের Discretionary Power যা অধিকার হিসাবে ক্ষতিপূরণ কে স্বীকৃতি দেয় না। আর Mandatory নয় বলে বিচারকরা খুবই কম ক্ষেত্রে এমন আদেশ দেয়। তাছাড়া এই পদ্ধতিটা Effective ও নয়, কেননা এই ক্ষতিপূরণ আদায় আরেক ঝক্কির ব্যাপার। এক্ষেত্রে ভিকটিমকে এডভোলেরেম কোর্ট ফি সহ সিভিল-কোর্ট এ মামলা করতে হয়। এ যেন খাজনার চেয়ে বাজনা বেশীর মত ব্যাপার! সমকাল পত্রিকার নিউজ এডিটর বাংলাদেশ বেভারেজ কোঃ এর একটি ট্রাকের নিচে পড়ে মারা যান ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৮৯। নিহতের স্ত্রী ৩.৫২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের মামলা করেন। জজ কোর্ট ও হাইকোর্টে তিনি নিজ পক্ষে রায় পান। পরে আপীল বিভাগ ১৩ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে টাকার অংক কমিয়ে ১.৭ কোটি টাকার রায় দেন। এ রায়ই তো শেষ নয়, টাকা আদায়ে জারী মামলা করতে হয়েছে। দায়ী কোঃ এর সম্পত্তি নিলাম না হওয়ায় ২৬ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও সেই ক্ষতিপূরণের টাকা আদায় হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে তারেক মাসুদ এর কেসটি (67 DLR 523) ক্ষতিপূরণ বিষয়ে মাইলফলক। মোটর ভেহিকল অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩ এর ১২৮ ধারার বিধান মতে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মানিকগঞ্জ জজ কোর্টে মামলাটি দায়ের হলেও জনগুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় সংবিধানের আর্টিকেল ১১০ মতে পরে মাননীয় হাইকোর্ট এ বিচার হয়। একটি ডিভিশন বেঞ্চ ২০১৭ এর ডিসেম্বরে তারেক মাসুদ এর পরিবারের পক্ষে ৪.৬২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের রায় প্রদান করে। বর্তমানে, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল বিভাগে মামলাটি পেন্ডিং আছে। রীট এর আওতায় মাননীয় হাইকোর্ট ক্ষতিপূরণের কিছু আদেশ দিলেও তাৎক্ষণিক বাস্তবায়িত হওয়ার তেমন নজীর নেই বলেই পরিলক্ষিত হয়।
২০০০ সন হতে রাষ্ট্র আইন প্রণয়নের সময় ভিকটিকদের ক্ষতিপূরণ বিষয়ে সহানুভূতিশীল বিধান রাখছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন -২০০০ এর ১৩ ধারায় বলা আছে, ধর্ষণের ফলে জন্ম নেওয়া শিশু মায়ের তত্বাবধানে বড় হবে এবং খরচ রাষ্ট্র বহন করবে, সরকার এই খরচ আসামির বর্তমান বা ভবিষ্যৎ সম্পদ হতে আদায় করতে পারবে। ১৪ ধারা মতে, সহযোগী শাস্তি হিসেবে যে Fine এর কথা বলা আছে, তা জরিমানা হিসেবে ভিকটিম কে দেওয়ার সুযোগ আছে। ১৬ ধারা মতে আদালতের আদেশে জেলার কালেক্টর (DC) আসামির স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক ও নিলামের মাধ্যমে জরিমানার টাকা আদায় করতে পারবে। প্রায় একই রকম বিধান দেখতে পাই এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০২ এর ৪৪ ধারায়। সেখানে বলা আছে, আদায়কৃত জরিমানার টাকা ভিকটিম বা তার মৃত্যুতে উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হবে। আমরা আরও এমন বিধান দেখতে পাই পরিবেশ আদালত আইন-২০১০ এর ৯ ধারায়, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন- ২০১০ এর ১৬ ধারায়। মানব প্রাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের ২৮ ধারায় বলা আছে, কোর্ট ক্ষতিপূরণ নির্ধারণে ভিকটিমের শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসার ব্যয়, যাতায়াত ও আবাসন ব্যয়, হারানো আয়, যাতনা, প্রকৃত বা আবেগজনিত ক্ষতি ও দূর্ভোগের তীব্রতা বিবেচনায় নিবে। এই আইনের ৩৯ ধারায় আরও বলা হয়েছে, ক্রিমিনাল মামলার পাশাপাশি ক্ষতিপূরণের জন্য সিভিল মামলাও করা যাবে। অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি একই সাথে সিভিল ও ক্রিমিনাল ২ ধরনের মামলায় ক্ষতিপূরণ পেতে পারবে। অপরাধ সংক্রান্তে প্রায় সব আইনেই জরিমানার ব্যবস্থা আছে এবং তা ক্ষতিপূরণ হিসেবে ভিকটিম কে দেওয়ার আইনগত সুযোগ আছে। তবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন ও বিধি না থাকায় আদায় করা খুবই জটিল। একটা উদাহরণ দেই- এনআই এ্যক্ট 138 এর মামলাতে চেকে উল্লেখিত টাকা চেকগ্রহীতা (ভিকটিম) পাওয়ার কথা। দেখা যায়, আসামী জেল খেটে বের হয়ে যাচ্ছে, জরিমানার টাকা দিচ্ছে না। জরিমানার টাকা কিভাবে আদায় হবে তা বলা আছে CrPC এর ৩৮৬ ধারায় যা ভীষণ জটিল এবং প্রায় অকার্যকর পদ্ধতি। বলা আছে কোর্ট নিজে আদায় করবে অথবা DC কে আদায়ের ক্ষমতা দিবে। কোর্ট নিজে আদায়ের বিষয়ে সরকার বিধি করবে বলা থাকলেও আজও এমন কোন বিধি তৈরী হয়নি। আর DC টাকা আদায় করবে সিভিল কোর্ট এর ডিক্রির মত করে। সহজ, সুন্দর, পূর্ণাঙ্গ আইন না থাকায় জরিমানার টাকা আদায়ে DC গোলকধাঁধায় পরে। মূলতঃ জেলের ভয়েই যা আদায় হয়, জেলকে ভয় না পেয়ে শাস্তি ভোগ করলে জরিমানার টাকা আদায় রীতিমতো অসম্ভব।
