তারিক আজিজ জামী: সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ আইনটি ২০১৮ সনের ৬১ নং আইন। আইনটি জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবেলা এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হ্রাসকরণের লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণীত আইন। উক্ত আইনের ১৪ ধারাতে রোগ সনাক্ত হওয়া ব্যক্তিকে সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্নকরণের বিধান বলা আছে।
বর্তমানে করোনা ভাইরাস সংক্রমনের ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা ১৪ দিন আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্নকরণ করার জন্য বলা হয়েছে। উক্ত আইনের ৫ ধারার (ট) উপ-ধারায় বিচ্ছিন্নকরণ এবং পৃথককরণের কথা বলা আছে। এই বিচ্ছিন্নকরণ ও পৃথককরণকে সারা বিশ্বে বহুল প্রচলিত কোয়ারেন্টাইন এবং আইসোলেশন বলা হচ্ছে; আমাদের দেশেও এই দুইটি শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে কথায় কথায়। যা সকলের কাছে সহজেই বোধগম্য না।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার নিরিখে বলছি আমাদের সকলের সহজে বুঝার স্বার্থে ইংরেজি শব্দ দুটিকে মাতৃভাষায় বিচ্ছিন্নকরণ ও পৃথককরণ বললে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজটুকু আরো সহজ হতো। সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইনে এই সম্পর্কিত বিধানে বলা আছে- “সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হইয়াছেন এইরূপ কোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট হাসপাতাল, অস্থায়ী হাসপাতাল, স্থাপনা বা গৃহে অন্তরীণ (Quarantine)রাখা বা পৃথককরণ (Isolation)” বলে।
আর যদি দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা সংক্রমিত কোন ব্যক্তি বা সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্নকরণ বা পৃথককরণের নির্দেশনা প্রদান করে তবে সে নির্দেশনা অমান্য করলে তা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে; যা শাস্তিযোগ্য।
সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইনের ২৫ ধারাতে এর বিস্তারিত বর্ণীত হয়েছে-” (১) যদি কোনো ব্যক্তি-
(ক) মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তাহার উপর অর্পিত কোনো দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বাধা প্রদান বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন, এবং (খ) সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কোনো নির্দেশ পালনে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।
(২) যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনূর্ধ্ব ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে, বা অনূর্ধ্ব ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন”।
এই আইনে রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে সাময়িক বিচ্ছিন্নকরণের প্রক্রিয়াটি কিভাবে এবং কার দ্বারা সম্পন্ন করা হবে তা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে- “যদি ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মচারীর এইরূপ বিশ্বাস করিবার কারণ থাকে যে, কোনো সংক্রমিত ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন করা না হইলে তাহার মাধ্যমে অন্য কোনো ব্যক্তি সংক্রমিত হইতে পারেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তিকে, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে, সাময়িকভাবে অন্য কোনো স্থানে স্থানান্তর বা জনবিচ্ছিন্ন করা যাইবে”।
এছাড়াও উক্ত আইনে সংক্রমণের তথ্য গোপন করা ও রোগের বিস্তার ঘটান, তবে তা এই আইনের অধীন অপরাধ; যা শাস্তিযোগ্য।
এই আইনের ২৪ ধারার ১ উপ-ধারায় বলা আছে-“যদি কোনো ব্যক্তি সংক্রামক জীবাণুর বিস্তার ঘটান বা বিস্তার ঘটিতে সহায়তা করেন, বা জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও অপর কোনো ব্যক্তি সংক্রমিত ব্যক্তি বা স্থাপনার সংস্পর্শে আসিবার সময় সংক্রমণের ঝুঁকির বিষয়টি তাহার নিকট গোপন করেন তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ”। আর শাস্তির বিধান ২ উপধারায় উল্ল্যেখ করা হয়েছে-“যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনূর্ধ্ব ৬ (ছয়) মাস কারাদণ্ডে, বা অনূর্ধ্ব ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন”।
তাছাড়াও অত্র আইনের ২৬ ধারায় বিধান আছে মিথ্যা বা ভুল তথ্য প্রদান করে তা অপরাধ বলে গন্য হবে এবং তা অনূর্ধ্ব ২ (দুই) মাস কারাদণ্ডে, বা অনূর্ধ্ব ২৫ (পঁচিশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
অতএব, আমাদের সকলের সরকারি ও যথোপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সকল নির্দেশনা মেনে চলা একমাত্র নাগরিক দ্বায়িত্ব; যা আইনগতভাবে মানতে সকলে বাধ্যও বটে।
বর্তমান কোভিড-১৯ ভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বে যে রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা সমগ্র মানবজাতির জন্য এক ক্রান্তিকাল; যা সকল উন্নত প্রযুক্তি, সামর্থ্যকে অসহায় করে ফেলেছে। আমাদের দেশে ইতোমধ্যে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়ে গেছে এবং সমগ্র বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে।
উন্নত-অনুন্নত, সভ্য-অসভ্য প্রায় দুইশতাধিক রাষ্ট্র আজ স্রষ্টার ইশারার-স্রষ্টার করুনার অপেক্ষায় এই দুর্যোগ থেকে মুক্তি চেয়ে প্রহর গুনছে!
এমন অসহায় সময়ে আসুন সকলে আমাদের নাগরিক দায়িত্ব তথা সরকারি সকল নির্দেশনা পালনে সচেষ্ট হয়ে নিজে নিরাপদ থাকি, পরিবারকে নিরাপদ রাখি।
লেখক- অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত; ঢাকা।