আমাদের রাষ্ট্রের সক্ষমতা বেড়েছে। রাষ্ট্র বিধবাদের, বয়স্কদের ভাতা দিচ্ছে। অসহায় ও দরিদ্রদের কে সামাজিক নিরাপত্তার (social safety net) আওতায় খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে। ভিকটিমদেরকেও রাষ্ট্র ক্ষতিপূরণ দিতে সক্ষম। আইন কমিশন এ সংক্রান্ত আইনের ড্রাপ্ট করে রেখেছে। দরকার, বিচারপ্রার্থীদের কল্যাণে এগিয়ে এসে ক্ষতিপূরণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন করা। প্রত্যেক জেলায় ‘জেলা ও দায়রা জজ’ এর নেতৃত্বে একটা Quasi Judicial কমিটি থাকতে হবে। কমিটি যোগ্য বিবেচিত ভিকটিমদের ক্ষতিপূরণ দিবে। প্রশ্ন হলো টাকা কোথা হতে আসবে? প্রত্যেক জেলায় Victim Compensation Fund থাকবে। অর্থের উৎস হবে সরকারি বরাদ্দ, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ডোনেশন, কোর্ট ফি, বিভিন্ন মামলার জরিমানার অর্থ, জামিননামা বাজেয়াপ্তের টাকা ইত্যাদি। আইনে প্রাপ্যতার যোগ্যতা বলা থাকবে। কিভাবে, কোন মামলায়, কতটুকো, কোন মাপকাঠিতে পাবে তাও উল্লেখ থাকবে। কোর্টকেও ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। বিচারকদের ক্ষতিগ্রস্থের প্রতি মানবিক তাড়নাবোধ (Compulsion) থাকতে হবে। প্রতিটি মামলার রায়ে বাধ্যতামূলক উল্লেখ করতে হবে কেন ভিকটিম ক্ষতিপূরণ পাবে অথবা পাবে না। নাগরিকদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আর সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্যই অপরাধী অপরাধ করার সুযোগ পায়। তাই অপরাধ প্রমান হোক বা না হোক, ভিকটিমদের ক্ষতিপূরণ রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে এবং অবশ্যই দয়া হিসেবে নয়, অধিকার হিসাবেই ভিকটিমদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে।
Bibliographical Index:
International Instruments:
1. UN Declaration of Basic Principles of Justice for Victim of Crime and Abuse of Power-1985
2. Universal Declaration of Human Rights (UDHR)- 19480
3. Convention Against Torture (CAT)- 1984
4. International Covenant on Civil & Political Rights (ICCPR)- 1966
Statutes:
1. The Constitution of People’s Republic of Bangladesh,
2. The Constitution of India,
3. Code of Criminal Procedure- 1898 (Bangladesh),
4. The Code of Criminal Procedure- 1973 (India)
5. নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০,
6. এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন-২০০২
7. পরিবেশ আদালত আইন- ২০১০
8. পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন-২০১০
9. মানব প্রাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন- ২০১২
Books:
1. Trial of Civil Suits and Criminal Cases, Justice Hamidul Haque
Judgements:
Bangladesh: 17 MLR (AD) 49, 21 BLD (AD) 69, 21 BLD 503, 67 DLR 523,
India: [(1995) 1 SCC14], [(2000) 2 SCC 465], [(2018)10 SCC 804]
Report:
Final Report on a proposed law relating to payment of compensation and other reliefs to the crime victims. আইন কমিশন
Articles:
1. Crime Victim Compensation Right: A look into the existing laws of Bangladesh. Fahima Barrin.
2. CRIME VICTIMS’ RIGHT TO COMPENSATION IN COMPARATIVE APPROACH, Fhameda Qudder
3. Right to compensation of victim crime, victimization & victimology in Bangladesh perspective, Md. Abul Karim & Dr. Md. Emran Parvez Khan
4. AN APPRAISAL OF VICTIM PROTECTION IN BANGLADESH, Hussain Mohammad Fazlul Bari
লেখক– চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, মাগুরা।
judgezia@gmail.com